শেফা শরীফ
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
পরিচ্ছেদ – ৯/ সূরা ফাতহ-এ মহানবী (দ:)-কে প্রদত্ত মর্যাদাপূর্ণ চিহ্নগুলো সম্পর্কে
আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আমি আপনার জন্যে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি; যাতে আল্লাহ আপনার কারণে ক্ষমা করে দেন আপনার পূর্ববর্তীদের ও আপনার পরবর্তীদের গুনাহ্ এবং আপন নি’মাতগুলো (আপনার) প্রতি পরিপূর্ণ করে দেন, আর আপনাকে সোজা পথ দেখান; এবং আল্লাহ আপনাকে বড় ধরনের সাহায্য করেন। তিনি-ই, যিনি ঈমানদারদের অন্তরসমূহে প্রশান্তি দান করেন, যাতে তাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়; এবং আল্লাহরই মালিকানাধীন সমস্ত বাহিনী আসমানসমূহ ও জমিনের; এবং আল্লাহ জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়; যাতে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে বাগানসমূহে নিয়ে যান, যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান; তারা সেগুলোর মধ্যে স্থায়ীভাবে থাকবে; এবং তাদের পাপরাশি তাদের থেকে মোচন করে দেন। আর এটা আল্লাহর কাছে মহা সাফল্য। এবং শাস্তি দেন মুনাফিক্ক পুরুষ ও মুনাফিক্ক নারীদেরকে এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদেরকে, যারা আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণা পোষণ করে – মন্দ ধারণা। তাদের ওপর রয়েছে মন্দচক্র এবং আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাদের প্রতি অভিসম্পাত করছেন, আর তাদের জন্যে জাহান্নাম তৈরি করেছেন; এবং তা কতোই মন্দ পরিণাম! এবং আল্লাহরই মালিকানাধীন আসমানসমূহ ও জমিনের সমস্ত বাহিনী এবং আল্লাহ সম্মান ও প্রজ্ঞাময়। নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযের-নাযের (উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে; যাতে হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূল (দ:)-এর মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো। আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। ওই সব লোক, যারা আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে তারা তো আল্লাহরই কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে। তাদের হাতগুলোর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে। সুতরাং যে কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, সে নিজেরই অনিষ্টার্থে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে; আর যে কেউ পূরণ করেছে ওই অঙ্গীকার, যা সে আল্লাহর সাথে করেছিল, তবে অতি সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।” [আল-কুরআন, ৪৮: ১-১০ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]
আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁর রাসূল (দ:)-এর প্রতি দানকৃত নেয়ামত-আশীর্বাদ ও তাঁরই কৃত মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা এবং আল্লাহর কাছে হুযূর পাক (দ;)-এর মাকামের মহত্ব ও আশীর্বাদ ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলোতে বিধৃত হয়েছে, যা ভাষায় যথাযথভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহতা’লা শুরু করেছেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর শত্রুদের ওপর তাঁরই সুস্পষ্ট বিজয়ের কথা বিবৃত করে; আর কীভাবে আল্লাহর বাণী ও শরীয়ত আধিপত্য লাভ করবে, তা-ও বর্ণনা করে; আর মহানবী (দ:)-কে তিনি যে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো কাজের জন্যে তাঁকে যে দোষী সাব্যস্ত করবেন না, তা-ও ব্যক্ত করে। উলামা-এ-হক্কানীদের একজন বলেন যে, যা কিছু ঘটেছে এবং যা ঘটেনি, আল্লাহ পাক উভয়কেই এখানে উদ্দেশ্য করেছেন। মক্কী (রহ:) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর ঐশী দানকে ক্ষমার অসীলা বানিয়েছেন। সব কিছুই তাঁর কাছ থেকে এসে থাকে। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। (খোদায়ী) আশীর্বাদের ওপর (খোদায়ী) আশীর্বাদ, (ঐশী) দানের ওপর (ঐশী) দান।”
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেন: “….আপন নি’মাতগুলো (আপনার) প্রতি পরিপূর্ণ করে দেন…।” এ কথা বলা হয়েছে যে মহানবী (দ:)-এর প্রতি যারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে, তাদের দর্পচূর্ণ করেই এটা করা হয়; আরো বলা হয়েছে যে এতে মক্কা ও তায়েফ নগরীগুলোর বিজয়কে বোঝানো হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহতা’লা এই আয়াতে ব্যক্ত করেছেন – “এই পৃথিবীতে আপনার খ্যাতি বৃদ্ধি করে, আপনাকে সাহায্য ও ক্ষমা করে (এটা করেছি)।” আল্লাহ তাঁকে বলছেন যে, তাঁর প্রতি আপন নেয়ামতগুলো আল্লাহ পূর্ণ করেছেন তাঁরই দাম্ভিক শত্রুদের দম্ভকে ধূলিসাৎ করে; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় নগরীগুলোর একটিকে উন্মুক্ত করে; তাঁর মহত্ব উন্নীত করে এবং তাঁকে বেহেশ্ত ও সুখ-শান্তির দিকে অগ্রসরমান সোজা পথ প্রদর্শন করে; খোদাতা’লার বিজয় শক্তিশালী এক বিজয়-ই বটে। আল্লাহতা’লা ঈমানদার মুসলমানদের প্রতি আপন নেয়ামত বর্ষণ করেন তাদেরই কলব্ তথা অন্তরে স্থাপিত তাসল্লি (শান্তি) ও ‘সাকিনা’ (অন্তরের প্রশান্তি)-পূর্ণ পুরস্কার দ্বারা; তাদের নিরঙ্কুশ বিজয় ও খোদায়ী ক্ষমা প্রদর্শনের সুসংবাদ দ্বারাও; তাঁদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করার দ্বারাও; আর তাঁর শত্রুদের খোদায়ী অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরই দয়া হতে বঞ্চিত অবস্থায় দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পরিণতি বরণের কথা ব্যক্ত করার দ্বারাও।
অতঃপর আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযের-নাযের (উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে” [আল-কুরআন, ৪৮: ১-১০]। এখানে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-এর কয়েকটি উত্তম গুণ ও বৈশিষ্ট্য এক এক করে উল্লেখ করেছেন। তিনি যে তাঁর উম্মতের কাছে সত্যিসত্যি ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, তার সাক্ষী তিনি নিজেই। এ কথা বলা হয়েছে এর মানে এ-ও যে তিনি তাদের পক্ষে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য বহন করবেন। তিনি তাঁর উম্মতের কাছে পুরস্কারের বা গুনাহ মাফের খোশ-খবরী (সুসংবাদ) প্রদান করে থাকেন। তিনি তাঁর শত্রুদেরকে তাদের শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং তাদের গোমরাহীর (পথভ্রষ্টতার) ব্যাপারেও এমন উপায়ে তা করেন, যার দরুন আল্লাহতা’লা যাঁদের তাকদীরে ভালাই রেখেছেন, তাঁরা আল্লাহতা’লা ও তাঁর (রাসূল)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন।
এরপর তাঁরা (ঈমানদারবৃন্দ) “রাসূল (দ:)-এর মহত্ব বর্ণনা (সাহায্য) ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন” করবেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে তাঁরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কঠিন সাধনা করবেন। এর সম্পর্কে সবচেয়ে সার্বিক ও স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এটা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে উদ্দেশ্য করেছে।
অতঃপর আল্লাহ ফরমান: “আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।” এর উদ্দেশ্য আল্লাহ-ই।
ইবনে আতা’ বলেন, “এই সূরাটি মহানবী (দ:)-এর জন্যে বিভিন্ন আশীর্বাদের সুসংবাদ বহন করে, যার মধ্যে রয়েছে “সুস্পষ্ট বিজয়”, যেটা দোয়া কবূল হওয়ার ইঙ্গিত; “ক্ষমা”, যা মহব্বতের ইঙ্গিতবহ; সম্পূর্ণ আশীর্বাদ, যেটা নির্বাচিত/পছন্দকৃত হওয়ার চিহ্ন; আর হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শন, যেটা উইলায়াত (বন্ধুত্ব)-এর একটি চিহ্ন। ক্ষমায় নিহিত রয়েছে দোষত্রুটি থেকে মুক্তি। আর আশীর্বাদের পূর্ণতাপ্রাপ্তি হলো নিখুঁত পর্যায়ে উন্নীত হওয়া। সাক্ষ্যদানের হুকুমনামা/আদেশপত্র হলো হেদায়াত।”
জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ বলেন, “আল্লাহর পূর্ণকৃত নেয়ামতের অংশ হলো, তিনি তাঁর রাসূল (দ:)-কে নিজের মাহবূব (প্রিয়ভাজন) বানিয়েছেন, হুযূর (দ:)-এর (পবিত্র) জীবনের নামে কসম করেছেন, তাঁর দ্বারা অন্যান্য (পয়গম্বরের) শরীয়তগুলোকে রহিত করিয়েছেন, মাকামে মাহমূদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ মাকামে তাঁকে উন্নীত করেছেন, মে’রাজ শরীফে তাঁকে রক্ষা করেছেন – যার দরুন তাঁর দু’চোখ ’না কোনো দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে’, অধিকন্তু, সমগ্র মানবজাতির জন্যে তাঁকে পয়গম্বর করে পাঠিয়েছেন, আর তাঁর উম্মতের জন্যে গনীমতকে হালাল করেছেন। আল্লাহতা’লা তাঁকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, আর আদম (আ:)-সন্তানদের সরদার বানিয়েছেন। তিনি মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারককে তাঁরই পবিত্র নামের সাথে, রাসূলুল্লাহ (দ;)-এর আনন্দ-খুশিকে তাঁরই আনন্দ-খুশির সাথে জড়িত করেছেন। আল্লাহতা’লাতাওহীদের দুটো স্তম্ভের একটি মহানবী (দ:)-কে বানিয়েছেন।”
আল্লাহতা’লা এরপর এরশাদ করেন, “যারা আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে তারা তো আল্লাহরই কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে”, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বায়’আত আর-রিদওয়ান [হোদায়বিয়ায়]। তারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করলেই আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথকারী হবে।
এই শপথে “তাদের হাতগুলোর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে।” এটা আল্লাহর ক্ষমতাকে, তাঁর পুরস্কারকে, তাঁর নেয়ামত/আশীর্বাদকে কিংবা তাঁর প্রতিশ্রুতিকে রূপকার্থে ব্যক্ত করেছে, আর মহানবী (দ:)-এর প্রতি তাঁদের বায়’আত গ্রহণকে শক্তিশালী করেছে এবং যাঁর প্রতি তাঁরা এই আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর মাকামকেও উন্নীত করেছে।
আল্লাহর এই বাণী তাঁরই নিম্নবর্ণিত কালামের মতো: “অতঃপর তাদেরকে তোমরা হত্যা করো নি, বরং আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করেছেন (বদর যুদ্ধে), এবং হে মাহবূব! ওই মাটি, যা আপনি নিক্ষেপ করেছেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ-ই নিক্ষেপ করেছেন।” [আল-কুরআন, ৮: ১৭]
তবে পূর্ববর্তী আয়াতটি রূপক হলেও পরবর্তী আয়াতটি আক্ষরিকভাবে সত্য, কেননা পরবর্তীটির ক্ষেত্রে বাস্তবে হত্যা করেছেন এবং মাটি ছুঁড়েছেন আল্লাহ পাক-ই। তিনি-ই মহানবী (দ:)-এর কাজের স্রষ্টা; তাঁর (মাটি) ছুঁড়ে মারা, এ কাজ করতে তাঁর (প্রতি মঞ্জুরিকৃত) ক্ষমতা, এবং এটা করতে তাঁর নেয়া সিদ্ধান্তের সবই ছিল আল্লাহতা’লার সৃষ্ট (অলৌকিক) কর্ম। শত্রুপক্ষের সবার চোখ ধুলোয় পূর্ণ করার শক্তি নিয়ে মাটি নিক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য কারোরই নেই। ফেরেশতাদের দ্বারা (শত্রুপক্ষের সৈন্যদের) হত্যা করার ঘটনাও ছিল বাস্তব।
এ কথাও বিবৃত হয়েছে যে এই পরবর্তী আয়াতটি আরবীতে এক বিশেষ ধরনের রূপক, যার অর্থ – আপনি যখন তাদের চোখে-মুখে ধুলো ও পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন তো আপনি নিক্ষেপ করেননি এবং আপনি তাদেরকে হত্যা করেননি। বরঞ্চ অাল্লাহতা’লাই তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন। এর মানে হলো, ওই কাজের ফায়দা আল্লাহতা’লার কাজ হতেই সৃষ্ট হয়েছে। অন্তর্নিহিত অর্থে আল্লাহতা’লাই হলেন তাদের হত্যাকারী ও ধুলো নিক্ষেপকারী, আর (বাহ্যিকভাবে) আপনার নাম তাতে রয়েছে।