শেফা শরীফ
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
পরিচ্ছেদ – ৩/ মহানবী (দ:)-এর প্রতি আল্লাহতা’লার দয়া ও নম্র মনোভাব
এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে খোদায়ী কালাম – “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন; আপনি তাদেরকে কেন অনুমতি দিলেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনার কাছে স্পষ্ট হয়নি সত্যবাদীরা এবং প্রকাশ পায়নি মিথ্যেবাদীরাও” [সূরা তওবা, ৪৩ আয়াত]। আওন ইবনে আবদিল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-কে তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু বলার আগেই তাঁকে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন।”
আস্ সামারকান্দী বর্ণনা করেন এ মর্মে যে জনৈক আলেম এর অর্থ করেছেন, “হে হৃদ-স্পন্দনের ধ্বনি, আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন। তাহলে আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” যদি প্রথমেই এ কথা বলা হতো – “আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” – তাহলে রাসূলে পাক (দ:)-এর চিত্ত ভয়ে দুরু দুরু করতো। কিন্তু আল্লাহ পাক প্রথমেই ক্ষমা করার কথা বলে তাঁর অন্তরকে শান্ত রেখেছেন এবং তারপর জিজ্ঞেস করেছেন – “আপনার কাছে কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যেবাদী তা স্পষ্ট হবার আগে কেন আপনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন?”
এতে আল্লাহর সাথে মহানবী (দ:)-এর উচ্চ মকাম পরিস্ফুট হয়, যা ন্যূনতম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছেও গোপন থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (দ;)-কে পাক পরওয়াদেগারে আলম কী পরিমাণ সম্মান করেন এবং তাঁর প্রতি কী রকম দয়াবান তা এতে পরিস্ফুট হয়, যা সম্পূর্ণ জ্ঞাত হলে অন্তর বিগলিত হতো (সবার)।
নিফতাওয়াইহ্ বলেন, “কিছু লোক মনে করে হুযূর পূর নূর (দ:)-কে এ আয়াতে তিরস্কার করা হয়েছে। বিষয়টি তা থেকে যোজন যোজন দূরে! বস্তুতঃ তাঁকে এর দরুন পছন্দ করা হয়েছে। যখন তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন, তখন আল্লাহ জ্ঞাত করলেন যে তিনি (রাসূল) যদি তাদেরকে অনুমতি না দিতেন, তাহলে তারা এমনিতেই তাদের মোনাফেকীর মধ্যে বসে থাকতো; অতএব, তাঁর অনুমতি দেয়ার প্রতি কোনো আপত্তি উত্থাপন-ই করা যায় না।”
যে মুসলমান-ব্যক্তি নিজের নফসের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন এবং নিজ আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রে শরীয়তকে আঁকড়ে ধরেছেন, তিনি তাঁর কথাবার্তায়, কাজ-কর্মে, উদ্দেশ্য সাধনে ও আলাপচারিতায় কুরআন মজীদের আদব-কায়দা (শিষ্টাচার)-কে ধারণ করতে বাধ্য। এটাই দ্বীন ও দুনিয়ায় প্রকৃত জ্ঞান ও সঠিক আচরণের মূলভিত্তি। সকল মনিবের মহাপ্রভু, যিনি সবাইকে আশীর্বাদ দেন, যাঁর কিছুরই প্রয়োজন নেই, তাঁর কাছে চাওয়া-পাওয়ার বেলায় এই অনন্য সাধারণ নম্রতা ও দয়াকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আয়াতে ধারণকৃত ফায়দাগুলোকে অন্তরে গ্রহণ করে নিতে হবে এ বাস্তবতার আলোকে যে, আল্লাহতা’লা জিজ্ঞেস করার আগে সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং ক্ষমা করতে আনন্দ অনুভব করেছেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, যদিও এর মধ্যে ত্রুটিজনিত জবাবদিহিতার কিছু আছে কি না সন্দেহ।
আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “যদি আমি আপনাকে অবিচলিত না রাখতাম, তবে এ কথা নিশ্চিত ছিল যে আপনি তাদের প্রতি সামান্য কিছু ঝুঁকে পড়তেন” [সূরা বনী ইসরাঈল, ৭৪ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। জনৈক মোতাকাল্লেমূন (কালাম-শাস্ত্র) পণ্ডিত বলেন, “অন্যান্য নবী (আ:)-বৃন্দের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আল্লাহতা’লা (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের প্রিয়নবী (দ:)-এর কোনো কর্মের আগেই (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে তা ভালোবাসার কার্যকর ও সর্বোত্তম নিদর্শন হয়। এতে তাঁর ভালাইয়ের প্রতি খোদাতা’লার সর্বান্তকরণের আভাস পাওয়া যায়।
লক্ষ্য করুন কীভাবে আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর অবিচলিত ভাব সম্পর্কে উল্লেখ করে তারপর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে সজাগ যে মহানবী (দ:) হয়তো এ বক্তব্যে ভীত হতে পারেন। তাই তাঁর এ বক্তব্যে তিনি মহানবী (দ:)-এর নিষ্কলুষ মর্যাদা বজায় রেখেছেন। এ বক্তব্য কোনোক্রমেই তাঁর (খোদাপ্রদত্ত) মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে না।
একই কথা প্রযোজ্য আরেকটি আয়াতে করীমার ক্ষেত্রে, যা’তে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “আমি জানি, আপনাকে (রাসূলকে) কষ্ট দিচ্ছে ওই কথা যা তারা বলছে। অতঃপর তারা তো আপনাকে অস্বীকার করছে না; বরং যালেমরাই আল্লাহর আয়াতগুলোর অস্বীকার করছে।” [সূরা আনআম, ৩৩ আয়াত]
হযরত আলী (ক:) বর্ণনা করেন যে আবূ জাহেল হযরত রাসূলে করীম (দ:)-কে বলেছিল, “আমরা তোমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দেই না। আমরা বলি, তুমি যা নিয়ে এসেছো, তা একটা ডাহা মিথ্যে।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতে করীমাটি আল্লাহতা’লা নাযেল করেন।
এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (দ:) অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন যখন তাঁর জাতি (মক্কার কুফফার) তাঁর প্রতি মিথ্যের অপবাদ দিয়েছিল। এমতাবস্থায় জিবরীল (আ:) তাঁর কাছে এসে বলেন, “আপনি কেন এতো পেরেশান?” তিনি জবাব দেন, “আমার জাতি আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়েছে।” জিবরীল (আ:) বলেন, “তারা ভালো করেই জানে আপনি সত্য কথা বলেছেন।” অতঃপর আল্লাহ এ আয়াতখানা নাযেল করেন।
হুযূর পূর নূর (দ:)-কে নরম সুরে সান্ত্বনা দেয়া এবং তাঁর সাথে স্নেহভরে কথা বলাই হচ্ছে আয়াতটির লক্ষ্য, যা তাঁর জাতির মাঝে বিবেচিত তাঁরই সত্যবাদী ব্যক্তিত্বকে ও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অস্বীকার না করার কথাকে সমর্থন দেয়। তারা স্বীকার করে যে তিনি কথা ও বিশ্বাসে সত্যবাদী। তিনি নবী হওয়ার আগে তারা তাঁকে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বাসভাজন) বলে ডাকতো। তাঁকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলে ডাকাতে তাঁর অনুভূত দুঃখকষ্ট (আয়াতোক্ত) এই সমর্থন দ্বারা দূর হয়েছিল।
অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-এর জাতিকে সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তারা অস্বীকারকারী ও মন্দ-কর্ম সংঘটনকারী। তিনি এরশাদ ফরমান: “বরং যালেমরাই আল্লাহর আয়াত (নিদর্শন)-গুলো অস্বীকার করছে।”
আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-এর ওপর থেকে সমস্ত অসম্মানের মিথ্যে অপবাদ অপসারণ করেছেন এবং এর পরে তাঁর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করার দোষে রাসূলে খোদা (দ:)-এর জাতিকে একগুঁয়ে বলে চিহ্নিত করেছেন। অস্বীকৃতি সে ব্যক্তির কাছ থেকেই আসতে পারে, যে কিছুটুকু জানে এবং তারপর অস্বীকার করে। যেমন আল্লাহ বলেন: “এবং সেগুলোকে অস্বীকার করলো, অথচ তাদের অন্তরগুলোতে সেগুলোর (সত্যতার) নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, যুলুম ও অহঙ্কারবশতঃ (তারা তা অস্বীকার করলো)” [সূরা নামল, ১৪ আয়াত]
অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (দ:)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং তাঁকে খুশি করেছেন তাঁর পূর্ববর্তীদের কথা বলে, আর তিনি আপন সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছেন এ কথা ঘোষণা করে – “এবং আপনার আগেও বহু রাসূলকে অস্বীকার করা হয়েছে। তখন তাঁরা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন এ অস্বীকার ও দুঃখকষ্টের ব্যাপারে, যে পর্যন্ত না তাঁদের কাছে আমার সাহায্য এসেছে” [সূরা আনআম, ৩৪ আয়াত; প্রাগুক্ত কানযুল ঈমান]
রাসূলে খোদা (দ:)-এর প্রতি আল্লাহর দয়া ও মহানবী (দ:)-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি এই যে, আল্লাহতা’লা সকল পয়গম্বরকে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন; যেমন – ‘হে আদম’ [২:২৩], ‘হে নূহ’ [১১:৪৮], ’হে ইবরাহীম’ [৩৭:১০৪-৫], ‘হে মূসা’ [২০:১৪], ‘হে দাউদ’ [৩৮:২৬], ‘হে ঈসা’ [৩:৫৫], ‘হে যাকারিয়্যা’ [১৯:৭], ‘হে ইয়াহইয়া’ [১৯:১২]। কিন্তু তিনি মহানবী (দ;)-কে সম্বোধন করেছেন – ‘হে রাসূল’ [৫:৬৭], ‘হে নবী’ [৩৩:৪৫], ‘হে বস্ত্রাবৃত’ [৭৩:০১], ‘হে চাদর আবৃত’ [৭৪:০১]।