মওলিদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন ও অনুমতি (মুখবন্ধ)

mawlid280715nabi1

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Shaykh Tahirul Qadri’s book “Mawlid al-Nabi: Celebration and Permissibility. Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

[উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ হযরতুল আল্লামা সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে…]

 

অনুবাদকের আরয

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম,

আম্মা বা’দ।

শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী সাহেব বর্তমান ইসলামী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ও গণ্যমান্য আলেম-এ-দ্বীন। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার সুযোগ আমার নেই। তিনি অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা, যার মধ্যে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিষয়ক এই বইখানি অন্যতম। সর্ব-জনাব মুহাম্মদ ইমরান সুলাইমান ও ওয়াক্কাস আহমদ আমীন কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত এবং মিনহাজুল কুরআন ইন্টারন্যাশানাল কর্তৃক প্রকাশিত প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এ বইটির বাংলা অনুবাদকর্মে আমি হাত দিতে যাচ্ছি। আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (দ:)-এর অসীলায় এবং আমার পীর ও মোর্শেদ (রহ:)-এর নেক-নজরে আমাকে কামিয়াব করুন, আমীন।

-কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 

মওলিদুন্নবী (দ:)

আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়

(হে রাসূল) বলুন: আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া (মহানবীকে তাদের মাঝে প্রেরণের মাধ্যমে); সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত হতে শ্রেয়। [আল-কুরআন, ১০:৫৮; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]

মহানবী (দ:)-এর হাদীস শরীফ –

আমি হলাম আমার পূর্বপুরুষ (পয়গম্বর) ইবরাহীম (আ:)-এর দোয়া এবং পয়গম্বর ঈসা (আ:)-এর প্রদত্ত শুভসংবাদ। (আমার ধরাধামে শুভাগমনের সময়) আমার মা তাঁর (পবিত্র দেহ মোবারক) হতে নূর (তথা আলো/জ্যোতি) প্রত্যক্ষ করেন যা শাম-দেশের অর্থাৎ সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত করে। [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল]

শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী সাহেব ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের ঝং শহরের আউলিয়া-দরবেশ, আলেম-পণ্ডিত ও শিক্ষকদের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার হাতে খড়ি হয় ১২ বছর বয়সে, মাদ্রাসা আল-উলূম আল-শরীয়্যা নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি মদীনাতুল মুনাওয়ারায় মহানবী (দ:)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা:)-এর আশীর্বাদধন্য বসতঘরেই অবস্থিত। ড: কাদেরী তাঁর পিতা ও সে সময়কার প্রসিদ্ধ উলামাদের কাছে ইসলামবিষয়ক বিভিন্ন শাস্ত্র ও আরবী বিদ্যা শিক্ষা করেন। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তিনি সারা ইসলামী বিশ্ব ঘুরে বেড়ান; মক্কা মুয়াযযমা, মদীনা মুনাওয়ারা, সিরিয়া, বাগদাদ, লেবানন, মাগরেব তথা পশ্চিমাঞ্চল, ভারত ও পাকিস্তানে অনেক প্রখ্যাত আলেমের অধীনে তিনি ধর্মবিদ্যা শিক্ষা করেন; আর তাঁদের কাছ থেকে হাদীসশাস্ত্র ও অন্যান্য ইসলামী আধ্যাত্মিক জ্ঞানের শাস্ত্রে প্রায় ৫০০ এজাযত ও সনদ লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছে এজাযতের একটি নজিরবিহীন, অনন্য ও মহাসম্মানিত সনদ যা তাঁকে চারজন শিক্ষকের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে সাইয়্যেদুনা শায়খ আবদুল কাদের জিলানী আল-হাসানী ওয়াল হুসাইনী আল-বাগদাদী (রহ:)-এর পুত্র শায়খ আবদুর রাযযাক (রহ:)-এর সাথে, ‘ফুতুহাতে মক্কীয়্যা’ গ্রন্থপ্রণেতা শায়খুল আকবর মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী আল-দামেশকী (রহ:)-এর সাথে এবং মিসরীয় মহান হাদীসশাস্ত্র বিশারদ ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)-এর সাথেও। অপর একটি সনদ দ্বারা তিনি কেবল একজন শিক্ষকের মাধ্যমে ইমাম ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী (রহ:)-এর সাথে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর সনদগুলো তাঁরই দুইটি ‘সাবত’ তথা বিস্তারিত তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে: ‘আল-জওয়াহির আল-বাহিরা ফীল্ আসানিদ আত্ তাহিরা’ এবং ‘আল-সুবূল আল-ওয়াহাবিয়্যা ফীল্ আসানিদ আল-যাহাবিয়্যা’

শিক্ষা ক্ষেত্রে ড: কাদেরী সাহেব ১৯৭০ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক প্রথম শ্রেণি (সম্মান) সনদ লাভ করেন। ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ১৯৭২ সালে ইউনিভার্সিটি গোল্ড মেডাল-সহ এম,এ, এবং ১৯৭৪ সালে এল,এল,বি, পাশ করার পর তিনি ঝং জেলা কোর্টে আইন পেশার সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯৭৮ সালে লাহোরে চলে আসেন এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষকের পদে যোগ দেন; আর ইসলামী আইনশাস্তে তাঁর ডক্টরেট-ও সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে তাঁকে ইসলামী আইন বিভাগে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয় এবং তিনি এল,এল,এম, পর্যায়ে ইসলামী আইন প্রণয়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ড: তাহিরুল কাদেরী সাহেব পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের এপেলেট শরীয়াহ বেঞ্চের আইনি উপদেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইসলামী পাঠ্যক্রম উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা পদেও দায়িত্ব পালন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ইসলামী আইনজ্ঞ ও পণ্ডিতের সু্খ্যাতি অর্জন করেন এবং ইসলামী বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমে দ্বীন হিসেবে পরিচিতি পান। অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা, গবেষক ও সুবক্তা ড: কাদেরী সাহেব প্রায় এক সহস্র পুস্তক প্রণয়ন করেছেন, যার মধ্যে চার’শ পঞ্চাশটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে; আর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আরবী, উর্দূ ও ইংরেজি ভাষায় ছয় সহস্রাধিক প্রভাষণও প্রদান করেছেন।

ইসলামের নামে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও সন্ত্রাসবাদের মতো জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ড: তাহিরুল কাদেরী সাহেব একটি ঐতিহাসিক ফতোওয়া জারি করেন। এটাকে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়, কেননা এ-ই প্রথমবার যখন সন্ত্রাসের হোতাদের বিরুদ্ধে এধরনের একটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ইসলামী ডিক্রী তথা ফতোওয়া এতো ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। ছয়’শ পৃষ্ঠাসম্বলিত মূল ফতোওয়াটি লেখা হয়েছিল উর্দূ ভাষায়, আর এতে বিধৃত হয়েছিল ব্যাপক গবেষণালব্ধ আল-কুরআনের বাণী, মহানবী (দ:)-এর হাদীস, আসহাব-এ-কেরাম (রা:)-এর মতামত ও বিশ্ববরেণ্য ইসলামী পণ্ডিতদের সর্বজনগৃহীত লেখনীসমূহ। এই ঐতিহাসিক গবেষণাকর্ম ইংরেজি ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে; অপরদিকে আরবী, নরওয়েজীয়, ড্যানিশ, হিন্দী ও অন্যান্য প্রধান প্রধান ভাষায় এর অনুবাদের কাজ চলছে। মিসরীয় জামেউল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী গবেষণা একাডেমী এই ফতোওয়ার ওপর একটি বিস্তারিত বিবরণ লিখেছে এবং এর প্রতিপাদন-ও করেছে।

ড: কাদেরী সাহেব মিনহাজুল কুরআন ইন্টারন্যাশানাল (এম,কিউ,আই) সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পদে দায়িত্বরত। এই সংস্থার শাখা ও সেন্টারগুলো বিশ্বের নব্বইটিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে আছে। শায়খ তাহিরুল কাদেরী সাহেব পাকিস্তানের লাহোর শহরে অবস্থিত মিনহাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ গভর্নরস্-এর সভাপতি; বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তানের সরকারি সনদপ্রাপ্ত। এছাড়াও তিনি মিনহাজ শিক্ষা সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা, যে সংস্থাটি পাকিস্তানে ছয় শতাধিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ড: কাদেরী মিনহাজ কল্যাণ ফাউন্ডেশনেরও সভাপতি; যে সংস্থাটি সারা বিশ্বে মানবিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

মুখবন্ধ

পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন মহানবী (দ:)-এর আশীর্বাদধন্য ও ঐতিহাসিক বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে খুশি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অভিব্যক্তি-ই হচ্ছে মওলিদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন। এটা এমনই এক প্রশংসনীয় আমল (ধর্মীয় অনুশীলন), যা দ্বারা এমন কি আবূ লাহাবের মতো একজন কাফের-ও উপকার পেয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদত উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করায় আবূ লাহাবের মতো কট্টরপন্থী কাফেরের শাস্তি যদি প্রতি সোমবার লাঘব করা হয়, তাহলে সেই (মু’মিন) মুসলমানের ক্ষেত্রে কী পুরস্কার বরাদ্দ রয়েছে যিনি সারা জীবন এই দিনটি উদযাপন করে আসছেন?

