শেফা শরীফ
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[Bengali translation of Imam Qadi Iyad’s “Shifa.” Translator: Kazi Saifuddin Hossain. Part – 4]
প্রথম খণ্ড
বাক্য ও কর্মে প্রকাশিত মহানবী (দ:) সম্পর্কে আল্লাহতা’লার সুউচ্চ মূল্যায়ন
পরিচিতি
আল্লাহতা’লা যে হুযূর পূর নূর (দ:)-কে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেন এবং তাঁকে অসংখ্য মহৎ গুণ দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছেন, তা অনুধাবন করার ন্যূনতম চেষ্টাকারীও তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাঁর মূল্যায়ন করা আমাদের জিহ্বা কিংবা কলম দ্বারা সম্ভব নয়।
আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (দ:)-কে কী পর্যায়ে মূল্যায়ন করেন তা কুরআন মজীদে কিঞ্চিত প্রতিভাত হয়। এতে তাঁর চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রিয়নবী (দ:)-কে আঁকড়ে ধরতে এবং তাঁর আরোপিত বিধান অনুসরণ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। একমাত্র আল্লাহতা’লাই রাসূলে আকরাম (দ:)-কে মহাসম্মানিত করেছেন ও পছন্দ করে নিয়েছেন এবং এ কারণে তাঁর প্রশংসা করে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ পুরস্কার দ্বারা পুরস্কৃত করেছেন। আল্লাহতা’লাই প্রারম্ভ ও প্রত্যাবর্তনের সময় দয়ালু দাতা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য।
মহানবী (দ:) সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুউচ্চ মূল্যায়ন আরও দৃষ্টিগোচর হবে এই ক্ষেত্রে যে, আল্লাহ পাক তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকুলের চোখের সামনে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও মহান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁর মাঝে সন্নিবেশিত করেছেন সুন্দরতম গুণাবলী, প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ, সু-মতামত ও অগণিত নৈতিক গুণাবলী। তিনি নূরনবী (দ:)-কে চোখ-ধাঁধানো মো’জেযা (অলৌকিকত্ব), সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সম্মানের প্রকাশ্য চিহ্নসমূহ দ্বারা সমর্থন যুগিয়েছেন। নবী করীম (দ:)-এর সমসাময়িক মানুষেরা ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এবং তাঁর পরবর্তী সময়ে আগত মানুষেরা এগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলেন, যার দরুন এগুলোর বাস্তবতার জ্ঞান আমাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং এগুলোর জ্যোতি আমাদেরকে আলোকিত করেছে। আল্লাহর রহমত তাঁর প্রতি বর্ষিত হোক, আমীন!
হযরত আনাস্ (রা:) বলেন যে মে’রাজের রাতে বোরাক (নবী করীম যে বাহনে চড়ে মক্কা হতে জেরুজালেমে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সাত আসমানে খোদাতা’লার সান্নিধ্যে গমন করেন তাকে বোরাক বলে)-কে লাগাম দিয়ে আসন বসিয়ে নবী পাক (দ:)-এর কাছে আনা হয়। এতে বোরাক মহানবী (দ:)-এর কাছ থেকে লজ্জায় দূরে সরে যায়। এমতাবস্থায় হযরত জিবরীল আমীন (আ:) তাকে বলেন, “তুমি রাসূলে খোদা (দ:)-এর সাথে এ কী আচরণ করছো? আল্লাহ কর্তৃক তাঁর চেয়ে বেশি সম্মানিত আর কেউই তোমার পিঠে সওয়ার হননি।” হযরত আনাস্ (রা:) আরও বর্ণনা করেন যে বোরাক এ কথায় ঘর্মাক্ত হয়ে যায়। [তিরমিযী শরীফ]
প্রথম অধ্যায়: রাসূল (দ:) সম্পর্কে আল্লাহর প্রশংসাস্তুতি ও সুউচ্চ মূল্যায়ন
এ অধ্যায়টিতে রাসূলে খোদা (দ:) সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসাসম্বলিত বেশ কিছু সুস্পষ্ট আয়াতে করীমা উপস্থাপন করা হয়েছে, যেগুলো তাঁর সুন্দর গুণাবলীর বর্ণনা দেয় ও আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চ মর্যাদার বিবরণও দেয়, আর তাঁর প্রশংসাও করে।
