শেফা শরীফ ১ম খণ্ড (পরিচ্ছেদ ২/ মহানবী (দ:)-কে শাহেদ (সাক্ষী) হিসেবে আল্লাহর দেয়া বর্ণনা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত প্রশংসা ও মর্যাদা)

শেফা শরীফ

মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (দ:)-কে শাহেদ (সাক্ষী) হিসেবে আল্লাহর দেয়া বর্ণনা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত প্রশংসা ও মর্যাদা

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হে অদৃশ্যের সংবাদ দানকারী (নবী)! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি শাহেদ তথা উপস্থিত পর্যবেক্ষণকারী (হাযের-নাযের) করে, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীস্বরূপ” [সূরা আহযাব, ৪৫ আয়াত]। এ আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীব (দ:)-কে শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ সকল পদমর্যাদা ও প্রশংসনীয় প্রতিটি গুণ দ্বারা বিভূষিত করেছেন। তিনি তাঁকে উম্মতের জন্যে একজন সাক্ষী বানিয়েছেন এ বাস্তবতার আলোকে যে তিনি তাদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁকে মান্যকারী মানুষের জন্যে তিনি হলেন শুভ সংবাদ দানকারী, আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী লোকদের জন্যে তিনি হলেন সতর্ককারী। তিনি আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁরই এবাদত-বন্দেগীর প্রতি আহ্বানকারী এবং তিনি হলেন একটি প্রোজ্জ্বল প্রদীপ, যা দ্বারা মানুষজন সত্যের দিকনির্দেশনা পায়।

আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, “আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্-এর সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: আমাকে রাসূলুল্লাহ (দ:) সম্পর্কে বিবরণ দিন। তিনি জবাব দিলেন: নিশ্চয়ই! শপথ আল্লাহর নামে, কুরঅান মজীদে বর্ণিত হুযূর পূর ‍নূর (দ:)-এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য তৌরাতেও পাওয়া যায়। তৌরাত ঘোষণা করে: ‘হে নবী (দ:)! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী এবং নিরক্ষরদের জন্যে আশ্রয় হিসেবে। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনাকে মানুষের আস্থার পাত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছি। আপনি এমনই একজন যিনি অমার্জিত কিংবা অশিষ্ট নন, যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং যিনি মন্দের প্রতিদানে মন্দ কিছু করেন না, বরং ক্ষমা করেন। আল্লাহ তাঁকে ততোক্ষণ নিজের কাছে ফেরত নেবেন না, যতোক্ষণ না বদমায়েশ সমাজ তাঁর দ্বারা সিধা হয় এবং ঘোষণা করে – ”আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বূদ নেই।” নবী (দ:)-এর মাধ্যমেই অন্ধ চক্ষু, বধির কান ও কলুষিত অন্তর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠবে’।” আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও কা’আব আল-আহবার হতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা এসেছে।

ইবনে এসহাক থেকে একটি বর্ণনায় এরশাদ হয়: “যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং অশালীন ভাষা প্রয়োগ কিম্বা গালিগালাজ করেন না। আমি তাঁকে সমস্ত মহৎ গুণাবলী ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত করেছি। আমি শান্তিকে তাঁর ভূষণ, উৎসর্গিত হওয়াকে তাঁর নীতি, খোদাভীরুতাকে তাঁর বিবেক, জ্ঞানকে তাঁর উপলব্ধি, সত্যবাদিতা ও আনুগত্যকে তাঁর স্বভাব, ক্ষমা ও সঠিক আচরণকে তাঁর চরিত্র, ন্যায়বিচারকে তাঁর আচরণ, সত্যকে তাঁর শরীয়ত, হেদায়াতকে তাঁর দিক-নির্দেশক, ইসলামকে তাঁর ধর্ম এবং আহমদকে তাঁর নাম হিসেবে পছন্দ করে সৃষ্টি করেছি। আমি পথভ্রষ্টতার পরে তাঁর হেদায়াতকে এবং অজ্ঞতার পরে তাঁর জ্ঞানকে প্রকাশ করবো। বিস্মৃতির পরে আমি তাঁকে বুলন্দ্ তথা সমুন্নত করবো। অস্বীকৃতির পরে আমি তাঁর নাম মোবারককে সর্বত্র জ্ঞাত করবো। অভাবের পরে আমি তাঁকে অধিক (পরিমাণে) দান করবো। গরিবীর পরে আমি তাঁকে সমৃদ্ধ করবো। বিচ্ছেদের পরে আমি তাঁকে মিলিত করবো। তাঁর মাধ্যমেই আমি বিচ্ছিন্ন অন্তরগুলো ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রেরণাকে এবং বিচ্ছিন্ন সমাজগুলেকে একত্রিত করবো। আমি তাঁর সমাজ (উম্মত)-কে মানবের কল্যাণকারী সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে আবির্ভূত করবো।”

