শেফা শরীফ
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁকে নিজের পাশে জায়গা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কৃত শপথ
আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “চাশত্ (সূর্যোদয়ের পরের সময়)-এর শপথ; এবং রাতেরও, যখন (তা)পর্দাবৃত করে; আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং অপছন্দও করেননি। এবংনিশ্চয় পরবর্তী জীবন আপনার জন্যে পূর্ববর্তী জীবনের চেয়ে ভালো। এবং নিশ্চয় অচিরে আপনারপ্রতিপালক আপনাকে এ পরিমাণ দেবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। তিনি কি আপনাকে এতিমপাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। এবং আপনাকে তাঁরই প্রেমে আত্মহারা পেয়েছেন এবং তাঁরদিকে পথ দেখিয়েছেন। এবং আপনাকে অভাবগ্রস্ত পেয়েছেন, অতঃপর ধনী করে দিয়েছেন।সুতরাং এতিমের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না; এবং ভিক্ষুককে ধমকাবেন না। এবং আপনারপ্রতিপালকের নেয়ামত (আশীর্বাদ)-এর ঘোষণা দিতে থাকুন” [সূরা দোহা, ১-১১ আয়াত, তাফসীরে কানযুল ঈমান]। এ সূরাটির অবতীর্ণ হওয়ার কারণ নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে এটা এমনই এক সময় নাযেল হয় যখন মহানবী (দ:) কোনো একটা বিষয় নিয়ে পীড়িত হওয়ার দরুন রাত জেগে এবাদত করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং একজন নির্দিষ্ট স্ত্রীলোক এ ব্যাপারে নানান কথা বলছিল [জুনদুব হতে বর্ণনা করেন ইমাম মুসলিম ও আল-বোখারী। আল-হাকীম নিশাপুরী বলেন যে স্ত্রীলোকটি আবূ লাহাবের পত্নী ছিল]। এ কথাও বলা হয়েছে যে আয়াত নাযেলে কিছুদিন বিরতির কারণে মক্কার মূর্তি পূজারীরা সমালোচনা করার ফলে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় [মুসলিম ও তিরমিযী শরীফে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে]।
সে যা-ই হোক না কেন, এই বিষয়টি সুস্পষ্ট যে আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-কে কী রকম মর্যাদা দেন, তাঁর প্রশংসা করেন এবং তাঁকে মহাসম্মান করেন, এ সূরাটি তারই একটি নির্ভর-পত্র এবং ছয়টি পন্থায় এটা তা পরিস্ফুট করে।
প্রথমতঃ তাঁর অবস্থা ইঙ্গিত করার জন্যে কোনো কিছুর নামে শপথ করতে আল্লাহ বলেন, “চাশতের শপথ; এবং রাতেরও, যখন তা পর্দাবৃত করে”, অর্থাৎ, পূর্বাহ্নের (সূর্যোদয়ের পরের সময়) মালিকের শপথ। এটা তাঁকে সম্মানিত করার সর্বোচ্চ পর্যায়।
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর সাথে তাঁর উচ্চ মকাম (মর্যাদা) ও তাঁর প্রতি বর্ষিত নেয়ামত পরিস্ফুট করতে আল্লাহ বলেন, “আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং অপছন্দও করেননি।” অর্থাৎ, তিনি আপনাকে ছেড়ে চলে যাননি এবং আপনাকে ঘৃণাও করেননি। এ কথা বলা হয়েছে যে এর মানে ‘আপনাকে পছন্দ করে নেয়ার পর তিনি আপনার প্রতি অবহেলা করেন না এবং আপনাকে ঘৃণাও করেন না।’
তৃতীয়তঃ “নিশ্চয় পরবর্তী জীবন আপনার জন্যে পূর্ববর্তী জীবনের চেয়ে ভালো” – খোদায়ী এ কালামের ব্যবহার সম্পর্কে ইবনে এসহাক বলেন, “এর অর্থ হলো আপনার বেসাল (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্তি এ জগতে আপনাকে তাঁর (খোদার) দেয়া সম্মান হতে অনেক উত্তম।” সাহল্ আত্ তুসতরী বলেন যে এর মানে হলো এ জগতে মহানবী (দ:)-কে প্রদত্ত আল্লাহতা’লার আশীর্বাদ অপেক্ষা তাঁর জন্যে (পরকালে) মওজুদ ‘শাফায়াতে কুবরা’ (সুপারিশের সর্বময় ক্ষমতা) ও ‘মাকামে মাহমূদ’ (সর্বোচ্চ মর্যাদা) অনেক বেশি ভালো।
চতুর্থতঃ আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আপনার প্রতিপালক আপনাকে এ পরিমাণ দেবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হবেন” (সূরা দোহা)। এই আয়াতে সম্মানের সাথে (ইহ ও পরকাল) উভয় জগতের সুখ-শান্তির সমন্বয় ঘটেছে। ইবনে এসহাক বলেন, “খোদাতা’লা রাসূলে করীম (দ:)-কে এ জগতে স্বস্তি দ্বারা এবং পরবর্তী জগতে পুরস্কার দ্বারা সন্তুষ্ট করবেন।” এ কথা বলা হয়েছে যে তাঁকে খোদাতা’লা হাউযে কাউসার ও শাফায়াত দান করবেন। বর্ণিত আছে যে মহানবী (দ:)-এর পরিবারভুক্ত জনৈক আত্মীয় বলেন, “আল-কুরআনে এর চেয়ে আশাব্যঞ্জক আর কোনো আয়াতে করীমা নেই। রাসূলুল্লাহ (দ:) সন্তুষ্ট হবেন না, যদি তাঁর উম্মতের কেউ জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করে” (আবূ নুয়াইম বর্ণিত ‘মওকুফ’ ও আদ্ দায়লামী কৃত ‘মুসনাদ আল-ফেরদৌস’ গ্রন্থে বর্ণিত ‘মরফু’ পর্যায়ের রেওয়ায়াত)।
পঞ্চমতঃ সূরাটির বাকি অংশে আল্লাহতা’লা তাঁকে যে নেয়ামত তথা আশীর্বাদ দান করেছেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হেদায়াত তথা তাঁর দ্বারা মানুষকে সত্য-সঠিক পথপ্রদর্শন; তাফসীরের ওপর নির্ভর করে (প্রতিভাত হয়) মহানবী (দ:)-এর কোনো সম্পত্তি ছিল না, আল্লাহ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছেন, কিংবা তাঁর অন্তরকে সন্তুষ্টি ও সমৃদ্ধি দ্বারা ধন্য করেছেন; তিনি এতিম ছিলেন এবং তাঁর চাচা তাঁকে দেখাশোনা করেছেন ও যত্ন নিয়েছেন এবং তাঁর কাছে মহানবী (দ:) আশ্রয় পেয়েছেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে তিনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন এবং তাঁর এতিম হওয়ার অর্থ হলো এই যে, তাঁর মতো আর কেউই নেই, তাই তাঁকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে এ সকল আয়াতের অর্থ, “আমি কি আপনাকে পছন্দ করে নেই নি এবং পথহারাদেরকে আপনার দ্বারা হেদায়াত দেই নি, গরিবদেরকে আপনার দ্বারা সমৃদ্ধ করি নি, এবং এতিমদেরকে আপনার দ্বারা আশ্রয় দেই নি?” আল্লাহতা’লা তাঁকে এ সকল নেয়ামত সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এটা ভলোভাবে জ্ঞাত যে মহানবী (দ:) যখন অল্প বয়স্ক ও এতিম ছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে অবহেলা করেননি। তিনি তাঁকে পরিত্যাগ করেননি, ঘৃণাও করেননি। এমতাবস্থায় নবুওয়্যত (প্রকাশ্যভাবে) দান করার পরে আল্লাহ কীভাবে তাঁকে অবহেলা বা ঘৃণা করতে পারেন?
ষষ্ঠতঃ মহানবী (দ:)-কে প্রদত্ত আল্লাহর নেয়ামত-প্রাপ্তিতে শোকর-গুজার (কৃতজ্ঞ) হওয়া এবং তা প্রকাশ করার জন্যে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “আপনার প্রতিপালকের নেয়ামত তথা আশীর্বাদের ঘোষণা দিতে থাকুন” [সূরা দোহা]। এটা করতে তাঁকে খাস তথা নির্দিষ্টভাবে এবং তাঁর উম্মতকে সার্বিকভাবে আদেশ করা হয়েছে।
আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “ওই প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্র মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এরশপথ, যখন তিনি মে’রাজ থেকে অবতরণ করেন; তোমাদের সাহিব (হুযূর পাক) না পথভ্রষ্টহয়েছেন, না বিপথে চলেছেন। এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না, কেবল ওহীব্যতিরেকে, যা তাঁর প্রতি নাযেল করা হয়েছে। তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী,শক্তিমান। অতঃপর ওই জ্যোতি ইচ্ছা করলেন; আর তিনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন।অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো; আর খুব (কাছে) নেমে এলো। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এইমাহবুবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইলো; বরং তদপেক্ষাও কম দূরত্ব রইলো। এমতাবস্থায় ঐশীপ্রত্যাদেশ দিলেন আপন বান্দা (হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি যা ওহী দেয়ারছিল। তাঁর অন্তর মিথ্যে বলেনি যা দেখেছে। তবে কি তোমরা তাঁর সাথে তিনি যা দেখেছেন তা নিয়েবিতর্ক করছো? এবং তিনি তো ওই জ্যোতি দু’বার দেখেছেন; সিদরাতুল মোনতাহার কাছে। সেটারকাছে রয়েছে ‘জান্নাতুল মাওয়া’। যখন সিদরার ওপর আচ্ছন্ন করছিল যা আচ্ছন্ন করার ছিল; চক্ষুনা কোনো দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় আপন প্রতিপালকের বহু বড় নিদর্শনতিনি দেখেছেন।” [সূরা নাজম, ১-১৮ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]
তাফসীরবিদ উলামাবৃন্দ আয়াতোক্ত ‘নক্ষত্র’ শব্দটি নিয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কেউ কেউ বলেন, শব্দটির স্বাভাবিক উপলব্ধি অনুযায়ী এটা একটা নক্ষত্র। কেউ কেউ বলেন, এটা আল-কুরআন। জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ বলেন যে এতে মহানবী (দ;)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে এবং এটা তাঁরই অন্তর মোবারক। বুযূর্গানে দ্বীন একইভাবে বলেন, “শপথ আসমানের এবং রাতে আগমনকারীর; এবং আপনি কি কিছুজেনেছেন, সে–ই রাতে আগমনকারী কী? (তা হচ্ছে) অত্যন্ত উজ্জ্বল তারকা” [সূরা তারিক, ১-৩ আয়াত] – এ আয়াতে করীমায় উল্লেখিত নক্ষত্র হলেন হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
এসব আয়াতে করীমা মহানবী (দ:)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ব্যাপকভাবে পরিস্ফুট করে। মহানবী (দ:)-এর হেদায়াত (পথপ্রদর্শন), তাঁর খামখেয়ালিশূন্যতা ও তাঁরই তেলাওয়াতকৃত বিষয়ের প্রতি তাঁর সত্যবাদিতা সম্পর্কে আল্লাহতা’লা শপথ দ্বারা সমর্থন যুগিয়েছেন। এটা এমনই এক ঐশী বাণী যা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে হযরত জিবরীল (আ:)-এর মাধ্যমে, যিনি শক্তিশালী। অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁর (রাসূলের) শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সমর্থন করেছেন তাঁরই মে’রাজ রাতের ভ্রমণের ঘটনা বর্ণনা করে, যা’তে তিনি সিদরাতুল মোনতাহায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি দ্বারা দর্শন করেছিলেন এমনই এক বিষয় যা ছিল তাঁর প্রভুর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এ ঘটনা সম্পর্কে সূরা বনী ইসরাঈলের প্রারম্ভে আরো বিশদ জানিয়েছেন।
আল্লাহতা’লা তাঁর অদৃশ্য জগত (জাবারূত) সম্পর্কে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কাছে যা প্রকাশ করেছেন এবং ফেরেশতাদের জগত (মালাকুত)-এর অত্যাশ্চর্য যা তিনি দেখেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং তা মানব মস্তিষ্কের পক্ষে যৎসামান্য উপলব্ধি করাও অসম্ভব। আল্লাহ এটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন, যার দ্বারা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি তাঁর সুউচ্চ শ্রদ্ধাবোধ প্রতিভাত হয়। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ঐশীপ্রত্যাদেশ দিলেন আপন হাবীবের (দ:) প্রতি, যা ওহী দেয়ার ছিল” [আল-কুরআন, ৫৩:১০]। অলঙ্কারবিদ্যা ও তর্কশাস্ত্রের (মানতেক) উলামাদের মতানুযায়ী এ ধরনের সম্বোধনকে সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ ইঙ্গিত বলা হয়। তাঁদের ভাষ্যানুযায়ী এটা হলো সবচেয়ে প্রাঞ্জল প্রকাশভঙ্গি।
আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আপন প্রতিপালকের বহু বড় নিদর্শন তিনি দেখেছেন” [আল-কুরআন, ৫৩:১৮]। যা প্রকাশিত হয়েছিল তা বিস্তারিত অনুধাবন করতে সাধারণ মস্তিষ্ক ব্যর্থ এবং সেই বড় নিদর্শনটি যে কী ছিল, তা বোঝার চেষ্টা করলে তাতে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হতে হবে।
এই আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা রাত্রি-ভ্রমণের (মে’রাজের) সময় মহানবী (দ:)-এর পরিপূর্ণ নির্মলতার এবং ক্ষতি থেকে তাঁর হেফাযতের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি নবী করীম (দ:)-এর অন্তর, জিহ্বা ও চোখ মোবারকের পবিত্রতাকে সমর্থন দিয়েছেন এ কথাগুলো বলে: “(তাঁর) অন্তর মিথ্যে বলেনি যাদেখেছেন”; “তিনি নিজ হতে কিছুই বলেন না”; “(তাঁর) চক্ষু না কোনো দিকে ফিরেছে, নাসীমাতিক্রম করেছে।” [আল-কুরআন, ৫৩: ১১, ৩, ১৭ যথাক্রমে]
আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “সুতরাং তারই শপথ যা প্রত্যাবর্তন করে, সোজা চলে, স্থিত থাকে, এবংরাতের (শপথ) যা পৃষ্ঠ প্রদান করে, আর প্রভাতের (শপথ), যখন শ্বাস গ্রহণ করে; নিশ্চয় এটাসম্মানিত প্রেরিতের বাণী, যিনি শক্তিশালী, আরশ–অধিপতির দরবারে সম্মানিত; সেখানে তারআদেশ পালন করা হয় যিনি আমানতদার (জিবরীল)। তোমাদের সাহিব (রাসূলে পাক) যিনিতোমাদের সাথে আছেন, তিনি পাগল নন, এবং নিশ্চয় তিনি তাঁকে আলোকিত প্রান্তে দেখলেন;এবং এ নবী (দ:) অদৃশ্য বিষয় বর্ণনা করার ব্যাপারে কৃপণ নন; এবং আল–কুরআন বিতাড়িতশয়তানের বাণী নয়” [সূরা তাকভীর, ১৫-২৫ আয়াত]।
উদ্ধৃত আয়াতে করীমার অর্থ হচ্ছে: আমি শপথ করছি যে এটা একজন মহান পয়গম্বরের বাণী – মহান তাঁর কাছে যিনি তাঁকে প্রেরণ করেছেন – তাঁর প্রতি অর্পিত ঐশী প্রত্যাদেশ প্রকাশ করার ক্ষমতাসম্পন্ন এক পয়গম্বর যিনি তাঁর প্রভুর কাছে নিজ মকাম ও মর্যাদাসহ নিরাপদ এবং দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত; যাঁকে আসমানে মান্য করা হয় এবং খোদায়ী কালামের ব্যাপারে বিশ্বাস করা হয়।
আলী ইবনে ঈসা রূমানী বলেন যে মহান পয়গম্বর হলেন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং তাই এসব গুণ তাঁরই। অন্যান্যরা বলেন যে জিবরীল (আ:)-কে এ আয়াতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, আর তাই এসব গুণ তাঁরই। “তিনি তাঁকে আলোকিত প্রান্তে দেখলেন” – এ আয়াতের অর্থ জিবরীল (আ:) রাসূলে খোদা (দ:)-কে দেখতে পেয়েছিলেন। এ কথা বলা হয়েছে যে এর অর্থ মহানবী (দ:) তাঁর প্রভু আল্লাহতা’লাকে দেখেছিলেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে মহানবী (দ:) জিবরীল (আ:)-কে তাঁর আসল চেহারায় দেখেছিলেন। একটি ভিন্ন বর্ণনা বিবৃত করে যে “কার্পণ্য” শব্দটির ব্যবহার দ্বারা বোঝায় মহানবী (দ:) গায়ব তথা অদৃশ্যকে সন্দেহ করেন না; অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে হুযূর পূল নূর (দ:) আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগীতে কার্পণ্য করেন না এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করার ক্ষেত্রেও কার্পণ্য করেন না। তবে সর্বসম্মতি হলো এ উদ্ধৃতিটি রাসূলুল্লাহ (দ:) সম্পর্কে।
আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “নূ–ন। কলম ও তাদের লেখার শপথ। আপনি আপনার প্রতিপালকেরঅনুগ্রহে উন্মাদ নন; এবং আপনার জন্যে অশেষ পুরস্কার রয়েছে; এবং নিশ্চয় মহা মর্যাদাপূর্ণ হলোআপনারই চরিত্র।” [সূরা কালাম, ১-৪ আয়াত]
এই মহা শপথ-বাক্য দ্বারা আল্লাহতা’লা নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে তাঁরই পছন্দকৃত পয়গম্বর (দ:)-এর প্রতি কাফেররা যা কিছু হিংসা-বিদ্বেষবশতঃ আরোপ করছে তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-কে প্রফুল্ল চিত্ত করেছেন এবং তাঁর আশা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন নম্রভাবে ঘোষণা করে এ কথা – “আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে উন্মাদ নন।” এতে সর্বাধিক সম্মান প্রতিভাত হয় এবং কথাবার্তায় আদবের সর্বাধিক মাত্রার দৃষ্টান্ত-ও বটে।
অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁকে জানিয়েছেন যে তাঁর কাছ থেকে মহানবী (দ:) অনন্ত নেয়ামত ও গণনার অতীত এক পুরস্কার পাবেন, যা তাঁকে কোনোভাবেই দেনাগ্রস্ত করবে না। এরশাদ হয়েছে – “আপনি নিশ্চয় পাবেন অশেষ পুরস্কার।” এরপর খোদাতা’লা তাঁকে প্রদত্ত উপহারগুলোর জন্যে তাঁর প্রশংসা করেছেন। তিনি মহানবী (দ:)-কে তাঁর দিকে পথপ্রদর্শন করেছেন এবং রাসূল (দ;)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলীকে সমর্থন দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মহা মর্যাদাসম্পন্ন হলো আপনার চরিত্র।” এ কথা বলা হয়েছে যে এই বাণী কুরআন-সম্পর্কিত (হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে; তিনি বলেন: “তাঁর চরিত্র হলো আল-কুরআন”)। এ কথা বলা হয়েছে যে এর অর্থ দ্বীন ইসলাম (হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত)। আর এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ হলো মহান স্বভাব। আরো কথিত আছে যে এর অর্থ হলো মহানবী (দ:)-এর আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
আল-ওয়াসিতী বলেন, “আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-কে যে নেয়ামত তথা আশীর্বাদ দ্বারা ধন্য করেছেন, তার সম্পূর্ণ স্বীকৃতির কারণে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাই তাঁকে সেই চরিত্রের ওপর গঠন করে আল্লাহ পাক তাঁকে সবার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন।”
সেই সূক্ষ্ম, মহানুভব, প্রশংসিত সত্তার প্রতি প্রশংসা জানাই, যিনি ভালো কাজ করাকে সহজ করে দিয়েছেন এবং যিনি মানুষজনকে সেদিকে হেদায়াত দিয়েছেন; আর যারা ভালো কাজ করে তাদের তিনি প্রশংসা করেন এবং পুরস্কৃত করেন। তাঁরই মহান শান! তাঁর আশীর্বাদ কতোই না অগণিত! তাঁর অনুগ্রহ-ও কতোই না বিস্তৃত!
অতঃপর আল্লাহতা’লা সূরাটিতে তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ দানকারীদের ব্যাপারে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তিনি তাদেরকে হুমকি দিয়েছেন এ বলে, “সুতরাংঅবিলম্বে আপনিও দেখতে পাবেন এবং তারাও দেখবে যে তোমাদের মধ্যে কে উন্মাদ ছিল। নিশ্চয়আপনার প্রতিপালক ভালোভাবে জানেন কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালোভাবেজানেন তাদেরকেও যারা সত্য পথে রয়েছে।” [সূরা কলম, ৫-৭ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]
মহানবী (দ:)-এর প্রশংসার পরে আল্লাহতা’লা তাঁর শত্রুদের সমালোচনা করেছেন, তাদের মন্দ চরিত্র উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং তাদের দোষত্রুটিগুলো গণনা করেছেন। এর বিপরীতে তিনি মহানবী (দ:)-কে প্রদত্ত নেয়ামত ও সাহায্যের কথা দ্বারা সমর্থন দিয়েছেন। তিনি দশটি সমালোচিত দোষের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁরই কালামে পাকে – “আপনি অস্বীকারকারীদের কথা মান্য করবেন না; তারা তো একামনায় রয়েছে যে কোনো মতে আপনি নমনীয় হোন, অতঃপর তারাও নমনীয় হবে। এবং কারোকথা মান্য করবেন না, যে বড় বড় শপথকারী, লাঞ্ছিত; খুব নিন্দুক, এদিকের কথা ওদিকে লাগিয়েবিচরণকারী; সৎ কাজে বড় বাধা প্রদানকারী; সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ; বদ মেজাজী; এসব কিছুওপরে অতিরিক্ত এই যে, তার মূলে ত্রুটি রয়েছে। তদুপরি, কিছু সম্পদ ও সন্তানের অধিকারী।যখন তার কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, “এ তো পূর্ববর্তীদেরকল্পকাহিনী।” [সূরা কলম, ৮-১৫ আয়াত]
আল্লাহতা’লা এসব কথার পরিসমাপ্তি টেনেছেন এই প্রকৃত হুমকি দ্বারা যে, তাদের শাস্তি সম্পূর্ণ হবে এবং তাদের ধ্বংস সামগ্রিক হবে; তিনি এরশাদ ফরমান: “অতি সত্বর আমি তার শুঁড়রূপী থুতনীর ওপর দাগদেবো” [সূরা কলম, ১৬ আয়াত]। হুযূর পূর নূর (দ:)-এর নিজেকে নিজের সাহায্য করা থেকে আল্লাহ তাঁকে যে সাহায্য করেছেন, তা আরো বেশি কার্যকর। হুযূর সৈয়্যদে আলম (দ:) যেভাবে শত্রুদেরকে হতবুদ্ধি করেছেন, তার চেয়েও বেশি কার্যকর হলো আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাদেরকে হতবুদ্ধি করার ব্যাপারটি।