পরিচ্ছেদ – ১/ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রশংসাস্তুতি ও তাঁর অসংখ্য মহৎ গুণাবলী
আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য হতে ওই রাসূল (দ:)”। [সূরা তওবা, ১২৮ আয়াত]
মহান রাব্বুল আলামীন জ্ঞাত করেছেন ঈমানদার মুসলমানদের, কিম্বা আরবীয়দের, অথবা মক্কাবাসীদের, বা সমগ্র মানবজাতিকে (আয়াতটির বিভিন্ন তাফসীর অনুযায়ী) এ মর্মে যে, তাঁদের কাছে একজন রাসূল (দ:) এসেছেন যাঁকে তাঁরা চেনেন-জানেন, যাঁর পদমর্যাদা সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত এবং যাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা তাঁরা স্বীকার না করে পারেন না। অতএব, যেহেতু তিনি তাঁদেরই মধ্য হতে আবির্ভূত, সেহেতু মিথ্যাচার অথবা সৎ উপদেশ না দেয়ার ব্যাপারে তাঁরা যেন তাঁকে সন্দেহ না করেন। রাসূল (দ:)-এর সাথে বংশীয়সূত্রে কিম্বা আত্মিয়তার বন্ধনে আবদ্ধ নয় এমন কোনো আরবীয় গোত্র-ই নেই। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ও অন্যান্যদের মতানুযায়ী এটাই হলো ‘নিকটাত্মীয়তার ভালোবাসা’ শীর্ষক কুরঅানের আয়াত (৪২:২৩)-টির ভাবার্থ। তিনি তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হতে আগত। আয়াতে উল্লেখিত প্রশংসা হতে অধিক প্রশংসা কি আর হতে পারে?
অতঃপর আল্লাহতা’লা আয়াতে করীমায় তাঁর প্রতি সকল প্রকার প্রশংসনীয় গুণাবলী আরোপ করেছেন এবং মানুষজনকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দানের প্রতি মহানবী (দ:)-এর আগ্রহ, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের ওপর পতিত ক্ষতি ও দুর্ভোগ সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগ এবং মো’মেন মুসলমানদের প্রতি তাঁর দয়া ও করুণা সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
জ্ঞান বিশারদদের অন্যতম হুসাইন ইবনে ফযল (রহ:) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (দ:)-কে তাঁরই নিজের দুটো নাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন: ‘রাউফ’ তথা দয়ালু ও ‘রাহীম’, অর্থাৎ, করুণাশীল।” অপর একটি আয়াতে করীমায় একই কথা বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল (দ:) প্রেরণ করেছেন” [সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত]। আরেকটি আয়াতে এরশাদ হয়েছে: “তিনি-ই হন (আল্লাহ) যিনি উম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল (দ:) প্রেরণ করেন” [সূরা জুমু’আহ, ২ নং আয়াত]। আল্লাহ পাক আরও এরশাদ ফরমান: “যেমন অামি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল (দ:) তোমাদেরই মধ্য থেকে” [সূরা বাকারা, ১৫১ আয়াত]।
বর্ণিত হয়েছে যে হযরত আলী (ক:) বলেছেন ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ – আল্লাহর এই কালামের অর্থ ‘খানদানের ক্ষেত্রে, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং বংশীয় ক্ষেত্রে (তিনি তোমাদের মধ্য থেকে)। তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে হযরত আদম (আ:)-এর সময় থেকে শুরু করে কেউই ব্যভিচারী ছিলেন না। তাঁদের সবাই যথাযথভাবে বিয়ে-শাদী করেছিলেন।’
ইবনে কালবী বলেন, “আমি মহানবী (দ:)-এর পাঁচ’শ জন মহিলা পূর্বপুরুষের নাম লিপিবদ্ধ করেছি। তাঁদের মধ্যে আমি কোনো ব্যভিচার খুঁজে পাইনি কিংবা জাহেলীয়্যা যুগে বিরাজমান কোনো মন্দ জিনিসও খুঁজে পাইনি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে “যিনি (আল্লাহ) দেখেন নামাযীদের মধ্যে আপনার পরিদর্শনার্থে ভ্রমণকেও” (আল-কুরঅান, সূরা শুয়ারা, ২১৯ আয়াত) – আল্লাহতা’লার এ কালামের অর্থ “পয়গম্বর হতে পয়গম্বর পর্যন্ত, যতোক্ষণ না আমি আপনাকে পয়গম্বর হিসেবে প্রেরণ করেছি।” (ইবনে সা’দ, বাযযার ও আবূ নুয়াইম)
হযরত জা’ফর সাদেক (রহ:) বলেন, “আল্লাহতা’লা জানতেন যে তাঁর সৃষ্টিকুল তাঁর বাধ্যতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারবে না; তাই তিনি এ কথা বলেছেন যাতে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে তারা কখনোই তাঁর খেদমতে সম্পূর্ণ পবিত্রতা তথা শুচিতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তাঁর ও সৃষ্টিকুলের মাঝে তিনি তাদেরই একজনকে স্থাপন করেছেন এবং তাঁরই দয়া ও করুণার গুণাবলী দ্বারা তিনি তাঁকে বিভূষিত করেছেন। তিনি তাঁকে একজন সত্যবাদী প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টিকুলের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং এমন ব্যবস্থা জারি করেছেন যে তাঁকে কেউ মান্য করলে আল্লাহকেই মান্য করা হয় এবং তাঁর সাথে কেউ একমত হলে আল্লাহর সাথেই একমত হওয়ার শামিল হয়। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: ‘যে ব্যক্তি রাসূল (দ:)-এর নির্দেশ মান্য করেছে, নিশ্চয় সে আল্লাহর নির্দেশই মান্য করেছে’ [সূরা নিসা, ৮০ অায়াত]।”
আল্লাহ পাক বলেন, “এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি, বিশ্বগজতের জন্যে রহমত (করুণা) ব্যতিরেকে” [সূরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত]। আবূ বকর মোহাম্মদ ইবনে তাহের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহতা’লা রাসূলে করীম (দ:)-এর মাঝে করুণাপূর্ণ (ঐশী) অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, ফলে তাঁর সমগ্র সত্তা-ই ছিল করুণা এবং তাঁর সিফাত তথা গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলো সকল সৃষ্টির প্রতি করুণাময় ছিল। তাঁর করুণার যে কোনো দিক দ্বারা কেউ যদি আশীর্বাদধন্য হয়, তবে উভয় জগতে ঘৃণিত প্রতিটি বস্তু হতে সে রক্ষা পায় এবং তার প্রিয় প্রতিটি বস্তু সে অর্জন করে। আপনি কি দেখেননি যে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেছেন: “এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি, বিশ্বগজতের জন্যে রহমত (করুণা) ব্যতিরেকে”? তাঁর যাহেরী জিন্দেগী ছিল করুণা, তাঁর বেসাল শরীফ (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তি)-ও করুণা; যেমনটি মহানবী (দ:) ঘোষণা করেন, “হায়াতী খায়রুল্লাকুম, ওয়া মামাতী খায়রুল্লাকুম”, অর্থাৎ, “আমার (যাহেরী) জিন্দেগী তোমাদের জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ, আমার বেসাল-প্রাপ্তিও তদনুরূপ” (আল-হারিস ইবনে আবি উসামা হতে সহীহ সনদে আল-বাযযার)। হুযূর পূর নূর (দ:) আরো এরশাদ ফরমান: “যখন আল্লাহতা’লা কোনো জাতির প্রতি করুণা বর্ষণ করতে চান, তখন তিনি তাদের প্রতি তাঁর মনোনীত পয়গম্বরকে তাদের সামনে নিয়ে যান এবং তাঁকে দিয়ে তাদের রাস্তা প্রস্তুত তথা পথনির্দেশনা দানের ব্যবস্থা করেন।” (মুসলিম শরীফ)
আস্ সামারকান্দী ব্যাখ্যা করেন যে “জগতসমূহের জন্যে রহমত” – খোদায়ী এ কালামে (’জগতসমূহ’ শব্দে) উদ্দেশ্য করা হয়েছে জ্বিন ও ইনসান উভয়কেই। আরো বলা হয়েছে যে এর দ্বারা সমগ্র সৃষ্টিকুলকেই বুঝিয়েছে। তিনি মো’মেন (বিশ্বাসী) মুসলমানদের কাছে রহমত (করুণা) হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শন দ্বারা, তিনি মোনাফেক (কপট) লোকদের কাছে রহমত নিহত হওয়ার আশঙ্কা হতে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে, আর কাফের (অবিশ্বাসী) লোকদের কাছে তিনি রহমত তাদের শাস্তি বিলম্বিত করার দরুন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “তিনি মো’মেন ও কাফের উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি রহমত, কেননা তারা উভয়ই মিথ্যাবাদী অন্যান্য (পূর্ববর্তী) সম্প্রদায়ের পরিণতি হতে রক্ষাপ্রাপ্ত।”
বর্ণিত আছে যে মহানবী (দ:) হযরত জিবরীল (আ:)-কে বলেন, “এ রহমতের কোনো দিক কি আপনাকে ছুঁয়ে গিয়েছে?” তিনি উত্তর দেন, “হ্যাঁ। ভবিষ্যতে আমার কী ফায়সালা হবে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু এখন আমি দুশ্চিন্তামুক্ত ও নিরাপদ অনুভব করছি; কেননা আল্লাহতা’লা আমার প্রশংসায় এরশাদ করেছেন, ‘যিনি (জিবরীল আমীন) শক্তিশালী; আরশ অধিপতির দরবারে সম্মানিত; সেখানে তার আদেশ পালন করা হয় যিনি আমানতদার (আল্লাহর ওহীর)’ [সূরা তাকভীর, ২০-২১ আয়াত]।”
হযরত জা’ফর সাদেক (রহ:)-এর কথা বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন যে “হে প্রিয় রাসূল (দ:), আপনার প্রতি ’সালাম’ হোক ডান পার্শ্বস্থদের কাছ থেকে” [আল-কুরঅান, ৫৬:৯১] – খোদায়ী এ কালামের অর্থ ‘আপনারই জন্যে হে মোহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। তাঁদের এ শান্তির কারণ হলো রাসূলে পাক (দ:)-এর প্রতি অর্পিত মহাসম্মান।
আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ নূর (আলো) আসমানসমূহ ও জমিনের। তাঁর আলোর উপমা এমনই যেমন একটা দীপাধার, যার মধ্যে রয়েছে প্রদীপ। ওই প্রদীপ একটা ফানুসের মধ্যে স্থাপিত। ওই ফানুস যেন একটা নক্ষত্র, মুক্তোর মতো উজ্জ্বল হয় বরকতময় বৃক্ষ যায়তুন দ্বারা; যা না প্রাচ্যের, না প্রতীচ্যের; এর নিকটবর্তী যে, সেটার তেল প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠবে – যদিও আগুন সেটাকে স্পর্শ না করে; আলোর ওপর আলো। আল্লাহ আপন আলোর প্রতি পথ/দিকনির্দেশনা দান করেন যাকে ইচ্ছা করেন; এবং মানুষের জন্যে আল্লাহ উপমাসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন।” [সূরা নূর, ৩৫ আয়াত]
হযরত কা’আব আল-আহবার (রা:) ও হযরত ইবনে জুবাইর (রা:) বলেন, “দ্বিতীয় ‘নূর’ (আলো) শব্দটি দ্বারা আল্লাহ তাঁর হাবীব (দ:)-কে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর আলোর উপমা’ – অর্থাৎ, মহানবী (দ:)-এর নূর (আলো)।”
সাহল ইবনে আবদিল্লাহ আত্ তুসতুরী (রহ:) বলেন যে পৃথিবীর মানুষ ও আসমানের ফেরেশতাদের জন্যে আল্লাহ হলেন পথপ্রদর্শক; এ আয়াতে তা-ই বোঝানো হয়েছে। এরপর সাহল (রহ:) বলেন, “…রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূরের মতো যখন তা স্থাপিত হয়েছিল কোষার মধ্যে – ঠিক যেন একটি দীপাধারে। প্রদীপ দ্বারা আল্লাহতা’লা বোঝাচ্ছেন নবী করীম (দ:)-এর অন্তরকে। ফানুসটি তাঁরই বক্ষ। এটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র যা এর ধারণকৃত বিশ্বাস ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা সমৃদ্ধ এবং যা একটি বরকতময় তথা আশীর্বাদধন্য গাছ, অর্থাৎ, হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর আলো দ্বারা প্রজ্জ্বলিত। খোদাতা’লা বরকতময় গাছের সাথে তুলনা করেন এবং এরশাদ করেন, ‘সেটার তেল প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠবে’; অর্থাৎ, রাসূলে খোদা (দ:)-এর নবুওয়্যত মানুষের কাছে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর কিছু বলার আগেই, যেমনিভাবে হয়েছে এ তেল।”
এ আয়াতটি সম্পর্কে আরও বহু ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তবে এর মর্মার্থ সম্পর্কে আল্লাহতা’লাই ভালো জানেন।
কুরআন মজীদের অন্যত্র আল্লাহ পাক হুযূর পূর নূর (দ:)-কে নূর (জ্যোতি) এবং প্রোজ্জ্বল তথা আলো বিচ্ছুরণকারী এক প্রদীপ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এরশাদ করেন: “নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে এসেছেন এক নূর (রাসূলে খোদা) ও মহান কেতাব (আল-কুরআন)” [সূরা মা-ইদা, ১৫ আয়াত]। আল্লাহ আরো এরশাদ করেন: “হে অদৃশ্যের সংবাদ দানকারী নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি উপস্থিত পর্যবেক্ষণকারী (হাযের-নাযের) করে, শুভ সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর প্রতি তাঁরই নির্দেশে আহ্বানকারী ও প্রোজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে” [সূরা আহযাব, ৪৫-৬ আয়াত]।
এ কারণেই আল্লাহ পাক বলেন: “আমি কি আপনার (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বক্ষ প্রশস্ত করিনি?” [আল-কুরআন, ৯৪:০১] আরবী ‘শারাহা’ শব্দটির অর্থ প্রশস্ত বা বিস্তৃত করা। ‘সদর’ বা ‘বক্ষ’ শব্দটি দ্বারা আল্লাহতা’লা অন্তর বা হৃদয়কে বুঝিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “তিনি একে প্রশস্ত করেছেন ইসলামের নূর দ্বারা।” সাহল্ আত্ তুসতরী (রহ:) বলেন, “ঐশী বাণীর আলো দ্বারা।” হযরত হাসান বসরী (রহ:) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (দ:)-এর অন্তরকে জ্ঞান ও বিচার-বিবেচনা দ্বারা পরিপূর্ণ করেন।” এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ “আপনার অন্তরকে অামি কি পুতঃপবিত্র করিনি, যাতে তা শয়তানের ওয়াসওয়াসা তথা ধোকায় পড়ে না যায়?”
সূরাটিতে আরো বিবৃত হয়েছে: “এবং আমি আপনার ওপর থেকে আপনার সেই বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যা আপনার পৃষ্ঠ ভেঙ্গেছিল” [সূরা এনশেরাহ, ২-৩ অায়াত]। এ কথা বলা হয়েছে যে এর মানে তাঁর নবুওয়্যত-পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড; এ কথাও বলা হয়েছে এর দ্বারা জাহেলীয়্যা যুগের বোঝাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে এর মানে হলো ঐশী বাণীর বোঝা যা তিনি প্রচার করার আগে তাঁর পিঠকে নুয়ে দিচ্ছিল। এটা আল-মাওয়ার্দী ও আস্ সুলামীর অভিমত। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ, “আমি আপনাকে রক্ষা করেছি, নইলে ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড আপনার পিঠে বোঝা হয়ে বসতো।” এ কথা আস্ সামারকান্দী বর্ণনা করেছেন। [আনুবাদকের নোট: ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেব তাঁর ‘তাফসীরে কানযুল ঈমান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, “এ বোঝা দ্বারা হয়তো ওই দুঃখ বোঝানো হয়েছে যা কাফেররা ঈমান না আনার কারণে তাঁর পবিত্র অন্তরে বিরাজ করতো। কিংবা উম্মতদের পাপসমূহের চিন্তাও হতে পারে যা নিয়ে তাঁর কলব্ (অন্তর) মোবারক সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। এর অর্থ এই যে, ‘আমি আপনাকে মকবূল তথা গ্রহণীয় সুপারিশকারীর মর্যাদা দান করে সেই দুঃখের বোঝা দূর করে দিয়েছি।” (কানযুল ঈমান, বাংলা সংস্করণ, ১০৮৬ পৃষ্ঠা]
আল্লাহ পাক সূরা এনশেরাহ’তে আরো এরশাদ ফরমান: “এবং আমি আপনার জন্যে আপনার যিকর (স্মরণ)-কে সমুন্নত করেছি” [৪র্থ আয়াত]। ইয়াহইয়া ইবনে আদম বলেন এর অর্থ নবুওয়্যত দান। আরও বলা হয়েছে যে এর মানে নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁরই প্রেরিত পয়গম্বর) – এ বাক্যটিতে যখন আমাকে (আল্লাহকে) স্মরণ করা হয়, হে রাসূল (দ:), তখন আপনাকেও তাতে স্মরণ করা হয়।” আরো বলা হয়েছে যে আযানেও একই রকম করা হয়।
এসব কথায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (দ:)-এর প্রতি বর্ষিত আল্লাহতা’লার মহা নেয়ামত (আশীর্বাদ), মহাপ্রভুর পাশে তাঁর মহান মর্যাদা ও আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁর মহাসম্মান সম্পর্কে আল্লাহ স্বয়ং সমর্থনসূচক ভাষ্য প্রদান করেছেন। খোদাতা’লা তাঁর পবিত্র বক্ষকে বিশ্বাস ও হেদায়াতের দিকে প্রশস্ত করেছেন এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার বানিয়েছেন। ’জাহেলীয়্যা’ যুগের সকল বিষয়ের বোঝা তাঁর কাছ থেকে তিনি অপসারণ করেছেন এবং অন্যান্য দ্বীনের ওপর তাঁর দ্বীনকে বিজয় দান করে মহানবী (দ:)-এর কাছে জাহেলীয়্যা যুগের বিষয়গুলো ঘৃণিত করে দিয়েছেন। খোদাতা’লা নবুওয়্যত ও ঐশী বাণীর গুরুদায়িত্বকে প্রিয়নবী (দ:)-এর জন্যে লাঘব করে দিয়েছেন, যাতে তিনি মানুষের কাছে তা-ই পৌঁছে দিতে সক্ষম হন যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি প্রিয়নবী (দ:)-এর সুমহান মর্যাদা, সুউচ্চ মকাম সম্পর্কে নিজ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং তাঁর নামের সাথে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর নাম মোবারককে সংযুক্ত করেছেন।
হযরত কাতাদা (রা:) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীব (দ:)-এর খ্যাতিকে এ দুনিয়ায় এবং পরবর্তী জগতে সমুন্নত করেছেন। এমন কোনো বক্তা, সাক্ষী কিংবা নামাযী নেই, যে না-কি এ বাক্য বলতে ব্যর্থ হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ করেছেন: জিবরীল (আ:) অামার কাছে এসে বল্লেন, আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান – ‘আপনি কি জানেন, আমি আপনার (প্রিয়নবীর) খ্যাতি কতোখানি সমুন্নত করেছি?’ আমি (জিবরীল) বল্লাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-ই ভালো জানেন। আল্লাহ বল্লেন, ‘যখন আমাকে স্মরণ করা হয়, তখন আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হয়।’ [ইবনে হিব্বানের ’সহীহ’ ও আবূ এয়ালার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলোতে উদ্ধৃত]
ইবনে আতা’ একটি হাদীসে কুদসী উদ্ধৃত করেন যা’তে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “আমি আপনার স্মরণকে আমার স্মরণের সাথে যুক্ত করে ঈমান (বিশ্বাস)-কে পূর্ণতা দিয়েছি।” অপর এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক বলেন, “আপনার স্মরণকে আমি আমারই স্মরণের অংশ করেছি, যার দরুন যে কেউ আমাকে স্মরণ করলে আপনাকেও স্মরণ করে।”
হযরত ইমাম জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ সাদেক (রহ:) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে (খোদাতা’লা) প্রভু হিসেবে স্মরণ করে, সে আপনাকে (রাসূলকে) পয়গম্বর হিসেবে স্মরণ না করে পারে না।”
আল-মাওয়ার্দীর মতো কিছু জ্ঞানী পণ্ডিত অভিমত ব্যক্ত করেন যে এর দ্বারা শাফায়াত তথা সুপারিশের মহান মর্যাদা বোঝানো হয়েছে।
আল্লাহতা’লার যিকরের সাথে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর স্মরণ সরাসরি যুক্ত হওয়ার বিষয়টি পরিস্ফুট করে যে আল্লাহতা’লার আনুগত্যের সাথে রাসূলে আকরাম (দ:)-এর আনুগত্য ও তাঁর নামের সাথে প্রিয়নবী (দ:)-এর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “হুকুম মান্য করো আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর” [সূরা আলে ইমরান, ৩২ আয়াত]। অন্যত্র তিনি এরশাদ ফরমান: “হে ঈমানদারবর্গ! ঈমান রাখো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর প্রতি” [সূরা নিসা, ১৩৬ আয়াত]। আল্লাহতা’লা রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে তাঁর সাথে সংযুক্ত করেছেন আরবী ‘ওয়া’ (ও/এবং) শব্দটি দ্বারা, যেটা অংশীদারের অর্থ জ্ঞাপক। নবী করীম (দ:) ভিন্ন অন্য কারো ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে ‘ওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করার অনুমতি নেই।
হুযায়ফা (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের কেউই এরকম বলো না – যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন এবং (ওয়া) অমুক ইচ্ছা করেন। বরং (এ কথা) বলো – যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অতঃপর থেমে বলো – অমুক যা ইচ্ছা করেন।” (আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে আবি শায়বা)
আল-খাত্তাবী বলেন, “মহানবী (দ:) সবার ইচ্ছার ওপরে খোদাতা’লার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার শিক্ষা আপনাদের দিয়েছেন। তিনি ‘সুম্মা’ শব্দটিকে পছন্দ করেছেন যার অর্থ ‘অতঃপর’, আর অংশীদারিত্ব জ্ঞাপক ‘ওয়া’ (এবং) শব্দটি বর্জন করেছেন। অপর একটি হাদীস শরীফে অনুরূপ কথা বলা হয়েছে। কেউ একজন (সাবেত ইবনে কায়েস্ বলে কথিত) রাসূলে খোদা (দ:)-এর দরবারে বলেন, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (দ:)-কে যে ব্যক্তি মান্য করেন, তিনি সঠিক পথপ্রাপ্ত; আর যে ব্যক্তি তাঁদের (‘হুমা’ তথা দ্বিবচন ব্যবহার করে বলেছিলেন) সাথে বিদ্রোহ করে….।” মহানবী (দ:) তাঁকে বলেন, “তুমি কতোই না বাজে বক্তা! ওঠে দাঁড়াও!” (কিম্বা তিনি বলেছিলেন: “বেরিয়ে যাও!”) [আবূ দাউদ, নাসাঈ ও মুসলিম বর্ণিত হাদীস]
আবূ সুলাইমান বলেন, “রাসূলে করীম (দ:) দুটো নামকে ওভাবে সংযুক্ত দেখতে পছন্দ করেননি, কেননা এতে অংশীদারিত্ব বোঝায়।” অপর এক জ্ঞানী পণ্ডিত মনে করেন যে “তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে” বলে থামাকেই মহানবী (দ:) অপছন্দ করেছিলেন। তবে আবূ সুলাইমানের কথাই নির্ভরযোগ্য, কারণ হাদীসটির আরেকটি নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যামূলক বর্ণনায় বিবৃত হয় যে বক্তা (সাবেত ইবনে কায়েস বলে কথিত) “আর যে ব্যক্তি তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে, সে ভুল করে” – এ বাক্যটিতে “তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে” – বাক্যাংশটি বলার পর না থেমেই বাকি অংশ বলেছিলেন।
”নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরুদ পড়েন ওই অদৃশ্য সংবাদ জ্ঞাপনকারী (নবী)-এর প্রতি” (সূরা আহযাব, ৫৬ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের মধ্যে ‘ইউসাল্লুনা’ (বহুবচনে দরুদ পাঠ) শব্দটি খোদাতা’লা এবং ফেরেশতাদের উভয়ের প্রতি আরোপিত কি না, তা নিয়ে তাফসীরবিদ ও শব্দার্থ বিশারদদের বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের কেউ কেউ উভয়ের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহৃত হওয়াকে অনুমতি দেন, আর অন্যান্যরা অংশীদারিত্বের ধারণায় তা নিষেধ করেন। তাঁরা সর্বনামটিকে ফেরেশতাদের প্রতি এককভাবে নির্দেশ করেন এবং আয়াতটিকে এভাবে বোঝেন – “আল্লাহতা’লা দরুদ পড়েন এবং তাঁর ফেরেশতাকুল-ও।”
বর্ণিত আছে যে হযরত উমর ফারূক (রা:) রাসূলে খোদা (দ:)-কে বলেছিলেন, “আল্লাহর সাথে আপনার মাহাত্ম্যের অংশবিশেষ হলো এই যে, তিনি আপনার প্রতি আনুগত্যকে তাঁরই প্রতি আনুগত্য বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: ‘যে ব্যক্তি রাসূল (দ:)-এর নির্দেশ মান্য করেছে, নিঃসন্দেহে সে আল্লাহর নির্দেশ-ই মান্য করেছে’ [সূরা নিসা, ৮০ আয়াত] এবং ‘হে রাসূল (দ:), আপনি বলে দিন: ওহে মানবকুল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমার অনুগত হও; আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন’।” [সূরা আলে ইমরান, ৩১ আয়াত] বর্ণিত আছে যে যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, তখন মানুষেরা বলাবলি করতে শুরু করে, “মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চান খৃষ্টানরা যেভাবে ঈসা (আ:)-কে গ্রহণ করেছিল, ঠিক সেভাবে আমরাও যেন তাঁকে করুণা (রহমত) হিসেবে গ্রহণ করি।” এমতাবস্থায় আল্লাহ আয়াত নাযেল করেন: “হে রাসূল, বলুন: হুকুম মান্য করো আল্লাহ ও রাসূলের (সূরা আলে ইমরান, ৩২ আয়াত) [নোট: এ বর্ণনা ইবনে জাওযীর]। মানুষেরা যা বলাবলি করেছিল, তা সত্ত্বেও আল্লাহতা’লা তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আনুগত্যকে যুক্ত করেছেন।
সূরা ফাতেহার “আমাদেরকে সহজ, সরল পথে পরিচালিত করুন; তাঁদেরই পথে যাঁদের প্রতি আপনি (খোদাতা’লা) অনুগ্রহ করেছেন” – খোদায়ী এ কালামের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদবৃন্দ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আবূল আলীয়্যা (রহ:) এবং হাসান বসরী (রহ:) বলেন, “সহজ, সরল পথ (সিরাতাল মোস্তাকীম) হলেন মহানবী (দ:), তাঁর আহলে বায়ত (ঘরের মানুষজন তথা আত্মীয়স্বজন) এবং তাঁরই আসহাবে কেরাম (সম্মানিত সাথীবৃন্দ)।” আবূল আলীয়্যা ও হাসান বসরী থেকে আল-মাওয়ার্দী বর্ণনা করেন, “সহজ, সরল পথ হলেন রাসূলে পাক (দ:), তাঁর ঘরের শ্রেষ্ঠজনেরা এবং তাঁরই সাথীবৃন্দ।” অনুরূপ বর্ণনা করেন মক্কী: “এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (দ:) ও তাঁর দু’জন সাহাবী হযরত আবূ বকর (রা:) এবং হযরত উমর ফারূক (রা:)-কে ইঙ্গিত করে।”
”তাঁদেরই পথে, যাঁদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন” – খোদায়ী এ কালামটি সম্পর্কে আবুল আলীয়্যা হতে আবূল লায়েস্ সামারকান্দী প্রায় অনুরূপ আরেকটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। হযরত হাসান বসরী (রহ:) এটা শোনার পর বলেন, “আল্লাহর নামে শপথ! এ কথা সত্য এবং এটা সৎ উপদেশ।” “তাঁদেরই পথে যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন” – এ আয়াতটির তাফসীরে আবদুর রাহমান ইবনে যায়দ হতে আল-মাওয়ার্দী এটা বর্ণনা করেন।
আবূ আব্দির রাহমান আস্ সুলামী বর্ণনা করেন যে জনৈক তাফসীরবিদ “সে এমন এক মজবুত গ্রন্থি ধারণ করেছে” (সূরা বাকারা, ২৫৬ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের মধ্যে ‘মজবুত গ্রন্থি’ – বাক্যটিকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (দ:) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ দ্বীন ইসলাম। আরো বলা হয়েছে যে এতে তাওহীদের সাক্ষ্য (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই) বিদ্যমান।
সাহল্ আত্ তুসতরী বলেন যে “যদি আল্লাহর অনুগ্রহসমূহ গণনা করো, তবে সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না” (আল-কুরঅান, ১৪:৩৪) – আল্লাহতা’লার এ বাণীর উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলে খোদা (দ:)-এর অনুগ্রহ।
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “এবং তিনি-ই, যিনি এ সত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন এবং ওই সব মানুষ, যাঁরা তাঁকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাঁরাই আল্লাহভীতিসম্পন্ন।” (সূরা যুমার, ৩৩ আয়াত)। অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, “তিনি-ই একে সত্যায়ন করেছেন।” কখনো কখনো এ শব্দটিকে ‘সাদাকা’ (সত্য ভাষণ) পড়া হয়; আবার কখনো কখনো ‘সাদ্দাকা’ (সত্যায়ন) পাঠ করা হয়, যার দরুন মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের উদ্দেশ্য করা হয়। এ কথা বলা হয়েছে যে এতে হযরত আবূ বকর (রা:)-কে বোঝানো হয়েছে। আরো অনেক কথা এ বিষয়ে বলা হয়েছে।
মোজাহিদ (রা:) বলেন, “আল্লাহর স্মরণেই অন্তরের প্রশান্তি নিহিত” (সূরা রা’দ, ২৮ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের উদ্দেশ্য হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ (দ:) ও তার আসহাবে কেরাম (রা:)।
Leave a Reply