আরেকটি হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (দ:) তৌরাতে তাঁর সম্পর্কে যা যা বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে বিবৃত করেন: “আমার বান্দা আহমদ, পছন্দকৃত জন যিনি মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করবেন; তিনি মদীনা নগরীতে হিজরত করবেন, কেননা তিনি তৈয়্যবাত (কলেমা) পড়েছিলেন; তাঁর উম্মত হবেন তাঁরাই, যাঁরা সকল অবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করবেন।” [কা’আব হতে আদ্ দারিমী বর্ণিত; ইবনে মাসউদ (রা:) হতে তাবরানী ও আবূ নুয়াইম বর্ণিত]

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ওই সব মানুষ, যারা গোলামী করবে এ পড়াবিহীন অদৃশ্যের সংবাদ দানকারী রাসূলের, যাঁকে লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের নিকট তাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে; তিনি তাদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দেবেন এবং অসৎ কাজে বাধা দেবেন, আর পবিত্র বস্তুগুলো তাদের জন্যে হালাল করবেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহ তাদের প্রতি হারাম করবেন; আর তাদের ওপর থেকে ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলার শৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিল, নামিয়ে অপসারিত করবেন। সুতরাং ওইসব মানুষ যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং ওই নূরের অনুসরণ করে, যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তারাই সফলকাম হয়েছে।” [সূরা আ’রাফ, ১৫৭ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]

আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “আল্লাহর তরফ থেকে এ এক দয়া ছিল যে আপনি, হে হাবীব (দ:), তাদের জন্যে কোমল-হৃদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতেন, তবে তারা নিশ্চয় আপনার আশপাশ থেকে পেরেশান হয়ে যেতো। সুতরাং আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্যে সুপারিশ করুন। আর (বিভিন্ন) কার্যাদিতে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। এবং যখন কোনো কাজের ইচ্ছা পাকাপোক্ত করবেন, তখন আল্লাহর ওপর নির্ভর করুন। নিঃসন্দেহে (এরকম) নির্ভরকারীরা আল্লাহর প্রিয়ভাজন।” [সূরা আলে ইমরান, ১৫৯ আয়াত; ইমাম আহমদ রেযা খান কৃত ‘কানযুল ঈমান’ বাংলা সংস্করণ]

অাস্ সামারকান্দী বলেন, “আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর প্রিয়নবী (দ:) মো’মেন মুসলমানদের প্রতি ক্ষমাশীল, করুণাশীল ও কোমল। তিনি যদি ভাষণে কঠোর ও রূঢ় হতেন, তাহলে তারা তাঁকে ছেড়ে যেতো। তবে আল্লাহ তাঁকে বিশাল অন্তরের অধিকারী, দয়ালু, নম্র, হাসি-খুশি ও সহজ-সরল বানিয়েছেন।” আদ্ দাহহাক-ও অনুরূপ এক বর্ণনা দিয়েছেন।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং কথা হলো এ রকমই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্যে সাক্ষী হও। আর এ রাসূল (দ:) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন” [সূরা বাকারা, ১৪৩ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। আবূল হাসান আল-কাবিসী বলেন, “এ আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা আমাদের মহানবী (দ:)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব পরিস্ফুট করেছেন।”

আরেকটি আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “যাতে রাসূল (দ:) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন এবং তোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও” [সূরা হ্জ্জ্ব, ৭৮ আয়াত; কানযুল ঈমান]। তিনি আরো এরশাদ ফরমান: “তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো, এবং হে হাবীব, আপনাকে তাদের সবার জন্যে সাক্ষী ও পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে উপস্থিত করবো?” [সূরা নিসা, ৪১ আয়াত]

আল্লাহতা’লা যখন একটি ‘মধ্যমপন্থী সমাজ’ সম্পর্কে বলেন, তখন তিনি বোঝান ভারসাম্যপূর্ণ ও ভালো। আয়াতটির অর্থ হলো, আমি (আল্লাহ) যেমন তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছি, তেমনি আমি তোমাদের পছন্দ করে নিয়েছি এ মর্মে যে তোমাদেরকে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বানিয়ে দিয়েছি এবং পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষ হয়ে তাঁদের উম্মতদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে তোমাদেরকে অনুমতিও দিয়েছি। আর মহানবী (দ:)-ও সততার সাথে তোমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।

এ কথা বলা হয়েছে, যখন আল্লাহতা’লা পয়গম্বরবৃন্দকে জিজ্ঞেস করবেন – “আপনারা কি (ঐশী বাণী) পৌঁছে দিয়েছেন?” তখন তাঁরা উত্তর দেবেন – “হ্যাঁ, আমরা পৌঁছে দিয়েছি।” অতঃপর তাঁদের উম্মতবর্গ বলবে, “আমাদের কাছে কোনো সুসংবাদ দানকারী (নবী) ও সতর্ককারী আসেননি” [সূরা মায়েদা, ১৯ আয়াত]। এমতাবস্থায় উম্মতে মোহাম্মদী (পূর্ববর্তী) পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন এবং রাসূলে খোদা (দ:) তাঁর উম্মতের পক্ষে সাক্ষী হবেন (আল-বোখারী ও অন্যান্যদের বর্ণিত)। এ কথাও বলা হয়েছে যে এই আয়াতে করীমার অর্থ হচ্ছে: (শেষ বিচারে) তোমরা (উম্মতে মোহাম্মদী) তোমাদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে এক (জোরালো) যুক্তি এবং মহানবী (দ:) হলেন তোমাদের পক্ষে এক (জোরালো) যুক্তি।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ঈমানদার (মুসলমান)-দের সুসংবাদ দিন যে তাদের জন্যে তাদের প্রতিপালকের কাছে সত্যের মর্যাদা রয়েছে” [সূরা ইউনুস, ২ আয়াত]। সর্ব-হযরত কাতাদা (রা:), হাসান বসরী (রহ:) এবং যায়দ ইবনে আসলাম বলেন, “এই ‘সত্যের মর্যাদা’ হলেন রাসূলুল্লাহ (দ:) যিনি তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন।” হাসান আল-বসরী (রহ:) আরো বলেন, “এটা তাদের প্রতি তাদেরই মহানবী (দ:)-এর মঞ্জুর হওয়াকে বোঝায়।” আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) বলেন, “এটা হলো রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর শাফায়াত। আল্লাহতা’লার দরবারে তিনি-ই হলেন তাদের পক্ষে নিশ্চিত সুপারিশকারী।” সাহল্ আত্ তুসতরী (রহ:) বলেন, “এটা আল্লাহতা’লা কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মাঝে স্থাপিত পুর্বনির্ধারিত রহমত (করুণা)।”

মোহাম্মদ ইবনে আলী আত্ তিরমিযী (রহ:) বলেন, “তিনি-ই হলেন সত্যবাদীদের ও সত্যের ইমাম, গৃহীত সুপারিশকারী, সাড়াপ্রাপ্ত (খোদার) আহ্বানকারী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।” এটা বর্ণনা করেছেন আস্ সুলামী।


Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *