শেফা শরীফ
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
পরিচ্ছেদ – ৮/ রাসূল (দ:)-এর প্রতি সালাওয়াত পাঠের জন্যে সৃষ্টিকুলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশএবং তাঁকে আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও তাঁরই অসীলায় শাস্তি মওকুফ করা
আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “এবং আল্লাহর কাজ এ নয় যে তাদেরকে শাস্তি দেবেন যতোক্ষণ পর্যন্তহে মাহবূব, আপনি তাদের মাঝে উপস্থিত থাকবেন” [আল-কুরআন, ৮:৩৩; তাফসীরে নূরুল এরফান]। অর্থাৎ, তিনি যতোদিন মক্কা মোয়াযযমায় থাকবেন, ততোদিন পর্যন্ত আল্লাহ শাস্তি দেবেন না। মহানবী (দ:) মক্কা শরীফ (হিজরতকালে) ত্যাগ করলে কতিপয় ঈমানদার তখনো ওখানে থেকে যান; এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা আয়াতে করীমা নাযেল করেন, “এবং আল্লাহ তাদেরকে শাস্তিদাতা নন, যতোক্ষণ তারাক্ষমা প্রার্থনারত থাকছে” [আল-কুরআন, ৮:৩৩]। ওপরের বাণীটি তাঁরই নিম্নোক্ত বাণীর মতো শোনায়:“যদি তারা পৃথক হয়ে যেতো, তবে অবশ্যই আমি তাদের মধ্য থেকে কাফিরদেরকে বেদনাদায়কশাস্তি দিতাম” [আল-কুরআন, ৪৮:৩৫]। এর আগে একই আয়াতে তিনি বলেন, “এবং যদি এমন না হতোযে কিছু সংখ্যক মুসলমান পুরুষ ও কিছু সংখ্যক মুসলমান নারী যাদের সম্পর্কে তোমরা অবগতনও” [৪৮:৩৫]।
ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ হিজরত করার পর আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হয় এ মর্মে, “আর তাদের(কাফেরদের) কী–ই বা আছে যে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না?” [আল-কুরআন, ৮:৩৪]। এসব আয়াতে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুউচ্চ মর্যাদার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। খোদায়ী শাস্তি মওকুফ হয় প্রথমতঃ তাঁর মক্কায় উপস্থিতির কারণে; অতঃপর তাঁরই সাহাবী (রা:)-দের উপস্থিতির কারণে দ্বিতীয় দফায় তা মওকুফ হয়। যখন আর কেউই মক্কায় অবশিষ্ট রইলেন না, তখন আল্লাহ মক্কার কাফেরদেরকে শাস্তি দেন ঈমানদারবৃন্দকে তাদের চেয়ে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এবং তাদের ওপর বিজয় দান করে। তিনি মুসলমানদের তরবারিকে কাফেরদের ওপর শাসন করার ক্ষমতা দান করেন; আর মুসলমানবৃন্দ তাদের জমি-জিরাত, বাড়িঘর ও সম্পদ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন [মানে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সবাই মুসলমান হয়ে যান – অনুবাদক]।
আবূ মূসা এই আয়াতটি আরেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; তিনি মহানবী (দ:)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: আল্লাহতা’লা আমার উম্মতের বেলায় আমাকে দুটো নিশ্চয়তা (গ্যারান্টী) দান করেছেন; প্রথমটি এই আয়াতে করীমা – ““এবং আল্লাহর কাজ এ নয় যে তাদেরকে শাস্তি দেবেন যতোক্ষণ পর্যন্ত হেমাহবূব, আপনি তাদের মাঝে উপস্থিত থাকবেন” [আল-কুরআন, ৮:৩৩; তাফসীরে নূরুল এরফান]। আর দ্বিতীয়টি অপর আয়াতে করীমা – “এবং আল্লাহ তাদেরকে শাস্তিদাতা নন, যতোক্ষণ তারা ক্ষমাপ্রার্থনারত থাকছে” [আল-কুরআন, ৮:৩৩]। [এটা একমাত্র ইমাম তিরমিযী (রহ:) বর্ণনা করেছেন (গরীব)]। এই রেওয়ায়াতটি আমাদেরকে আল্লাহতা’লার পাক কালামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান: “এবং আমি আপনাকে (হে রাসূল) সমগ্র জগতের জন্যে রহমত করে প্রেরণ করেছি”[আল-কুরআন, ২১:১০৭]।
মহানবী (দ:) বলেছিলেন “আমি আমার সাহাবাবৃন্দের বেলায় নিশ্চয়তা পেয়েছি” [আবূ মূসা হতে ইমাম মুসলিম]। কেউ কেউ বলেন এর মানে বেদআত তথা নতুন প্রবর্তিত প্রথা হতে রক্ষাপ্রাপ্ত হবার নিশ্চয়তা; আর কেউ কেউ বলেন এর মানে মতপার্থক্য ও বিশৃঙ্খলা হতে রক্ষাপ্রাপ্ত হবার নিশ্চয়তা। উলামা-এ-হক্কানীদের মধ্যে একজন বলেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা ছিলেন এবং তাঁর সুন্নাহ যতোদিন উপস্থিত (হাজির) আছে, ততোদিন পর্যন্ত তিনিও (শাস্তি মওকুফকারী হিসেবে) উপস্থিত আছেন। তাঁর সুন্নাহ বিস্মৃত হলে পরেই ক্লেশ ও বিশৃঙ্খলা আশঙ্কা করো।”
আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওইঅদৃশ্যবক্তা (নবী)’র প্রতি। ওহে ঈমানদার সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও খুব সালাম প্রেরণকরো।” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬]
আল্লাহ পাক তাঁর নবী (দ:)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রথমেই স্পষ্ট করেছেন স্বয়ং তাঁর প্রতি দরূদ-সালাম প্রেরণ করে; এরপর ফেরেশতাদের দ্বারা সালাওয়াত পাঠ করিয়ে; এবং তারপর বান্দাদেরকেও তাঁর প্রতি সালাত-সালাম পাঠ করতে আদেশ দিয়ে।
আবূ বকর ইবনে ফারূক বর্ণনা করেন যে “আমার চোখের স্বস্তি-শান্তি সালাতের মাঝে নিহিত”, মহানবী (দ:)-এর এই বাণীকে উলামা-এ-কেরামের মধ্যে কেউ একজন ব্যাখ্যা করেছেন এ অর্থে যে, এটা আল্লাহর (আয়াতোক্ত) আদেশের প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাকের, তাঁর ফেরেশতাকুলের ও উম্মতে মুহাম্মদীর সালাত-সালাম প্রেরণ, যা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত জারি থাকবে। ফেরেশতাকুল ও মনুষ্যজাতির সালাত-সালাম হচ্ছে রাসূল (দ:)-এর প্রতি অনুনয়, আর আল্লাহতা’লার জন্যে তা হচ্ছে মহানবী (দ:)-এর প্রতি করুণা বর্ষণ।
এ কথা বলা হয়েছে যে “তারা (ফেরেশতাকুল) সালাত প্রেরণ করেন”, আয়াতোক্ত এ বাক্যটির মানে তাঁরা‘বারাকা’ তথা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। তবে মহানবী (দ:) যখন মানুষদেরকে তাঁর প্রতি দরূদ-সালাম প্রেরণ শিক্ষা দেন, তখন তিনি ‘সালাত’ (প্রার্থনা) ও ‘বারাকা’ (আশীর্বাদ) শব্দগুলোর মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমরা পরে তাঁর প্রতি সালাতের অর্থ ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পাবো।
তাফসীরবিদদের কেউ একজন বলেন যে আল-কুরআনের সূরা মরিয়মে বর্ণিত “কাফ–হা–ইয়া–আঈন–সোয়াদ” (১৯:১) আয়াতটির ব্যাখ্যা হলো, ‘কাফ’ বলতে রাসূল (দ:)-এর জন্যে আল্লাহ-ই যথেষ্ট (কেফায়া)হওয়াকে বুঝিয়েছে, যেমনটি আল্লাহ এরশাদ করেছেন: “আল্লাহ কি আপন বান্দাদের জন্যে যথেষ্টনন?” [আল-কুরআন, ৩৯:৩৬]; ‘হা’ বলতে বোঝানো হয়েছে সঠিক রাস্তা প্রদর্শন (হেদায়াত ), যেমনটি আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আর (আল্লাহ) আপনাকে সোজা পথ দেখিয়ে দেন” [আল-কুরআন, ৪৮:২]; ‘ইয়া’ বলতে আল্লাহ’র শক্তি (তাইয়্যিদ) দ্বারা সমর্থন দানকে বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেছেন: “(আল্লাহ) নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিদান করেছেন” [আল-কুরআন, ৮:২৬]; ‘আঈন’ বলতে আল্লাহর সুরক্ষা (’ইসমা) বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি এরশাদ করেন: “আর আল্লাহ আপনাকেরক্ষা করবেন মানুষ থেকে” [আল-কুরআন, ৫:৬৭]; আর ‘সোয়াদ’ বলতে মহানবী (দ:)-এর প্রতি আল্লাহর প্রেরিত আশীর্বাদ (সালাত) বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি কিতাবুল্লাহ শরীফে ঘোষণা করেছেন: ““নিশ্চয় আল্লাহও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্যবক্তা (নবী)’র প্রতি” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬]। আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন, “এবং যদি তাঁর (নবীর) ব্যাপারে তোমরা জোট বাঁধো (মানে একেঅপরকে সাহায্য করো), তবে নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাহায্যকারী (মাওলা) এবং জিব্রাঈল ওসৎকর্মপরায়ণ মু’মিনবৃন্দ–ও” [আল-কুরআন, ৬৬:৪]। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটির অর্থ রক্ষাকারী (বা সাহায্যকারী)। এ কথা বলা হয়েছে যে সৎকর্মশীল ঈমানদারবৃন্দ রাসূল (দ:)-এর সাহায্যকারী। আরো বলা হয়েছে যে এ আয়াতকে আক্ষরিক অর্থে নিতে হবে, যার মানে সকল ঈমানদারকে এতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [অনুবাদকের জ্ঞাতব্য: মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব প্রণীত “তাফসীরে নূরুল এরফান” গ্রন্থে এআয়াতের টীকায় লেখা হয়েছে: “স্মরণ রাখা দরকার যে, নবী (দ:) মুসলমানদের এমন–ই সাহায্যকারী, যেমনবাদশাহ প্রজাদের সাহায্যকারী। আর মু’মিনবৃন্দ হুযূর (দ:)-এর এমন সাহায্যকারী, যেমন সেবক ও সিপাহীবর্গবাদশাহর। সুতরাং এ আয়াতের ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে না যে রাসূল (দ:)মুসলমানদের মুখাপেক্ষী।]