সৃষ্টির সেরা খোদ মহানবী (দ:)-ই নিজের বেলাদত দিবস সোমবারকে সম্মান করতেন। (আল্লাহর প্রতি) শুকরিয়া জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই দিনটিতে রোযা রাখতেন, কেননা এই দিনেই তিনি পৃথিবীবাসীর কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। এ কাজ করে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের খোদায়ী আদেশ-ই পালন করেছিলেন মাত্র, যেহেতু তাঁর সম্মানিত অস্তিত্বের উপলক্ষেই বিশ্বজগতের সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছিল।

মওলিদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন তাতে অংশগ্রহণকারীদের অন্তরে মহাসম্মানিত রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উৎসাহ যোগায়, যা অন্তরে (তাঁর সান্নিধ্য লাভের) আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি জাগ্রত করে। শরীয়ত অনুযায়ী তাঁর প্রতি সালাওয়াত পাঠের আমলটি ব্যাপক সওয়াবের উৎস, আর তাই উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মওলিদ’কে উপকারী আমল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

মীলাদের সমাবেশগুলো রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সীরাহ (জীবনী) মোবারকের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত ও তাঁর প্রতি ভালোবাসা নতুন করে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই কারণেই মওলিদের মাহফিলে অন্তর্ভুক্ত থাকে মহানবী (দ:)-এর নবুওয়্যতের অনুকরণীয় আদর্শ, তাঁরই গুণাবলী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মো’জেযাসমূহের তাযকেরা (স্মরণার্থে আলোচনা) এবং বিবরণ। মওলিদুন্নবী (দ:)-এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (দ:)-এর মহব্বত ও সান্নিধ্য অর্জন এবং প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সত্তা তথা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাথে তাঁদের আত্মিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ়ীকরণ। এটা আপনাআপনি-ই শরীয়তের মূল লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করে। তাঁর গুণাবলী ও পূর্ণতাকে স্বীকার করলে কারো অন্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি এবং রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালাতের প্রতি ঈমান মজবুত হয়। মহানবী (দ:)-কে সম্মান প্রদর্শন হচ্ছে ঈমানের সর্বপ্রথম মৌলিক প্রয়োজনীয় শর্ত।

মওলিদুন্নবী (দ:)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত খুশি, (আল্লাহ’র) যিকিরের মাহফিল অনুষ্ঠান ও মহানবী (দ:)-এর শানে না’ত-কসীদা-সেমা’ আবৃত্তি, এর পাশাপাশি মানুষের মাঝে খাবার পরিবেশন, এসব-ই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি পদ্ধতি। মহানবী (দ:)-কে আমাদের মাঝে প্রেরণ করে মহান আল্লাহতা’লা আমাদেরকে তাঁরই অশেষ, অফুরন্ত রহমত-বরকত-নেয়ামত (মানে আশীর্বাদ) লাভে হক্বদার করেছেন; আর তাই তিনি আমাদের এই সর্বাধিক সেরা পুরস্কারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আল্লাহতা’লা যেমন রমযান মাসকে কুরআন নাযেলের কারণে অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ করেছেন, ঠিক তেমনি রবিউল আউয়াল মাসটিও আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে এ মর্মে যে এই মাসে কুরআন মজীদ যিনি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, সেই মহান সত্তা এই ধরাধামে শুভাগমন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আশীর্বাদধন্য বেলাদত দ্বারাই এই মাসটি অন্যান্য সব মাসের চেয়ে অধিকতর পুণ্যময় হয়েছে।
বস্তুত যে রাতে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (দ:)-এর বেলাদত হয়, সেটা লাইলাতুল ক্বদরের রাতের চেয়েও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। লাইলাতুল ক্বদরে সর্বপ্রথম আল-কুরআন ও ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়। কিন্তু হুযূর পূর নূর (দ:), যাঁর অন্তরে আল-কুরআন নাযেল হয়, তিনি না হলে আমরা কোনো ঐশী শাস্ত্রলিপি পেতাম না, লাইলাতুল ক্বদর-ও পেতাম না, কিংবা খোদ দ্বীন ইসলাম-ও পেতাম না। এসব নেয়ামত হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমেই কেবল অর্জিত হয়েছে। অতএব, তাঁর বেলাদতের রাতটি লাইলাতুল ক্বদরের রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

আল্লাহতা’লা মানবজাতির প্রতি তাঁর অগণিত ও সীমাহীন রহমত-বরকত ও নেয়ামত দান করেছেন। এসব আশীর্বাদ অসংখ্য এবং এগুলো চিরকাল বর্ষিত হতে থাকবে। প্রতিটি নেয়ামত অপর যে কোনো নেয়ামতের মতোই বড়। এতদসত্ত্বেও সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা নিজের আশীর্বাদগুলো সম্পর্কে গর্ব করেন না। তিনি আমাদের স্বাদগ্রহণের জন্যে আহার্যের এক বিশাল তালিকা মঞ্জুর করেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর এই দান স্মরণ করেন না। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের পানীয় দ্রব্য দ্বারা সতেজ রেখেছেন, কিন্তু নিজের এই দান সম্পর্কে কোনো গর্ব তিনি করেন না। রাত ও দিনের আবর্তমান চক্রের সুবাদে আমাদের সময় সুনিয়ন্ত্রিত হওয়ার দরুন আমরা বিশ্রাম নিতে পারি এবং জীবনের নানা চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হই; আসমান, জমিন ও দরিয়া, এসব কিছুকেই আমাদের অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছে; আমাদেরকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা আল্লাহতা’লার সেরা সৃষ্টি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে এবং সম্মান ও মর্যাদা-ও মঞ্জুর করা হয়েছে, কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর এসব দান স্মরণ না। আমাদেরকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা আশীর্বাদধন্য করা হয়েছে; এই বিশ্বজগতের বিশাল ও বিস্তৃত প্রান্তসীমা হতে আরম্ভ করে আমাদের অন্তর্নিহিত সত্তার গভীরে এমন নেয়ামত আমাদের প্রতি মঞ্জুর করা হয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কের উপলব্ধিরও অতীত; অথচ বিশ্বজগতের প্রভু (’রাব্বুল ‘আলামীন’) হওয়া সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর এ অনুগ্রহ ও আশীর্বাদের গর্ব করেন না। তবে বিশ্বমানবতার জন্যে এমন এক আশীর্বাদ আল্লাহ পাক মঞ্জুর করেছেন, যাঁর খাতিরে তিনি প্রকাশ্য ও স্পষ্টভাবে নিজের করুণা, আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করেন। তিনি ঈমানদার মুসলমানদেরকে এব্যাপারে সচেতন করেছেন এই বলে:

“নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর (খোদার) আয়াতসমূহ পাঠ করেন, আর তাদেরকে কিতাব (আল-ক্বুরআন) ও হিকমত (ইসলামী আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শিক্ষা দান করেন, অথচ তারা (ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ) নিশ্চয় এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল” [আল-ক্বুরআন, ৩:১৬৪; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (রহ:) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

দ্বীন-ইসলামে আল্লাহতা’লার প্রতি তাঁরই প্রদত্ত আশীর্বাদের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা খেদমতের একটি নিদর্শন মাত্র। এর যৌক্তিকতা আল-ক্বুরআনে উল্লেখিত হয়েছে এভাবে –

“এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব্ব শুনিয়ে দিলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আরো অধিক দান করবো এবং যদি অকৃজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর” [আল-ক্বুরআন, ১৪:৭]।

এই আয়াতটি ব্যাখ্যা করে যে খোদাতা’লার নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ফলশ্রুতিতে আরো অতিরিক্ত আশীর্বাদ লাভ সম্ভব হয়। খোদায়ী নেয়ামতের প্রতি শুকরিয়া আদায় করাটা এই উম্মতের জন্যে খাস বা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং এটা পূর্ববর্তী উম্মাতগুলোর প্রতিও আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বনূ ইসরাঈল (ইহুদী) সম্প্রদায় যে আশীর্বাদের কারণে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ওপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল এবং ফেরাউনের জুলুম-অত্যাচার হতে মুক্তি পেয়েছিল, সেটা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে:

“এবং স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদেরকে ফের‘আউনী সম্প্রদায় থেকে নিষ্কৃতি দান করেছি, যারা তোমাদেরকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিতো, তোমাদের পুত্রদেরকে যবেহ করতো আর তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এর মধ্যে তোমাদের রব্বের পক্ষ থেকে এক মহা ‘বালা’ নিহিত ছিল (অথবা ছিল এক মহা পুরস্কার)” [আল-ক্বুরআন, ২:৪৯]।
এই আয়াতে করীমা ব্যাখ্যা করে যে দাসত্ব থেকে মুক্তি এমনই এক মহা নেয়ামত যার দরুন এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যেও অত্যাবশ্যক হয়। এর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, কোনো জাতির মুক্তি অর্জন খোদাতা’লারই দানকৃত একটা উপহার যেটার শোকর-গুজারী করা বাধ্যতামূলক। এই আয়াতটি সাক্ষ্য দেয় এ বাস্তবতার যে, সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে খোদায়ী নেয়ামতের মূল্যায়ন ও খুশি উদযাপন করা জরুরি, যাতে পরবর্তীকালে আগত প্রজন্মগুলো এই আশীর্বাদের মূল্য অনুধাবন করতে পারে এবং এর গুরুত্ব-ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

মানুষ সাধারণতঃ সারা বছরই আল্লাহতা’লার আশীর্বাদগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে; তবুও সময়ের পরিক্রমণে সমগ্র উম্মাহকে আল্লাহর মঞ্জুরিকৃত কোনো তাৎপর্যপূর্ণ দিন আগমন করলে এর খুশির বহিঃপ্রকাশ আপনাআপনি সামষ্টিক উদযাপনে রূপ নেয়। কুরআন মজীদে বর্ণিত আছে যে বনূ ইসরাঈল বংশকে ফেরাউনের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার পর এবং নীল-নদের স্রোত পার হয়ে নিরাপদে সিনাই উপত্যকায় তাদের প্রবেশের পর তারা মারাত্মক গরম আবহাওয়া ও খরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, যার দরুন তাদেরকে ছায়া দেয়ার জন্যে মেঘ পাঠানো হয়। এটা এমন-ই এক আশীর্বাদ ছিল যে আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বিবৃত হয়:

“এবং (স্মরণ করো) আমি তোমাদের ওপর মেঘকে ছাউনি করেছি (তিহা উপত্যকায়), আর তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ ও ’সালওয়া’ অবতীর্ণ করেছি” [সূরা বাক্বারা, ৫৭ আয়াত]।

ক্বুরআন পাকের অনেক জায়গায় সুনির্দিষ্ট রহমত-বরকত সম্পর্কে উল্লেখ করার সময় (রহমত বর্ষণের) ওইসব দিনের স্মরণার্থে খুশি উদযাপন করার বিধান আল্লাহতা’লা জারি করেছেন। পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলীর অনুশীলিত রীতিও ছিল এটাই। পয়গম্বর ঈসা (আ:) তাঁর উম্মতের জন্যে আসমানী খাদ্য-খাঞ্চা প্রার্থনাকালে আরয করেন এভাবে:

“মরিয়ম-তনয় ঈসা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব্ব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে একটা খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের জন্যে ঈদ হবে – আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে; এবং আপনার কাছ থেকে (তা হবে) নিদর্শন” [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৪]।
পয়গম্বর ঈসা (আ:)-এর বাস্তব উদাহরণের আলোকে ক্বুরআন মজীদের এই আয়াতটিতে আমাদের সামেনে একটি স্পষ্ট ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে এই মর্মে যে, খোদায়ী নেয়ামত (মানে ঐশী আশীর্বাদ) যে দিনে অবতীর্ণ হয় সেদিনটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিবস হিসেবে উদযাপিত হওয়া উচিত। আয়াতটি আরো ইঙ্গিত করে যে কোনো নির্দিষ্ট আশীর্বাদপ্রাপ্তি উপলক্ষে খুশি প্রকাশ শুধু সেসব মানুষ-ই করে থাকেন, যাঁরা ওই আশীর্বাদ যে পয়গম্বর (আ:)-এর প্রতি মঞ্জুর হয়েছে তাঁর সাথে (আত্মিকভাবে) সংশ্লিষ্ট।

আল্লাহতা’লার নেয়ামতপ্রাপ্তির প্রতি খুশি প্রকাশের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সাধারণ পদ্ধতি হলো, অন্য সবার সামনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার আশীর্বাদগুলোর বিবরণ প্রদান করা। তাঁর প্রতি এভাবে শুকরিয়া জানানো কুরআন মজীদ হতেও প্রমাণিত, যেমনটি এরশাদ হয়েছে:

“এবং আপন রব্বের নি’মাতের খুব চর্চা করুন (হে রাসূল)!” [আল-কুরআন, ৯৩:১১]

প্রথমে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার দানকৃত নেয়ামত ও আশীর্বাদ স্মরণের ব্যাপারে আজ্ঞা জারি হয়, যেক্ষেত্রে ওই আশীর্বাদকে অন্তর ও জিহ্বা দ্বারা স্মরণ করা চাই; কিন্তু এই স্মরণ অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লারই জন্যে নির্দিষ্ট। অতঃপর এই আশীর্বাদটি উল্লেখ করার বিধান দেয়া হয়েছে, যার দরুন কেউ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে এই আশীর্বাদ সম্পর্কে প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন এমনভাবে যাতে এর তাৎপর্য মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এই স্মরণ (যিকর) একদিকে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার সাথে সংশ্লিষ্ট,অপরদিকে তা উল্লেখ করা (তাযকেরা) সৃষ্টির সাথে সংশ্লিষ্ট, যাতে অনেক মানুষ এই স্মরণ করার কাজে ব্যাপৃত হতে পারে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

“সুতরাং আমার স্মরণ করো, আমিও তোমাদের চর্চা করবো, আর আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো এবং আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” [সূরা বাক্বারা, ১৫২ আয়াত]

আরেক কথায়, তোমরা আমার নেয়ামতগুলো (ব্যক্তি পর্যায়ে) স্মরণ করো না, বরঞ্চ এমন কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক পরিবেশে তা উল্লেখ করো যার দরুন মানুষেরাও তা শোনতে পায় এবং জানতে পারে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বাড়তি পন্থা হচ্ছে ঈদের আকারে খুশি উদযাপন করা। পূর্ববর্তী উম্মতগুলো যেদিনটিতে কোনো বিশেষ নেয়ামত লাভ করতেন, সেদিনটি তারা ঈদ হিসেবে উদযাপন করতেন। কুরআন মজীদ হযরত ঈসা (আ:)-এর দোয়া সম্পর্কে বর্ণনা দেয় এভাবে:

“মরিয়ম-তনয় ঈসা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব্ব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে একটা খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের জন্যে ঈদ হবে – আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে; এবং আপনার কাছ থেকে (তা হবে) নিদর্শন” [আল-ক্বুরআন, ৫:১১৪]।
এ আয়াতে খাদ্য-খাঞ্চার মতো একটি অস্থায়ী আশীর্বাদ লাভকে ঈদের দিন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কি আজো খৃষ্টান সম্প্রদায় রোববারকে অশীর্বাদপ্রাপ্তির দিন হিসেবে পালন করে থাকেন। খাদ্য-খাঞ্চা প্রেরণের আশীর্বাদ কি কোনো পয়গম্বর প্রেরণের নেয়ামতের সমতুল্য? ওই ধরনের অগণিত আশীর্বাদ-ই তো আমাদের মহাসম্মানিত রহমত (করুণা) ও আশীর্বাদ হযরতে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের খাতিরে বিসর্জন দেয়া যেতে পারে।

সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহুদী একবার হযরত উমর ফারূক (রা:)-কে বলেন যে আল-কুরআনের [“আজ তোমাদের দ্বীন (ধর্ম)-কে তোমাদেরই জন্যে পূর্ণ করলাম”] আয়াতটি যদি তৌরাতে প্রকাশিত হতো, তাহলে ইহুদী সম্প্রদায় ওই দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতো। হযরত উমর (রা:) এ কথার উত্তরে বলেন যে আয়াতটি কোন্ দিনে এবং কোথায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা তাঁর স্মরণে আছে: সেটা ছিল আরাফাতের ময়দানে হজ্জ্বের দিন, অধিকন্তু শুক্রবার (উভয় দিন-ই ঈদস্বরূপ)। [আল-বুখারী কৃত সহীহ; কিতাবুল ঈমান, ‘ঈমানের বৃদ্ধি ও হ্রাস’ অধ্যায়, ১:২৫ #৪৫; মুসলিম কৃত সহীহ: কিতাব আল-তাফসীর, ৪:২৩১৩ #৩০১৭; আল-তিরমিযী প্রণীত আল-জামিউস্ সহীহ: আবওয়াব তাফসীর আল-কুরআন (কুরআন তাফসীরের অধ্যায়গুলো), অধ্যায়: ‘সূরা আল-মা’য়েদা’, ৫:২৫০ #৩০৪৩; এবং আল-নাসাঈ রচিত আল-সুনান: কিতাব আল-ঈমান, ‘ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি’ অধ্যায়, ৮:১১৪ #৫০১২]

একটি প্রশ্ন: যদি ধর্মকে পূর্ণতাদানের বাণী বহনকারী আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হওয়ার দিনটি ঈদ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তাহলে মানবতার চূড়ান্ত কল্যাণকারী যেদিন ধরাধামে শুভাগমন করেন সেদিনটি কেন ঈদ হিসেবে পরিগণিত হবে না? এই জিজ্ঞাসা শুক্রবার দিনের মর্যাদাময় বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের চিন্তার খোরাকও যোগায়।

মহানবী (দ:)-এর হাদীস শরীফেও উল্লেখিত হয়েছে যে তিনি তাঁর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন দিবস উদযাপন উপলক্ষে ছাগল কুরবানী করতেন এবং এর গোস্ত অতিথিদের মাঝে বিতরণ করতেন। হযরত আনাস (রা:)-এর মতানুযায়ী, আম্বিয়াকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর নবুওয়্যত ঘোষণার পর আকীকা (নবজাতক শিশুর জন্যে কৃত পশু কুরবানী) পালন করেন। ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (৮৪৯-৯১১ হিজরী সাল) এই রেওয়ায়াতটিকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রদর্শন করে যুক্তির অবতারণা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব হুযূরে পাকের (দ:) বেলাদতের সপ্তম দিনে তাঁর আকীকা পালন করেছিলেন, আর আকীকা জীবনে একবার পালন করাই আবশ্যকীয়। অতএব, এটা স্পষ্ট যে মহানবী (দ:)-এর আমলটি আকীকা ছিল না, বরঞ্চ তা ছিল আতিথেয়তা যা তিনি তাঁরই বেলাদতের স্মরণে পালন করেছিলেন। [এই গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]
রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো খোদায়ী আশীর্বাদ কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। এ উপলক্ষে যে স্পষ্ট আনন্দ ও সুখ ব্যক্ত হয়েছে, তা ঐতিহাসিক বিবরণসমূহ হতে জানা যায়। নবুওয়্যতের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যবিষয়ক বইপত্রে এমন প্রচুর উদাহরণ বিদ্যমান, যেখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর মাহবূব (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ ও সুখ অনুভব করেন।

মা আমিনা (রা:) তাঁর প্রিয় পুত্রের বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের সাথে সম্পর্কিত (অলৌকিক) ঘটনাবলীর ব্যাপারে বলেন:

সৃষ্টিকুল শিরোমণি প্রিয়নবী (দ:)-এর বেলাদত হলে তাঁর সাথে একটি নূর (জ্যোতি) এমনভাবে বিচ্ছুরিত হয়, যার দরুন পূর্ব হতে পশ্চিমে যা কিছু ছিল সবই আলোকিত হয়ে যায়। [সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বাত আল-কুবরা’, ১:১০২; ইবনে জাওযী প্রণীত ‘সাফওয়া আল-সাফওয়া’, ১:৫২; ইবনে আসাকির রচিত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ৩:৪৬; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-বেদায়া ওয়াল-নেহায়া’, ২:২৬৪; ইবনে রাজাব হাম্বলী কৃত ‘লাতা’ঈফ আল-মা’আরিফ ফীমা’য়া লি-মাওয়াসিম আল-’আম মিন আল-ওয়াযা’ঈফ’, ১৭২ পৃষ্ঠা; আল-সৈয়ুতী প্রণীত ‘কেফা’য়াত আল-তা’লিব আল-লাবীব ফী খাসা’ইস আল-হাবীব’, ১:৭৯; এবং আল-হালাবী রচিত ‘ইনসা’ন আল-’উয়ূন ফী সীরা আল-আমীন আল-মা’মূন’, ১:৮৩]

অন্য এক রেওয়ায়াতে (বিবরণে) মা আমিনা (রা:) নিজের জিসম মোবারক হতে এমন এক নূর বিচ্ছুরণের কথা উল্লেখ করেন, যার দরুন তিনি শাম দেশের বসরায় (বর্তমান ইরাকে) অবস্থিত প্রাসাদগুলো ও বাজার এলাকাগুলো প্রত্যক্ষ করেন; এমন কী তিনি সেখানে চলাচলকারী উটগুলোর গলাও দেখতে পান। [ইবনে সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বাত আল-কুবরা’, ১:১০২; আল-তাবারানী প্রণীত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ২৪:২১৪ #৫৪৫; ইবনে হিব্বান রচিত ‘আল-সহীহ’, ১৪:৩১৩ #৬৪০৪; আবদুর রাযযাক্ক লিখিত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:৩১৮; আল-দারিমী কৃত ‘আল-সুনান’, ১:২০ #১৩; আল-শায়বানী প্রণীত ‘আল-আহা’দ ওয়াল মাসা’নী’, ৩:৫৬ #১৩৬৯; আল-হাকীম রচিত ‘আল-মুস্তাদরাক’, ২:৬৭৩ #৪২৩০; আল-হায়সামী নিজ ‘মজমা’ আল-যওয়াঈদ’ (৮:২২২) গ্রন্থে জানান যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও আল-তাবারানী এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, আর ইমাম আহমদের বর্ণনার সনদ হচ্ছে হাসান সহীহ; আল-হায়সামী লিখিত ‘মাওয়া’রিদ আল-যামা’ন ইলা’ যাওয়া’ঈদ ইবনে হিব্বা’ন’, ৫১২ #২০৯৩; ইবনে এসহা’ক্ব রচিত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা, ১:৯৭ ও ১০৩; ইবনে হিশা’ম কৃত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ১৬০; ইবনে আসীর প্রণীত ‘আল-কা’মিল ফী আল-তা’রীখ’, ১:৪৫৯; আল-তাবারী লিখিত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল মুলূক’, ১:৪৫৫; ইবনে ’আসা’কির রচিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ১:১৭১-২; ইবনে ’আসা’কির কৃত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৩:৪৬৬ এবং ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ৩:৪৬; ইবনে কাসীর প্রণীত ‘আল-বেদা’য়া ওয়াল-নেহা’য়া’, ২:২৬৪ ও ২৭৫; ইবনে রাজাব হাম্বলী লিখিত ‘লাতা’ঈফ আল-মা’আরিফ ফীমা লি-মাওয়া’সিম আল-’আম মিন আল-ওয়াযা’ঈফ’, ১৭৩ পৃষ্ঠা; আল-সৈয়ূতী রচিত ‘কেফা’য়াত আল-তা’লিব আল-লাবীব ফী খাসা’ইস আল-হাবীব’, ১:৭৮; আল-হালাবী কৃত ‘ইনসা’ন আল-’উয়ূন ফী সীরা আল-আমীন আল-মা’মূন’, ১:৮৩; এবং আহমদ বিন যাইনী দাহলা’ন মক্কী প্রণীত ‘আল-সীরা আল-নববীয়্যা’, ১:৪৬]

মুহাদ্দেসীন উলামাবৃন্দ (হাদীসশাস্ত্র বিশারদমণ্ডলী) ‘আশূরা’-এর হাদীসগুলোর সাহায্যে মওলিদুন্নবী (দ:) উদযাপনের বৈধতা প্রমাণ করেছেন। ‘এয়াওমে আশূরা’ ইহুদী সম্প্রদায় পালন করে থাকেন। এই দিনটিতে পয়গম্বর মূসা (আ:) ও বনূ ইসরাঈল (ইহুদী সম্প্রদায়) ফেরাউনের উৎপীড়ন হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। ফলে এটা তাঁদের স্বাধীনতা/মুক্তি দিবস, যা তাঁরা নিজেদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা রেখে উদযাপন করতেন। (মদীনায়) হিজরতের পরে মহানবী (দ:) মদীনাবাসী ইহুদীদের দ্বারা এই প্রথা অনুশীলিত হতে দেখে বলেন, “আমি তাদের চেয়ে পয়গম্বর মূসা (আ:)-এর আরো ঘনিষ্ঠ (পয়গম্বর হওয়ার সূত্রে)।” এমতাবস্থায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (দ:)-ও ‘এয়াওমে আশূরা’তে রোযা রাখা আরম্ভ করেন এবং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কেও তা অনুসরণ করতে আদেশ করেন। [আল-বুখা’রী কর্তৃক নিজ ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণিত: কিতা’বুস্ সওম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওমে আশূরা’র রোযা’ অধ্যায়, ২:৭০৪ #১৯০০; আল-বুখারী লিখিত ‘সহীহ’: কিতাবুল আম্বিয়া (পয়গম্বরবৃন্দের বই), ‘আল্লাহর বাণী: মূসা (আ:)-এর সংবাদ কি তোমাদের কাছে পৌঁছেছে?’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৪৪ #৩২১৬; আল-বুখারী কৃত ‘সহীহ’: কিতা’ব ফাযা’ইল আল-সাহা’বা (সাহাবাবৃন্দের সৎ গুণাবলীর বই), ‘মহানবী (দ:) মদীনায় তাশরীফ নিলে ইহুদীদের তাঁর কাছে আগমন’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১৪৩৪ #৩৭২৭; মুসলিম রচিত ‘সহীহ’: কিতা’ব আল-সিয়্যা’ম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ অধ্যায়, ২:৭৯৫-৬ #১১৩০; আবূ দাউদ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-সওম (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৩২৬ #২৪৪৪; ইবনে মা’জাহ রচিত কৃত ‘আল-সুনান: কিতাব আল-সিয়্যা’ম’ (রোযা-সংক্রান্ত বই), ‘এয়াওম আল-আশূরা’র রোযা’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৫৫২ #১৭৩৪; আহমদ ইবনে হাম্বল লিখিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯১ ও ৩৩৬ #২৬৪৪ ও ৩১১২; এবং আবূ এয়া’লা প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:৪৪১ #২৫৬৭]   

এ বিষয়ে অসংখ্য বর্ণনা বিদ্যমান, যা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে ইহুদীরা যদি তাদের পয়গম্বর (মূসা আলাইহিস্ সালাম)-এর বিজয় ও মুক্তিতে খুশি প্রকাশ করতে পারেন, তাহলে মুসলমান হিসেবে আমাদেরও মওলিদুন্নবী (দ:)-এর ব্যাপারে একই রকমের অনুভূতি প্রকাশ করা চাই, আর তা এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিশ্বজগতের প্রতি খোদায়ী রহমত, অর্থাৎ, ঐশী করুণা (বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বিশ্বমানবতাকে অত্যাচার-অবিচার ও অন্যায় হতে মুক্তি দিতে ধরাধামে শুভাগমন করেছিলেন এই বিশেষ দিনে, যেমনটি আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

“আর (তিনি) তাদের ওপর থেকে (তাদেরই অবাধ্যতাজনিত) ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলার শৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিল, তা নামিয়ে অপসারণ করবেন।” [আল-কুরআন, ৭:১৫৭]  

পরিশেষে, মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের মাস সমাগত হলে কোনো ঈমানদার মুসলমানের কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় নেয়ামত (আশীর্বাদ) আর কী-ই বা হতে পারে, যখন তিনি অনুভব করেন এর তুলনায় অন্য যে কোনো সুখ একেবারেই অর্থহীন? প্রকৃত সুখ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশের মাঝে নিহিত। আমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো এর চেয়ে কম তাৎপর্যপূর্ণ আশীর্বাদপ্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞতা ও খুশি প্রকাশ করতে বাধিত হয়েছিলেন, যে নেয়ামতগুলো ছিল কোনো বিশেষ স্থান বা কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে, এই অনন্ত, অফুরন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত তথা সর্বাধিক মহিমান্বিত রাসূল (দ:)-এর ধরণীতলে শুভাগমন হচ্ছে সবার জন্যে (ঐশী) করুণা ও কল্যাণের অবিরাম উৎস। অতএব, মুসলমানদেরকে এ উপলক্ষে আবেগ ও খুশির বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি অসীম কৃতজ্ঞতার প্রতিভূ-ও হতে হবে।

আল-কুরআন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় মানবজাতিকে তাদের প্রতি বর্ষিত আল্লাহতা’লার (খাস্) রহমত (করুণা), বরকত (আশীর্বাদ) ও দয়া তথা মহানবী (দ:)-কে শ্রদ্ধা ও সম্মান করার নির্দেশ দেয়, যিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত আচ্ছন্নকারী অন্ধকার দূর করেন এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও পশুত্বর দেয়াল যা মানুষকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছিল, তা ভেঙ্গে চৌচির করে দেন। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:

“এবং নিজেদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, যখন তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ছিল; তিনি তোমাদের অন্তরগুলোতে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁরই অনুগ্রহক্রমে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছো।” [আল-কুরআন, ৩:১০৩]   

এই ভগ্ন হৃদয়সমূহের জোড়া লাগানোর এবং বিশ্বমানবের সৌভ্রাতৃত্ব অর্জনের চমৎকার নজির ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। অতএব, মহান আল্লাহর মনোনীত জনের ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন ও আল্লাহর প্রতি ঋণী হওয়ার অনুভূতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা অন্য যে কোনো অর্জন বা প্রাপ্তির চেয়ে উম্মাহ’র জন্যে বেশি বাধ্যতামূলক হয়েছে।

মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী


by

Tags: