ইসলামের নামে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ

=====================
ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী
————
[ধারাবাহিক ভাবে বেশ কিছু পর্বে জংগী দমনে এবং সুন্নিয়ত প্রচার ও প্রসারে করণীয় প্রস্তাবনাগুলো প্রকাশ করা হবে, ইনশা আল্লাহ! পোস্টটি ভাল লেগে থাকলে কপি করে আপনার টাইমলাইনে পোস্ট করুণ। ধন্যবাদ!]

সন্ত্রাসবাদ এখন দেশ, রাষ্ট্র আর ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে পৃথিবী নামক এই গ্রহের আনাচে-কানাচে বিস্তার লাভ করেছে। কখনো ধর্মের নামে চলছে সন্ত্রাসবাদ, কখনো জাতি বা গোষ্ঠীর নামে। সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা কোথাও আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকতা পাচ্ছে। তাও আবার দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপরে। সাম্প্রতিককালের অনেক ঘটনাই এর প্রমাণ বহন করে। তবে সবচে’ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ব্যাপার হচ্ছে এই সন্ত্রাসবাদকে ধর্মীয় মোড়কে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই বিশেষ সন্ত্রাসবাদ আবার ডালপালা মেলে অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। যার প্রভাব থেকে বিশ্বের কোন ব্যক্তি বা দেশই শংকামুক্ত নয়। প্রণিধানযোগ্য যে, প্রতিটি ধর্মেই কিছু না কিছু গোষ্ঠী রয়েছে যারা ধর্মীয় আবরণে অন্যের উপর জোর-জুলুম আর অত্যাচার করে আসছে। বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদি, জৈন, পার্সি, শিখ কিংবা বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী কেউ এর থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু আধুনিক মিডিয়া কখনই হিন্দু সন্ত্রাসী, বৌদ্ধ সন্ত্রাসী, খৃষ্টান সন্ত্রাসী, ইহুদী সন্ত্রাসী কিংবা আদিবাসী সন্ত্রাসী হিসেবে এদেরকে আখ্যায়িত করে না। অথচ কোন মুসলমান সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়লে বিশেষ কারণে তাদেরকে মুসলিম সন্ত্রাসী বা ইসলামী জংগী হিসেবে চিত্রায়িত করে থাকে। যা সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা মাত্র।

সাম্প্রতিক কালে মুসলমানদের মধ্য থেকে কিছু দল এবং গোত্র তৈরি করা হয়েছে যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ইসলামের নাম নিয়ে চালাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, লুটপাট আর জিহাদের নামে সন্ত্রাসবাদ। আল-কায়েদা, তালিবান, বুকো হারাম, দায়েশ, নুসরাহ ফ্রন্ট, ইসলামী খেলাফত – অসংখ্য নামের কয়েকটি মাত্র। আল-কায়েদা নামের সংগঠনটি সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি আতংকের নাম। সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদিনের নেতৃত্বে এই সংগঠনটি ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বের আনাচে-কানাচে বিস্তার লাভ করেছে। কে এই বিন লাদেন? এক কথায় আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের সৃষ্টি এই বিন লাদেন। আফগানিস্তান থেকে রুশদের বিতাড়িত করতে তৈরি করা হয়েছিল তালিবান। যারা ইসলামের নামে বিধবাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বাধ্য করেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। ইসলামী শরীয়ার নামে প্রতিষ্ঠা করেছে ত্রাস। বিন লাদেন এবং মোল্লা ওমরকে ধরতে তালিবানদের পৃষ্ঠপোষক সেই প্রভুরাই আবার ধ্বংস করেছে আফগানিস্তান। তালিবানরা যে নারীদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়েছিল, পশ্চিমারা সেই নারীদেরই হত্যা করলো। কারা অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং সার্বিক সমর্থন দিয়ে তালিবান প্রতিষ্ঠা করেছিলো তা কারো অজানা নয়।

আফ্রিকার কয়েকটি দেশে রয়েছে তালিবান, আল-কায়েদা এবং ইসলামী খিলাফতের আদলে ইসলামী সংগঠন বুকো হারাম, আল-শাবাবসহ অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তাদের বিস্তার সোমালিয়া, সুদান, মিশর, নাইজেরিয়া, শাদ, নাইজার, ক্যামেরুনসহ আশেপাশের এলাকায়। হাজার হাজার নারীপুরুষকে অপহরণ করে এরা প্রতিষ্ঠা করেছে ত্রাসের রাজত্ব। ধর্ষণ আর খুন হল এদের বিভিন্ন অপকর্মের মধ্যে কয়েকটি।

ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর তৈরি হয় সন্ত্রাসের উর্বর ভুমি। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সাহায্যের নামে তৈরি করা হয় দায়েশ। পরবর্তীতে দায়েশ আর আল-কায়েদাকে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল নিয়ে সম্মিলিত রূপ দিয়ে গঠন করা হয় আইএসআইএল যা সংক্ষেপে ইসলামী খিলাফত। ওহাবী/সালাফী নামধারী কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতায় আর ইহুদী-খৃষ্টান চক্রের কৌশলগত এবং সামরিক সহায়তায় বিশ্বব্যাপী এখন চলছে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ। এর দায়ভার এসে পড়ছে সাধারণ মুসলমানের উপর। কলঙ্কিত হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম। উইকিলিকস আর পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টেই এখন জানা যাচ্ছে কিভাবে তারা নিজেদের স্বার্থে কট্টর মুসলিমদের মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দ মত দল তৈরি করে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইরাকে ১৫ লক্ষ মুসলমান হত্যা করে এরা এখন ক্লান্ত। আফগানিস্তানে কত লক্ষ মুসলমান হত্যা করা হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। সৌদি সরকারের সরাসরি আহ্বান এবং আর্থিক সহায়তার আশ্বাসেও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় নিজেদেরকে প্রত্যক্ষভাবে জড়াতে চায়নি। পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র আর ইজরাইলের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ আর সামরিক সরঞ্জামাদি যোগানের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে “দায়েশ” আর “ইসলামী খেলাফত”-এর মতো এযাবৎকালের সবচে’ ধনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। পশ্চিমাদের ত্রিমাত্রিক সহায়তার পাশাপাশি রয়েছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার আর জর্ডানের আর্থিক সহায়তা। তালিবান, আল-কায়েদা, দায়েশ, ইসলামী খেলাফত, বুকো হারাম, আল-শাবাব, নুসরাহ ফ্রন্টসহ যত ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে তাদের সবার আক্বীদা মূলত সৌদি ওহাবী এবং তথাকথিত সালাফী আক্বীদা। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সালাফী ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদের একটি মহীরুহ – বিষবৃক্ষ।

এই বিষবৃক্ষ ইসলামের নামে ধ্বংস করে চলেছে শহর, বন্দর, নগর, ঐতিহাসিক স্থাপনা, ঐতিহ্য, দখল করছে নতুন নতুন অঞ্চল আর জবাই করছে মুসলমান, খৃষ্টান, উপজাতি – যাদেরকেই তাদের কাছে হুমকি মনে হচ্ছে – তাদেরকে। এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি নবী (আলাইহিমুস সালাম) দের পবিত্র মাজার শরীফ, সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাবেঈ এবং আল্লাহর ওলীগণের (রাহিমাহুল্লাহু আজমাঈন) মাজার এবং মাজার সংলগ্ন মসজিদসমূহ। সৌদি আরব যেভাবে ইসলামী সব ঐতিহ্য ধংস করে তৈরি করে চলেছে ৫-স্টার হোটেল আর শপিং-মল; উল্লেখিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং দল ঠিক একইভাবে ধ্বংস করে চলেছে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এদের ধ্বংসলীলা দেখে বোঝা যাচ্ছে এদের নাম ভিন্ন ভিন্ন হলেও এদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য একই। অর্থাৎ ইসলামকে ইতিহাস শূন্য করা। যাতে খুব সহজেই মুসলমানদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলা যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এরা এদের এই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল হয়ে গেছে।

লক্ষ্য করুণ, ইহুদী-খৃষ্টান চক্র অতি সুকৌশলে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে সব দিক দিয়ে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের মনে থাকার কথা এই ব্রিটিশরা কিভাবে “Divide and Rule” অর্থাৎ “বিভাজন এবং শাসন” নীতি অনুসরণ করে পুরো মুসলিম ভারতকে প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছিলো। গত কয়েক দশক আগে মিথ্যা মারণাস্ত্রের অজুহাতে এরা ধ্বংস করেছে ইরাক, তাদের গৃহপালিত ওসামা বিন লাদেনকে ধরার নামে ধ্বংস করেছে আফগানিস্তান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একে একে অকেজো করেছে মিশর, আলজেরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, তিউনিসিয়া। আর সিরিয়াকেও তো পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেই ফেলেছে! ইরানকে শত চেষ্টার পরও তেমন কাবু করতে পারেনি। সবচে’ আতংকের বিষয় হচ্ছে এই বিষবৃক্ষ এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে খোদ আরব মুল্লুকে, যেমন সৌদি আরব আর কুয়েতে। ইতোমধ্যেই এরা সৌদি আরব ও কুয়েতে বেশ কিছু হামলাও পরিচালনা করেছে। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে এরা এখন মিশরের সিনাই উপত্যকায় মিশরীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এদের শক্তি এবং সামর্থ্য এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এখন এরা শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোতেও হামলা করতে ভ্রূক্ষেপ করছে না।

লিবিয়াতে পশ্চিমাদের আমৃত্যু শত্রু গাদ্দাফীর পতনের পর এরা এদের পছন্দের বিদ্রোহী দলগুলোকে হটিয়ে এখন আবার পথ করে দিচ্ছে ইসলামী খিলাফতের। ইসলামী খেলাফত এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে খোদ রাজধানী ত্রিপোলিতে। এভাবে একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের পর মুসলমানদেরকে নিজেদের অনুগত দাসে পরিণত করতে আর কোন বাঁধা থাকবে না। যেমন ইতোমধ্যেই সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশই পশ্চিমা খৃষ্টানদের আর ইহুদী রাষ্ট্র ইজরাইলের আনুগত্য করে চলেছে। সৌদি তেল কোম্পানি ARAMCO- এর লভ্যাংশের অর্ধেকই নিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব তাদের সৌদি রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সব সয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এরা আসলে কারা? এরা নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে দাবী করলেও এরা কি আসলে মুসলমান নাকি ইসলামের শত্রুদের ভাড়াটিয়া এজেন্ট হিসেবে মুসলমান রূপ ধারণ করে ইসলাম আর মানবতা ধ্বংসের খেলায় মেতেছে? ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এবং সলফী সালেহীনদের আদর্শ হল ক্ষমা, দয়া আর ভ্রাতৃত্ব। মক্কা বিজয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে রক্তপাতহীন একটি বিজয় সংগঠিত হয়েছিল। কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ বদরে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধবন্দীদের সাথে কী রকম আচরণ করতে হয়। কিন্তু ইসলামের নামে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কারা, যারা মুসলমান নাম ধারণ করে অন্য মুসলমান এবং প্রতিপক্ষকে জবাই করে চলেছে? মুসলমান যাতে মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সেজন্য মুসলমানদের মধ্য থেকে তৈরি করা হচ্ছে কট্টরপন্থী সালাফী/আহলে হাদিস কিংবা লা-মাজহাবীদের মতো গ্রুপ। এরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে সংগঠিত হলেও এদের আক্বীদা-আদর্শ, ধর্মীয় মতবাদ এবং ধ্বংসযজ্ঞের চেহারা একই রকম। এদের লক্ষ্য হলো একদিকে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করা, অন্য দিকে অধিকৃত অঞ্চলে ইসলামী সব ঐতিহ্য ধ্বংসের মাধ্যমে ইসলামকে ইতিহাস-শূন্য করা।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *