মওলিদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন ও অনুমতি (প্রথম অধ্যায়)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Shaykh Tahirul Qadri’s book “Mawlid al-Nabi: Celebration and Permissibility. Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

[উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ হযরতুল আল্লামা সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে…]

প্রথম অধ্যায়

মওলিদুন্নবী (দ:) ও ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন: সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের আলোকে

আমাদের আকীদা-বিশ্বাস, ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক জীবন যিকরের ধারণাকে ঘিরে আবর্তমান, যার অর্থ ‘স্মরণ করিয়ে দেয়া’, ‘স্মরণ করা’ এবং ‘স্মৃতিরক্ষামূলক কর্ম দ্বারা স্মরণীয় করে রাখা (বা উদযাপন করা)’। আমাদের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ও লেনদেন, কথাবার্তা/ভাষণ, উপলব্ধি এবং আমাদের জীবনের সমস্ত বিষয়-ই সেই জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ যা আমরা অর্জন করেছি এবং নিজেদের মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করেছি। এভাবে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি ধাপ আমাদের স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়েছে, আর এই স্মৃতি-ই আমাদেরকে জীবন চলার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ, কারো সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করে ওই ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত আমাদের স্মৃতির ওপর; আর এরই ভিত্তিতে আমাদের আচার-ব্যবহার ও আচরণ গড়ে ওঠে। স্মৃতিশক্তি ছাড়া কোনো বিষয় সম্পর্কেই বিচার-বিবেচনা করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়; এমন কি আমরা শত্রু হতে মিত্রকে আলাদাভাবে চিনতেও সক্ষম নই। এমতাবস্থায় আমাদের জীবন একদম এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। অতএব, আমাদের সজ্ঞান সচেতনতা আমাদেরই অন্তর্নিহিত স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভরশীল।

১.১ আল-কুরআনের প্রদর্শিত হেদায়াত হিসেবে ‘যিকরের’ তাৎপর্য

মানবজাতির প্রতি দানকৃত আল-কুরআনের হোদায়াত (পথপ্রদর্শন)-এর ভিত্তিস্তম্ভ ‘স্মরণ’ করার (ঐশী) আজ্ঞার ওপরই ভিত্তিশীল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহতা’লা ও তাঁর সর্বশেষ নবী (দ:)-এর প্রতি ঈমান রাখেন, তাঁকে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার অবতীর্ণ পূর্ববর্তী ও বর্তমান হেদায়াতগুলোতে একযোগে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে:

“এবং তারাই, যারা ঈমান আনে সেটার ওপর, যা, হে মাহবূব, আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে, আর পরলোকের প্রতি (যারা) বিশ্বাস রাখে।” [আল-ক্বুরআন, ২:৪]  

এখানে ‘স্মরণের’ ভিত্তিতে পূর্ববর্তী ধর্মীয় শাস্ত্রলিপিগুলোর স্বীকৃতিকে এবং তৎপরবর্তী পর্যায়ে ওই স্মৃতি নিজের সারা জীবনে সংরক্ষণ করাকে ঈমানের পূর্ণতা লাভের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

কেউ যখন কোনো কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য করে, সে তখন তা করে তারই (মস্তিষ্কে) জমানো তথ্য অনুসারে। ভালোবাসা, ভয়, বিনয় ও সমর্পণের মতো আবেগ আমাদেরই সংরক্ষিত স্মৃতির দ্বারা আকার-আকৃতি পায়। যদিও এগুলো অন্তরের সাথে জড়িত ভাবানুভূতি, তবুও সংঘটিত মানসিক প্রক্রিয়াগুলো না হলে এগুলোর অস্তিত্ব কোনোভাবেই থাকতো না। অতএব, স্মৃতিশক্তি হচ্ছে আল্লাহতা’লার তরফ থেকে এক বড় নেয়ামত তথা আশীর্বাদ।

(মক্কার) মুশরিকদেরকে প্রকৃত বিশ্বাসের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো হলে তারা আপন বৈশিষ্ট্যগত উত্তর দিতো, “আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট।” আরেক কথায়, তারা নিজেদের শেকড় কেটে ফেলতে অনিচ্ছুক ছিল। নিম্নবর্ণিত আয়াতে এই ধরনের অবিশ্বাসীদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে তাদের পূর্বপুরুষরা ভুল পথ বেছে নেয়ার কারণেই লয়প্রাপ্ত হয়েছিল এবং তাই তাদের পূর্ববর্তীদেরকে যে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল, সেই সত্যের দাওয়াত তাদের কবূল করা উচিত। তবে তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ফলশ্রুতিতে নিজেরাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কুরআন মজীদ এ বিষয়ে ঘোষণা করে:

“অতঃপর আমি (খোদা) তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গিদেরকে স্বীয় এক মহা দয়াস্বরূপ উদ্ধার করেছি এবং যারা আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করতো তাদেরকে নির্মূল করেছি। আর তারা (কখনো) ঈমান গ্রহণকারী হবার ছিল না।” [আল-ক্বুরআন, ৭:৭২]  

এই আয়াতে করীমায় (মক্কার) অবিশ্বাসীদেরকে ‘স্মরণ করিয়ে’ দেয়া হয়েছে যে তাদের পূর্বপুরুষরা ভুল পথ বেছে নিয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। অতএব, অবিশ্বাসীরা যেন অবতীর্ণ এই হেদায়াতকে গুরুত্বসহ গ্রহণ করে এবং পূর্ববর্তীদের মতো একই ভুল না করে বসে। অনুরূপভাবে, মুসলমানবৃন্দ-ও পূর্ববর্তী নবী-রাসূল (আ:)-মণ্ডলীর প্রতি অবতীর্ণ ঐশী বাণীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য রয়েছেন, যেহেতু সেসব ওহী আল-কুরআনেরই অনুরূপ বার্তা বহন করেছিল। তাই কুরআন মজীদকে সত্য বলে স্বীকার করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পূর্ববর্তী ওহীগুলোকে স্বীকার করাও তদনুরূপ।

১.২ পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর দ্বীন (ধর্ম)

আমাদের (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) পূর্ববর্তী পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দকে স্মরণ করা এবং তাঁদের নবুওয়্যতে বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের ঈমানেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সঙ্গত কারণেই আল-কুরআন বিভিন্ন আয়াতে ইসলাম ধর্মকে ‘মিল্লাত-এ-ইবরাহীম’ (ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের ধর্ম) বলে উল্লেখ করেছে। এরশাদ হয়েছে:

১/ “এবং ইব্রাহীমের দ্বীন থেকে কে বিমুখ হবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে অন্তরের (দিক দিয়ে) নির্বোধ? আর অবশ্যঅবশ্য আমি পৃথিবীতে তাকে মনোনীত করে নিয়েছি; এবং নিশ্চয় তিনি পরকালে আমার খাস্ নৈকট্যের উপযোগীদের অন্তর্ভুক্ত।” [আল-কুরআন, ২:১৩০; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (রহ:)-এর কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]

২/ “এবং কিতাবীরা বল্লো, ‘ইহুদী কিংবা খৃষ্টান হয়ে যাও, সঠিক পথ পাবে!’ (হে হাবীব!) আপনি বলুন, ’বরং আমি তো ইব্রাহীমের দ্বীনকেই গ্রহণ করছি, যিনি সব রকমের বাতিল থেকে মুক্ত ছিলেন; আর তিনি তো ছিলেন না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত’।” [আল-কুরআন, ২:১৩৫]

৩/ “আপনি বলুন, ‘আল্লাহ সত্যবাদী। কাজেই ইব্রাহীমের দ্বীনের ওপর চলো, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে আলাদা ছিলেন এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।” [আল-কুরঅান, ৩:৯৫]

৪/ “এবং ওই ব্যক্তির চেয়ে কার দ্বীন উত্তম, যিনি আপন চেহারা আল্লাহর জন্যে ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন এবং তিনি হন সৎকর্মপরায়ণ; এবং (তিনি) ইব্রাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করেছেন, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন? এবং আল্লাহ ইব্রাহীমকে আপন ঘনিষ্ঠ বন্ধুস্বরূপ গ্রহণ করেছেন।” [আল-কুরআন, ৪:১২৫]

৫/ “আপনি বলুন, ‘নিশ্চয় আমার রব্ব (প্রভু) আমাকে সোজা (সহজ, সরল) পথ দেখিয়েছেন; সঠিক দ্বীন, ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ, যিনি সমস্ত বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন এবং মুশরিক ছিলেন না’।” [আল-কুরআন, ৬:১৬১]

৬/ “অতঃপর আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি যে ‘ইব্রাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করুন, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন এবং মুষরিক ছিলেন না’।” [আল-কুরআন, ১৬:১২৩]
৭/ “এবং আল্লাহর পথে জ্বেহাদ করো যেভাবে করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি দ্বীনের ব্যাপারে কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি; তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের দ্বীন; আল্লাহ তোমাদের নাম ‘মুসলমান’ রেখেছেন পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে এবং এ ক্বুরআনে, যাতে রাসূল তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন এবং তোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও। সুতরাং নামায ক্বায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধরো। তিনি তোমাদের অভিভাবক – কতোই উত্তম অভিভাবক এবং কতোই উত্তম সাহায্যকারী!” [আল-কুরআন, ২২:৭৮]

আল-কুরআনের ওপরোল্লিখিত আয়াতগুলো প্রত্যেককে পয়গম্বর ইব্রাহীম (আ:)-এর দ্বীনের ওপর অটল, অবিচল থাকতে আদেশ করে। পয়গম্বর ইউসূফ (আ:) কয়েদখানায় তাঁর সাথী দুই জনের স্বপ্নগুলো ব্যাখ্যা করার আগে অনুরূপ ধর্মীয় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন: “এবং আমি আপন পিতৃপুরুষবৃন্দ – ইবরাহীম, ইসহাক্ব, ও ইয়া’ক্বুবের ধর্মকে গ্রহণ করেছি।”[সূরা ইউসূফ, ৩৮ আয়াত]

এই আয়াতে করীমায় পূর্ববর্তী পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের যিকর তথা তাঁদের এবং তাঁদের উম্মতদের বিবরণ স্মরণ করাটা ধর্মের মৌলিক নীতিমালার একটি নীতি হিসেবে প্রণীত হয়েছে; আর এটা আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর অনুশীলিত আচার-ও। আল-কুরআন ঘোষণা করে: “নিঃসন্দেহে, হে মাহবূব! আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন ওহী নূহ ও তাঁর পরবর্তী আম্বিয়াবৃন্দের প্রতি প্রেরণ করেছি।” [আল-কুরআন, ৪:১৬৩]

পূর্ববর্তী উম্মতদের পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলীর বিবরণগুলো স্মরণ করা এবং হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর দ্বীন সম্পর্কে জানার বিষয়টি ঈমানদারদের অন্তর ও মস্তিষ্ককে আলোকোজ্জ্বল করার একটি উৎস। এটা তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।

’যিকর’ (স্মরণ) একটি ব্যাপক বিষয়, যার জন্যে (আলাদা) একটা গোটা বই উৎসর্গ করা প্রয়োজন। স্মরণ ( ও উদযাপন) প্রত্যেক মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে প্রভাব ফেলে থাকে, তা অনুধাবন করেই আল-কুরআন আমাদের মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করে। এই বিষয়ে যিকর তথা স্মরণের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব শব্দ কুরআন মজীদে ব্যবহৃত হয়েছে, তা যাচাই করাটাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট হবে। ‘যিকর’ শব্দটি এই মহাগ্রন্থে আনুমানিক ২৬৭ বার উচ্চারিত হয়েছে, আর এর উদ্দিষ্ট অর্থ – ‘স্মরণ করা’, ‘স্মরণ করানো’ এবং ‘সংরক্ষণ করা’; এটা উপদেশ ও সতর্ক করার বেলায়ও ব্যবহৃত হয়েছে। খোদ আল-কুরআনকেই ‘আল-যিকর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, ‘আল-নিসইয়ান’ শব্দটি কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে যিকরেরবিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হলো, ‘ভুলে যাওয়া’, ‘ভুলে যাওয়ার কারণ হওয়া’, ‘কোনো কিছুকে তাৎপর্যহীন বলে অবহেলা করা’, এবং ‘কোনো কিছুকে পরিত্যাগ করা’। [আল-ফারাহিদী কৃত ‘কিতাবুল আইন‘, ৭:৩০৪-৫; ইবনে মানযূর প্রণীত ‘লিসান আল-আরব’, ১৫:৩২২-৩; এবং ফায়রোয আবাদী, ‘আল-কামূস আল-মুহীত’, ৪:৩৯৮]  

আল্লাহতা’লা মানুষের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে যেসব (ঐশী) শিক্ষা যুগে যুগে প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলোর নির্যাস ছিল এক ও অভিন্ন; তথাপি মনুষ্য হাতের কারসাজিতে বিকৃতি সাধিত হয়ে সেগুলোর মর্মবাণী হারিয়ে গিয়েছিল। কুরআন মজীদ তাই নিজস্ব হেদায়াতকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে আপন বার্তাকে পুনঃ পুনঃ ব্যক্ত করেছে; এমন কি মহাগ্রন্থের অভ্যন্তরে অবস্থিত আদেশ-নিষেধও ঘনঘন পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, যদিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে পাঠকের মস্তিষ্কে তাজা রাখাই উদ্দেশ্য। এ উপায়ে এর তাৎপর্য সম্পর্কে অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার উদ্দেশ্যটি সাধিত হয়, যার ফলে এর বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রেও প্রত্যেককে সচেতন করে তোলা হয়।
এটা মনে রেখেই এবাদত-বন্দেগীর বিষয়গুলো কীভাবে নবুওয়্যতের প্রচেষ্টাসমূহের উদযাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট, তা পরবর্তী অধ্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। উপরন্তু, তাতে আরো ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের জীবনে খুশি-আনন্দ ও দুঃখ-বেদনার ঘটনাগুলো আমাদের মাঝে মানবতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধকে আবার ফিরিয়ে এনে থাকে।

পরিচ্ছেদ – ১

আম্বিয়া (আ:)-এর স্মরণে (যিকরে): পাঁচ ওয়াক্ত নামায

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান মওলিদুন্নবী (দ:)-এর ভিত্তিতে ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফকে উদযাপন করে থাকেন। তাঁরা আপন অাপন পন্থায় বিশ্বজগতের প্রতি (খোদাতা’লার) মহা করুণা আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি তাঁদের ধর্মীয় আবেগপূর্ণ ভালোবাসা ও ভক্তি এই দিনে ব্যক্ত করে থাকেন। এধরনের ঘটনার উদযাপন এমন-ই একটি বিষয় যা ইসলামের নিদর্শন হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।

ইসলাম ধর্মের ভিত্তিস্তম্ভ নিহিত রয়েছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম করার মধ্যে। এটা প্রত্যেক মুসলমানের ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য, আর ঈমানদারি ও অবিশ্বাসের মাঝে পার্থক্যকারী উপাদান-ও। এসব প্রার্থনা মূলতঃ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই এক স্মরণীয় উদযাপন, যা আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে পালন করা হয়েছিল। মহান আল্লাহ পাক এসব আমলকে এতোই মূল্যায়ন করেছিলেন যে তিনি এই স্বেচ্ছা-প্রণোদিত প্রার্থনাগুলোকে ঐশী আজ্ঞা দ্বারা হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের উম্মতের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন।

ইমাম আল-তাহাবী (হিজরী ২২৯-৩৩১ সাল) পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আয়েশা (রহ:)-এর একটি বক্তব্য বর্ণনা করেন তাঁরই রচিত ‘শারহ মা’আনী আল-আসা’র’ গ্রন্থে, যা’তে তিনি উল্লেখ করেন:

১.৩ ফজরের নামায: পয়গম্বর আদম (আ:)-এর স্মরণে  

ভোরে (ফজরের ওয়াক্তে) পয়গম্বর আদম আলাইহিস্ সালামের তওবা যখন কবূল করা হয়, তখন তিনি দুই রাক’আত নামায (কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে) আদায় করেন; ফলে এটা ফজর ওয়াক্তের নামায হিসেবে পরিণত হয়।

১.৪ যোহরের নামায: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর স্মরণে

পয়গম্বর ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম দুপুরে তাঁর পুত্র পয়গম্বর এসহাক্ব আলাইহিস্ সালামের জন্ম দ্বারা আশীর্বাদধন্য হলে চার রাক’আত নামায আদায় করেন; ফলে এটা যোহর ওয়াক্তের নামায হিসেবে পরিণত হয়।

১.৫ আসরের নামায: পয়গম্বর উযায়র (আ:)-এর স্মরণে

পয়গম্বর উযায়র আলাইহিস্ সালামকে এক ’শ বছর পরে পুনরুত্থিত করে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কতোকাল তুমি এই অবস্থায় ছিলে?’ তিনি আরয করেন, ‘একদিন বা তার কিয়দংশ।’ অতঃপর তিনি চার রাক’আত নামায (শোকরানা) নামায আদায় করেন। এটাই ’আসর ওয়াক্তের নামায হিসেবে পরিণত হয়।

১.৬ মাগরেবের নামায: পয়গম্বর দাউদ (আ:)-এর স্মরণে

বর্ণিত আছে যে সর্ব-পয়গম্বর উযায়র (আলাইহিস্ সালাম) ও দাউদ (আলাইহিস্ সালাম)-কে সূর্যাস্তের সময় ঐশী ক্ষমা মঞ্জুর করা হয়। তাঁরা চার রাক’আত নামায আদায় করার নিয়্যত করেছিলেন, কিন্তু (শারীরিক) দুর্বলতা বা ক্লান্তির কারণে তৃতীয় রাক’আত-শেষে বসে থাকেন (নামায পুরোপুরি সম্পন্ন করতে অক্ষম হয়ে)। ফলে এটা মাগরেব ওয়াক্তের নামায হিসেবে পরিণত হয়, যা তিন রাক’আতবিশিষ্ট।

১.৭ ’এশার নামায: মহানবী (দ:)-এর স্মরণে

’এশা’র নামায, যেটা দিনের সর্বশেষ প্রার্থনা, সেটা যিনি সর্বপ্রথম আদায় করেন তিনি হলেন আমাদের মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। [ইমাম আল-তাহাবী কৃত ‘শারহ মা’আনী আল-আসা’র’: কিতাব আস্ সালাহ (নামাযের বই), অধ্যায়: ‘মধ্য প্রার্থনা তথা নামায’, ১:২২৬ #১০১৪]

এই দুই এবং চার রাক’আত নামায, যেগুলো সম্মানিত পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দ কর্তৃক আল্লাহতা’লার দয়া ও করুণার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আদায় করা হয়েছিল, সেগুলো তাঁদের নবুওয়্যত (প্রচার-প্রতিষ্ঠার) মিশন বাস্তবায়ন  প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ স্মরণের আমলস্বরূপ বিবেচিত হয়েছে। ফলে আল্লাহতা’লা এসব নামাযের মাধ্যমে সারাটা দিন আমাদেরকে তাঁরই নবী-রাসূল (আ:)-মণ্ডলীর স্মৃতি নিয়মিতভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

একই প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আবেদীন শা’মী (১২৪৪-১৩০৬ হিজরী) তাঁর রচিত ‘রাদ্দ আল-মোহতার ‘আলা দুর্র আল-মোখতার’গ্রন্থে লিখেন:

কথিত আছে, ফজরের নামায পয়গম্বর আদম (আ:)-এর; যোহর পয়গম্বর দাউদ (আ:)-এর; আসর পয়গম্বর সোলাইমান (আ:)-এর; মাগরেব পয়গম্বর এয়া’ক্বুব (আ:)-এর; আর ‘এশা পয়গম্বর ইয়াহইয়া (আ:)-এর; অতঃপর এসব নামাযের সবগুলো এই উম্মতের জন্যে একত্রিত করা হয়েছে। [ইবনে আবেদীন, রাদ্দ আল-মোহতার ‘আলা দুর্র আল-মোখতার ‘আলা তানউইর আল-আবসার, ১:৩৫১]

এই পবিত্র মুহূর্তগুলো, যেগুলোতে আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ তাঁদের প্রভু খোদাতা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা, বিনয় ও সমর্পণের (আত্মিক) অবস্থায় ছিলেন, সেগুলোকে তিনি (বাধ্যতামূলক) এবাদত-বন্দেগী হিসেবে ঐশী বিধান জারি করেন; যে বিধান সর্বশেষ পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই উম্মতের জন্যে আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও তাঁরই অসীম করুণা অর্জনের এক মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই প্রসিদ্ধ আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মকবূল তথা (আল্লাহর দরবারে) গ্রহীত এসব এবাদত-বন্দেগী আমাদের মহানবী (দ:)-এর মধ্যস্থতায় এই উম্মতের প্রতি চিরকাল স্মরণ করার আমল হিসেবে মঞ্জুর করা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয়াদিতে যিকর তথা স্মরণ করার গুরুত্বের ব্যাপারে এর চেয়ে আর বড় প্রমাণ কী হতে পারে এই মর্মে যে, ইসলামের বুনিয়াদি স্তম্ভগুলোর মধ্যে মৌলিক একটি স্তম্ভ, অর্থাৎ, পাঁচ ওয়াক্ত নামায-ই হচ্ছে পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের যিকর-তাযকেরা’র ব্যবহারিক এক বহিঃপ্রকাশ?

অতএব, পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে যিকর-তাযকেরা’র আমল বা ঘটনা যেগুলো আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়েছে, সেগুলো কেবল অনুমতিপ্রাপ্ত-ই নয়, বরং সেগুলো ইসলামী চিন্তা-ভাবনা ও দর্শনেরই মৌলভিত্তি। মওলিদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন আল্লাহতা’লার মাহবূব (প্রেমাস্পদ) ও সেরা সৃষ্টি এবং আম্বিয়াকুল শিরোমণি হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ধরাধামে শুভাগমনের স্মরণ বৈ কিছু নয়। এটা এমন-ই এক উদযাপনের নজির যা পুরোপুরি জায়েয এবং আল্লাহতা’লার ঐশী বিধানের সাথে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।

পরিচ্ছেদ – ২

আম্বিয়া (আ:)-এর স্মরণে (যিকরে): হজ্জ্বের বিভিন্ন রীতি ও প্রথা

ঈমানের ঘোষণা ও নামাযের পরে হজ্জ্ব হলো ইসলাম ধর্মের তৃতীয় ভিত্তিস্তম্ভ। হজ্জ্বের মৌলিক বাধ্যবাধকতা এবং এর প্রথাগুলো বাস্তবিকপক্ষে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:), পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:) ও মা হাজেরা (রা:)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া শৌর্যবীর্যময় ঘটনাগুলোরই উদযাপন।

এই দুই আম্বিয়া (আ:) ও মা হাজেরা (রা:)-এর অটল, অবিচলভাব, নিরন্তর সাধনা ও ত্যাগের স্মৃতি বজায় রাখতে আল্লাহতা’লা উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় এবাদত-বন্দেগী হিসেবে আদেশ করেছেন। পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মুসলমান এসব সাধনাকে স্মরণ করতে প্রতি বছর (হজ্জ্বের মওসূমে) মক্কা মোয়াযযমায় সমবেত হন এবং এরই ফলশ্রুতিতে আল্লাহতা’লার রেযামন্দি (সন্তুষ্টি) হাসিল করেন। আল্লাহতা’লা তাঁর আশীর্বাদধন্য প্রিয় বান্দাদের একনিষ্ঠ ও পরম ভালোবাসাপূর্ণ এই ভক্তিমূলক আমল (পুণ্যদায়ক কর্ম)-গুলোর স্মৃতিকে চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করেছেন এবং তিনি ঘোষণা করেছেন যে এগুলো তাঁরই নিদর্শন (আয়াত)।

মক্কা মোয়াযযমায় অবস্থিত পবিত্র কা’বা শরীফ মসজিদচত্বরে প্রবেশ করলে (অন্তরে) ভক্তি ও প্রেম জাগ্রত হয় এবং অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে, যার ফলশ্রুতিতে অন্তরের প্রশান্তি দেখা দেয়। এই পবিত্র স্থানে পদার্পণ করে আল্লাহর বান্দা-সকল মহান প্রভুর ঘর তাওয়াফ (চারদিক প্রদক্ষিণ) করেন এবং ধর্মীয় আবেগসহ মানুষের ভিড় ঠেলে কালো পাথরের দিকে অগ্রসর হতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন, যাতে সেটাকে স্পর্শ ও চুম্বন করা যায়। অতঃপর বান্দা ‘সাঈ’ (সাফা মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দ্রুত হাঁটাহাঁটি) করতে যান। যিলহাজ্জ্ব মাসের নবম দিনে প্রত্যেক হাজ্বী সাহেব/সাহেবা আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন; সেখানে যোহরআসর ওয়াক্তের নামাযগুলো একত্রে পড়া হয়। মোযদালিফা নামের জায়গায় মাগরেব ‘এশা ওয়াক্তের নামাযগুলো ’এশা’র সময় একত্রে পড়া হয়। অতঃপর মিনা’তে ‘রামী’ তথা কঙ্কর নিক্ষেপ করা হয়, যা শেষ করে পশু কোরবানী দেয়া হয়।

এসব ধর্মীয় প্রথার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলেও এগুলোর উদযাপন ধর্মীয় আবেগ ও ভক্তিরই প্রতিফলন করে। মানব মস্তিষ্ক হয়তো বারংবার এসব প্রথার যুক্তিসঙ্গত কারণ তালাশ করতে পারে, কিন্তু কোনো যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যাতেই সদুত্তর মেলে না। অপর পক্ষে, একই প্রশ্ন যদি কারো আবেগের সামনে স্থাপন করা হয়, তবে এর উত্তরে হজ্জ্বের এসব প্রথার পেছনে যুক্তি দেখানো হবে এই যে, এতে ভক্তি ও ভালোবাসারই এক গোপন ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।
সর্বশক্তিমান খোদাতা’লা তাঁর প্রিয় বান্দাদের এই ভক্তিমূলক আচরণকে এতোখানি কবূল করেছেন যে তিনি শেষ বিচার দিবস অবধি তাঁদের এই সাধনাকে অনুশীলনীয় এবাদত-বন্দেগী হিসেবে পালনের নির্দেশ জারি করেছেন। হজ্জ্বের আকারে এই (আধ্যাত্মিক) সাধনার পুনঃপুনঃ অনুশীলন প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহতা’লার ওই সমস্ত আশীর্বাদধন্য পুণ্যবান বান্দাদেরকে স্মরণ করারই একটি রীতি। তাই হজ্জ্ব হলো মূলতঃ (প্রিয় বান্দাদের) এক স্মৃতিচারণমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

আল্লাহর আশীর্বাদধন্য প্রিয় বান্দাদের (পুণ্যদায়ক) কর্ম, এবাদত-বন্দেগী ও কার্যকলাপের স্মৃতির প্রতি হজ্জ্বের রীতিনীতি বাস্তবে কীভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন হতে পারে তা এই অধ্যায়ে প্রকাশ করা হবে। অনুরূপভাবে, পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ও মা হাজেরা (রা:) তাঁদের আমল (পুণ্যদায়ক কর্ম) এমনভাবে পালন করেছিলেন যার দরুন আল্লাহতা’লা তা সম্মানিত করেন এভাবে যে, সর্বশেষ নবী (দ:)-এর উম্মতবৃন্দ তা হজ্জ্বের রীতি হিসেবে আমল করবেন। হজ্জ্বের এই প্রথা যেগুলো যিলহজ্জ্ব মাসের ৮ম হতে ১৩তম দিবসের মধ্যে পালন করা হয়, সেগুলো সম্পর্কে নিচে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া হলো:

১.৮ এহরাম: হজ্জ্বে আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের পরিধেয় বস্ত্রের স্মরণে

হজ্জ্ব ও উমরাহ পালনের ক্ষেত্রে ‘এহরাম’ (বস্ত্র) বাঁধা হলো একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। কা’বা ঘর যে ব্যক্তি তাওয়াফ করবেন, তাঁর জন্যে এটা পরিধান করা অত্যাবশ্যক। আল্লাহ পাকের আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ হজ্জ্বের সময় যে বস্ত্র পরতেন, এই দুইখানি কাপড় ওই একই পরিচ্ছদ। আল্লাহতা’লা (তাঁদের) এই বসন এতোই পছন্দ করেছেন যে তিনি হাজ্বী সাহেবদের জন্যে নিজেদের গতানুগতিক জামাকাপড় ছেড়ে ওই দুই ফালি কাপড় পরাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। এই একই দু টুকরো কাপড় গায়ে দিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে থেকে আগত হাজ্বী সাহেবান সত্তরজন পয়গম্বর (আ:)-এর নিজ নিজ নবুওয়্যতকালে এহরাম হিসেবে পরিধানকৃত বস্ত্রের ওই প্রথাটি-ই চর্চা করে থাকেন। নিচে বর্ণিত হাদীসগুলো এই বিষয়টিকে খোলাসা করেছে:

১. হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা:) মহানবী (দ:)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “সত্তরজন পয়গম্বর (আ:) আল-রাওহা (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী উপত্যকা)-এর পাথরগুলো পার হন; এঁদের মধ্যে ছিলেন পয়গম্বর মূসা (আ:) যিনি একটি বস্ত্রাবৃত অবস্থায় ও খালি পায়ে আল্লাহতা’লার প্রাচীন ঘরে পৌঁছেন।” [ইমাম আবূ ইয়া’লা কর্তৃক নিজ ‘আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণিত, ১৩:২০১ ও ২৫৫ #৭২৩১ ও #৭২৭১; হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) হতেও ইমাম আবূ ইয়া’লা প্রণীত ’আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে, ৭:২৬২ #৪২৭৫; ইমাম দায়লামী রচিত ‘আল-ফেরদৌস বি-মা’সূর আল-খিতা’ব, ৩:৪৩৩ #৫৩২৮; আবূ নুয়াইম লিখিত ‘হিলইয়া’ আল-আউলিয়া’ ওয়া তাবাক্বা’ত অাল-আসফিয়া’, ১:২৬০; ইমাম আল-মুনযিরী নিজের কৃত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শারীফ’, ২:১১৮ #১৭৩৯ গ্রন্থে বলেন যে এই হাদীসের এসনাদ সম্পর্কে কোনো আপত্তি-ই উত্থাপিত হয়নি; ইমাম ইবনে আসাকির-ও এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেন নিজ ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’ ২১:১৬৬ পুস্তকে; আর ইমাম আল-হায়সামী এটা বর্ণনা করেন আপন ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’আ আল-ফাওয়াঈদ’, ৩:২২০ কিতাবে]    

২. পয়গম্বর মূসা (আ:)-এর ‘এহরাম’ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান, “আমি যেন দেখলাম (পয়গম্বর) মূসা বিন ‘এমরা’ন (আ:) এই উপত্যকায় দুটি ‘ক্বাতওয়া’নী’ (সাদা) বস্ত্র পরেছিলেন।” [ইমাম আবূ ইয়া’লা প্রণীত ‘আল-মুসনা’দ’, ৯:২৭ #৫০৯৩; আল-তাবারানী কৃত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ১০:১৪২ #১০,২৫৫; আল-তাবারানী রচিত ‘আল-মু’জাম আল-আওসাত’, ৬:৩০৮ #৬৪৮৭; আবূ নু’য়াইম লিখিত ‘হিলইয়া আল-আউলিয়া ওয়া তাবাক্বা’ত আল-আসফিয়া’, ৪:১৮৯; আল-মুনযিরী তাঁর প্রণীত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১১৮ #১৭৪০ গ্রন্থে বলেন যে আবূ ইয়া’লা ও আল-তাবারানী এই হাদীসটি ’হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন; আল-হায়সামীও তাঁর কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’আ আল-ফাওয়াঈদ’, ৩:২২১ পুস্তকে বিবৃত করেন যে আবূ ইয়া’লা ও আল-তাবারানী ’হাসান’ সনদে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন]
৩. ইমাম আযরাক্বী (জন্ম: ২২৩ হিজরী) সর্বপ্রথম মক্কা মোয়াযযমার একখানি ইতিহাসগ্রন্থ সংকলন করেন, যা ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি নিজস্ব এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:)-এর কথা, যিনি বলেন: “সত্তরজন পয়গম্বর (আ:) হাজ্বী হয়ে আল-রাওহা’র গিরিপথ পেরিয়েছিলেন; তাঁরা পরেছিলেন ‘সূফ’ (পশমী বস্ত্র)।” [ইমাম আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৭১-৭২]

. হজ্জ্বের অনুষ্ঠানে পয়গম্বর মূসা (আ:)-এর পরিচ্ছদ সম্পর্কে সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)-এর শিষ্য ইমাম মুজাহিদ ইবনে জুবাইর (রহ:) বলেন: “পয়গম্বর মূসা (আ:) একটি লাল উটের ওপর চড়ে হজ্জ্ব পালন করেন। তিনি আল-রাওহা (এলাকা) অতিক্রম করেন দুটি ’ক্বাতাওয়া’নী’ (সাদা) বস্ত্র গায়ে; এর একটি শরীরের নিম্নভাগ আচ্ছাদনকারী বস্ত্র ছিল, আর অপরটি তাঁর দেহ মোবারককে আবৃত করেছিল। তিনি (এ সময়) কা’বা শরীফকে তওয়াফ (অর্থাৎ, চারদিক প্রদক্ষিণ) করেন।” [প্রাগুক্ত ইমাম আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৭]

. আরেকটি রওয়ায়াত তথা বর্ণনায় সর্ব-পয়গম্বর হূদ (আ:) ও সা’লেহ (আ:)-এর এহরা’ম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে কোনো এক হজ্জ্ব (মওসূমে) মহানবী (দ:) ‘আসফান উপত্যকা অতিক্রম করার সময় জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে আবূ বকর, এটা কোন্ উপত্যকা?’ হযরত আবূ বকর (রা:) উত্তর দেন, ‘এটা ’আসফা’ন উপত্যকা।’ এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “হূদ (আ:) ও সালেহ (আ:) এই উপত্যকা অতিক্রম করেছিলেন কম বয়সী লাল উটের পিঠে চড়ে, যেগুলোর গলার দড়ি ছিল তাল গাছের আঁশ দিয়ে তৈরি। তাঁদের (পয়গম্বরবৃন্দের) কোমরের (নিচের) কাপড় ছিল একটি আলখাল্লা, আর বহিরাবরণের বস্ত্র ছিল একখানি কালো ও সাদা ডোরাকাটা ঢিলে জামা। আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ পবিত্র কা’বা গৃহে হজ্জ্ব পালনকালে তালবিয়া (অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার বাক্যটি) পাঠ করছিলেন। [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৩২; আল-বায়হাক্বী নিজ ‘শুয়া’ব আল-ঈমান’, ৩:৪৪০ #৪০০৩ গ্রন্থে পয়গম্বর মূসা (আ:) সম্পর্কেও অনুরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন; এবং আল-মুনযিরী প্রণীত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১১৭ #১৭৩৭]

এসব হাদীস থেকে পরিদৃষ্ট হয় যে হজ্জ্ব পালনকালে পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলী সাধারণ বস্ত্র পরিধান করতেন, আর তাঁরা তা পালন করতেন শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের খাতিরেই। তাঁদের জামা ছিল দু টুকরো কাপড়ের সমষ্টি। এগুলোর একটি তাঁদের পবিত্র শরীরের নিম্নভাগকে আবৃত করতো, অপরটি তাঁদের দেহ মোবারককে আবৃত করতো।

আল্লাহতা’লার কাছে এই (দুই টুকরো) বস্ত্রটি এতোই পছন্দনীয় হয়েছিল যে তিনি (এ উম্মতের) হাজ্বীদের পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে এটাকে বাধ্যতামূলক করে দেন। ফলে হজ্জ্ব পালনকালে কারো প্রথা বা রীতিগত বস্ত্র পরিধান একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মাথার চুল কামানো অবস্থায় নামায আদায় করাটা ভ্রান্তি ও সুন্নাহ’র পরিপন্থী হিসেবে পরিগণিত হয়, কিন্তু হজ্জ্বের বেলায় তা হয় না। ‘এহরা’ম’ অবস্থায় প্রত্যেক হাজ্বী সাহেব-ই আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বা শরীফের সামনে খালি মাথায় উপস্থিত হন। এরকম খালি মাথায় থাকাটা বিনীত ও সমর্পিত হওয়ার চিহ্ন বহন করে, আর আল্লাহতা’লার কাছেও এটা সবচেয়ে প্রশংসিত।
এর পাশাপাশি নখ ও চুল কাটা এবং মোচ ছাঁটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে [আল-কা’সানী কৃত ‘বাদা’ঈ আল-সানা’ঈ ফী তারতীব আল-শারা’ঈ, ২:১৯৮], যাতে বাহ্যিকভাবে সকল ক্ষেত্রেই মহান আল্লাহতা’লার পবিত্র পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের প্রবর্তিত রীতিনীতি অনুযায়ী হজ্জ্ব পালন করা যায়।

১.৯ তালবিয়া: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) কর্তৃক হজ্জ্বের প্রতি আহ্বান ও তার উত্তরের স্মরণে

হ্জ্জ্ব হোক বা উমরাহ, প্রত্যেক হাজ্বী সাহেব ‘এহরা’ম’ বেঁধে একান্ত নিষ্ঠা ও বিনয় সহকারে আল্লাহতা’লার কাছে নিম্নের বাক্যটি উচ্চারণ করে প্রার্থনা করেন: ”আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির! আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা, আশীর্বাদ ও সার্বভৌমত্ব আপনারই মালিকানাধীন। আপনার কোনো অংশীদার নেই।” [আল-বুখারী কর্তৃক নিজ সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত: কিতাবুল হজ্জ্ব (হজ্জ্বের বই), ‘তালবিয্যা’ অধ্যায়, ২:৫৬১ #১৪৭৪; আল-বুখারী কৃত সহীহ গ্রন্থ:কিতাবুল লিবাস্ (পরিচ্ছদবিষয়ক বই), ‘চুল কলপ/মেহেন্দি’ অধ্যায়, ৫:২২১৩ #৫৫৭১; সহীহ মুসলিম: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘তালবিয়্যা ও এর বিবরণ’ অধ্যায়, ২:৮৪১-৮৪২ #১১৮৪; আল-তিরমিযী প্রণীত ‘আল-জামিউস্ সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব’, ’তালবিয়্যা-সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ’ অধ্যায়, ৩:১৮৭-১৮৮ #৮২৫-৮২৬; আবূ দাউদ রচিত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানাসিক (হজ্জ্বের রীতিনীতি), ‘তালবিয়্যা পালনের পদ্ধতি’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৬২ #১৮১২; আল-নাসাঈ লিখিত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক আল-হজ্জ্ব, ’তালবিয়্যা পালনের পদ্ধতি’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:১৫৯-১৬০ #২৭৪৭-২৭৫০; এবং ইবনে মাজাহ কৃত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক, ’তালবিয়্যা’ অধ্যায়, ২:৯৭৪ #২৯১৮]

হজ্জ্ব ও উমরাহ’র সময় এই তালবিয়্যা পবিত্র (কা’বা) মসজিদে পাঠ করা হলেও খুব কম সংখ্যক মানুষ-ই এর উৎপত্তি সম্পর্কে জানেন। এটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আদেশ পালনার্থে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর কা’বা ঘর নির্মাণ সুসম্পন্ন করার পর তাঁর আহ্বানের প্রতি প্রায় চার হাজার বছর যাবত সাড়া প্রদানেরই একটি রীতি। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বিবৃত হয়েছে:

“এবং (হে ইবরাহীম) মানুষের মধ্যে হজ্জ্বের সাধারণ ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে উপস্থিত হবে পদব্রজে ও প্রত্যেক ক্ষীণকায় উটনীর পিঠে করে, যা দূর-দূরান্তের পথ থেকে আসে।” [আল-ক্বুরআন, ২২:২৭; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস তথা বাণীসমূহে বিবৃত হয় যে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) আবূ ক্বুবায়স্ পর্বতশিখরে আরোহণ করেন এবং গোটা মনুষ্যকুলের প্রতি এই মর্মে আহ্বান জানান যে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে খোদার ঘরে তাদের হাজির হওয়া উচিত। [ইবনে আবী হা’তিম কর্তৃক নিজ ‘তাফসীর আল-কুরআন আল-’আযীম’ ৮:২৪৮৭-২৪৮৮ গ্রন্থে বর্ণিত; ইবনে জাওযী কৃত ‘যা’দ আল-মাসীর ফী ‘ইলম আল-তাফসীর’, ৫:৪২৩; ইমাম সুয়ূতী প্রণীত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ৬:৩২; এবং ইবনে ‘আজীবা রচিত ‘আল-বাহর আল-মাদীদ ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন আল-মাজীদ’, ৪:৪১০]

স্থান-কালের উর্ধ্বে উঠে এই আহ্বানকে (পৃথিবীতে) মনুষ্য বসতির সর্বত্র পৌঁছে দেয়া হয়। বস্তুতঃ জন্মগ্রহণ করেননি আধ্যাত্মিক জগতের এমন সমস্ত আত্মা-ও এই আহ্বান শুনতে ও দেখতে পান; যিনি-ই এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন ‘আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ (অর্থাৎ, আমি হাজির), তাঁকেই হজ্জ্ব করার সামর্থ্য মঞ্জুর করা হয় এবং মহান আল্লাহতা’লার ঘরে হাজির হওয়ার অনুমতিও দেয়া হয়, যা নিম্নবর্ণিত হাদীসগুলোতে প্রমাণিত হয়:
. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন হুযূরে পাক (দ:)-এর হাদীস, যিনি বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) যখন কা’বা ঘর নির্মাণ করেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর প্রতি এ মর্মে ঐশী প্রত্যাদেশ দেন যেন তিনি মানবজাতিকে হজ্জ্বের দিকে আহ্বান জানান। পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের প্রভু (তাঁর) একখানি ঘর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন তোমরা তাতে হজ্জ্ব সম্পন্ন করো।’ এমন কোনো পাথর, গাছ, পাহাড় বা মাটি ছিল না যেটা এই আহ্বান শুনে না বলেছিল, ’আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির!’ [আল-হাকীম কর্তৃক নিজ ‘আল-মোস্তাদরাক ‘আলা আল-সহীহাইন’, ২:৬০১ #৪০২৬ গ্রন্থে বর্ণিত; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৭৬ #৯৬১৩; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘’শু’আব আল-ঈমান, ৩:৪৩৯ #৩৯৯৮; আল-তাবারী রচিত ‘তা’রিখ আল-উমাম ওয়া আল-মুলূক’, ১:১৫৬; মুজাহিদ লিখিত ‘আল-তাফসীর’, ২:৪২২; আল-জাসসা’স কৃত ‘আহকা’ম আল-ক্বুরআন, ৫:৬৩; আল-তাবারী প্রণীত ‘জামে’ আল-বায়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ১৭:১৪৪; এবং ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর, ৬:৩২]

. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) যখন কা’বা ঘরের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন, তখন তাঁকে বলা হয়, ‘মানুষকে হজ্জ্বের দিকে আহ্বান করুন।’ তিনি আরয করেন, ‘হে আমার প্রভু, আমার কণ্ঠস্বর (অতোদূর) পৌঁছুবে না।’ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা বলেন, ‘উচ্চস্বরে আহ্বান করুন, আমি সমগ্র সৃষ্টিকে তা শোনাবো।’ অতঃপর পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) বলেন, ‘ওহে মানবকুল! মহান আল্লাহ পাক তোমাদের জন্যে হজ্জ্বের বিধান জারি করেছেন।’ বর্ণনাকারী (সাহাবী) আরো যোগ করেন, ‘এই ঘোষণা আসমান ও জমিনে অবস্থিত সকল সৃষ্টি-ই শুনতে পান। তোমরা কি দেখতে পাও না পৃথিবীর দূর-দূরান্ত হতে মানুষ (এ আহ্বানে সাড়া দিতে) কীভাবে তালবিয়্যা পাঠ করতে করতে এসে হাজির হন?’ [ইবনে আবী শায়বা কর্তৃক নিজ ‘আল-মোসান্নাফ’, ৬:৩২৯ #৩১৮১৮ গ্রন্থে বর্ণিত; আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মোস্তাদরাক ‘আলা আল-সহীহাইন, ২:৪২১ #৩৪৬৪; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৭৬ #৯৬১৪; আল-মাক্বদাসী রচিত ‘আল-আহা’দীস আল-মুখতা’রা, ১০:২০-২১; আল-তাবারী তাঁর ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৪ গ্রন্থে সাঈদ বিন জুবায়র হতেও এই বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করেন; আল-সুযূতী লিখিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ৬:৩২; ইমাম সুযূতী একই গ্রন্থের (দুররুল মানসূর) ৬:২৩৩-এ এই রওয়ায়াত সাঈদ বিন জুবায়র হতেও বর্ণনা করেন; আল-শওকানী কৃত ‘ফাতহুল ক্বাদীর’, ৩:৪৫০; এবং আ’লূসী প্রণীত ‘রূহু আল-মা’আ’নী ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম ওয়া আল-সাব’ আল-মাসা’নী’, ১৭:১৪৩]  

. “এবং (হে ইবরাহীম) মানুষের মধ্যে হজ্জ্বের সাধারণ ঘোষণা করে দাও” – ক্বুরআন মজীদের এই আয়াতটি প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলউল্লাহ (আ:) একটি পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘ওহে মানবকুল! হজ্জ্ব তোমাদের প্রতি ফরয করা হয়েছে।’ সকল পুরুষের ঔরসে ও নারীর গর্ভে যারা ছিলেন, তাঁদের সবাইকেই এই আহ্বান শোনানো হয়; আর অনাদিকাল হতে আল্লাহর জ্ঞাত সব মো’মেন বান্দা যাঁদের ভাগ্যে শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত হজ্জ্ব নসীব করা হয়েছিল, তাঁরা এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির।’ [আল-তাবারী কর্তৃক নিজ ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৪; আল-সুয়ূতী কৃত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর, ৬:৩৩; আল-তাবারী প্রণীত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়া আল-মুলূক’, ১:১৫৭; এবং আল-’আসক্বালা’নী রচিত ‘ফাতহ্ আল-বা’রী’, ৬:৪০৬]

. হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বাণী; তিনি বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) যখন কা’বা ঘরের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন, তখন আল্লাহতা’লা তাঁকে হজ্জ্বের আহ্বান জানাতে নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় তিনি একটি উঁচু স্থানে উঠে উচ্চস্বরে বলেন, ‘ওহে মানবকুল! তোমাদের প্রভু তোমাদেরই জন্যে একটি ঘর নির্ধারণ করেছেন; অতএব, তোমরা হজ্জ্ব পালন করো এবং আল্লাহর (আহ্বানের) প্রতি সাড়া দাও।’ সকল পুরুষের ঔরসে এবং নারীর গর্ভে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা উত্তর দেন, ‘আমরা উত্তর দিচ্ছি! আমরা উত্তর দিচ্ছি! আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির!’ হাদীসটির বর্ণনাকারী (সাহাবী) আরো যোগ করেন, যে কেউ আজকাল হজ্জ্ব পালন করলে তিনি সে সকল (নেককার) বান্দার অন্তর্গত, যিনি পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর আহ্বানে যতোবার তালবিয়্যা পাঠের ভিত্তিতে সাড়া দিয়েছিলেন। [আল-ফা’কাহী প্রণীত ‘আখবা’র মক্কা ফী ক্বাদীম আল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ১:৪৪৬ #৯৭৩; এ হাদীস সংক্ষেপে মুজা’হিদ বিন জুবায়র হতে নিম্নোক্ত বইগুলোতে উদ্ধৃত হয়েছে: ইবনে আবী শায়বা রচিত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৬:৩৩০ #৩১,৮২৬; আল-তাবারী লিখিত ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৫; ইবনে আবদ আল-বার্র প্রণীত ‘আল-তামহীদ লিমা’ ফী আল-মুওয়াত্তা মিন আল-মা’আনী ওয়া আল-আসা’নীদ’, ১৫:১৩১; এবং আল-যায়লাঈ কৃত ‘নাসব আল-রা’এয়া লি আহা’দীস আল-হেদা’এয়া’, ৩:২৩]
’লাব্বায়েক’-এর এক মুহূর্তের এ আহ্বান সহস্র সহস্র বছর আগে জানানো হলেও এই ঐশী সুরের অনুরণন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। হাজ্বী সাহেবান এটা আবৃত্তি করার মাধ্যমে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর সাথে সম্পর্কিত এ ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে অতীতের ঘটনার স্মৃতিচারণ করা দ্বীন ইসলামের শিক্ষার সাথে একদম সঙ্গতিপূর্ণ। অনুরূপভাবে, মওলিদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর উদযাপনের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রিয়নবী (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের স্মৃতিচারণ করি এবং তাঁর এ আবির্ভাবের প্রতি খুশি প্রকাশ করি। হুযূরে পূর নূর (দ:)-কে সমাবেশে, তাঁর প্রশংসায় নাত/শে’র/কসীদা/পদ্য আবৃত্তির মাধ্যমে এবং অন্যান্য প্রশংসনীয় আমল দ্বারা স্মরণ করা হয়।

১.১০ তওয়াফ: আম্বিয়া (আ:)-এর সুন্নাহ (রীতিনীতি)-এর স্মরণে

কা’বা গৃহের চারপাশ সাতবার ঘুরে ঘুরে প্রদক্ষিণ করা তওয়াফ হিসেবে পরিচিত। এই তওয়াফ পালন করা পয়গম্বর আলাইহিমুস্ সালামেরই অনুশীলিত একটি রীতি (সুন্নাহ)। নিম্নবর্ণিত রওয়ায়াতগুলোতে এতদসংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে:

. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, কা’বা ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এতে প্রার্থনা ও তওয়াফ যিনি সর্বপ্রথম করেন, তিনি হলেন পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)। [আল-আযরাক্বী প্রণীত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ১:৩৬, ৪০; এবং ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ১:৩১৩]  

. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব বিবৃত করেন যে তাঁকে এ মর্মে জানানো হয়েছে, পয়গম্বর আদম (আ:) ধরণীতলে প্রার্থনা করার মতো কোনো বেহেশতী পরিবেশ না পেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা (ফেরেশতাকুলের মাধ্যমে) পয়গম্বর আদম (আ:)-এর জন্যে একটি পবিত্র মসজিদ বানিয়ে দেন এবং সেই স্থানে বসতি করতে তাঁকে আদেশ করেন। হযরত আদম (আ:) মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং তিনি যেখানে বিশ্রাম নেন, সেখানে আল্লাহতা’লা পানির ঝর্ণা সৃষ্টি করে দেন। অতঃপর তিনি মক্কা শরীফ পৌঁছুলে সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করে ওই কা’বা গৃহের পাশে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন হন এবং কা’বা গৃহ তওয়াফ করেন। তাঁর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তি) না হওয়া পর্যন্ত এই স্থান-ই হয় তাঁর আবাসস্থল। [আল-আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৩৯; ইবনে আসাকির লিখিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৭:৪২৫; এবং আল-মাক্বদাসী প্রণীত ‘আল-বাদ’ ওয়া আল-তা’রীখ’, ৪:৮২]

. খলীফা উমর আল-খাত্তাব (রা:) হযরত কা’আব আল-আহবার (রা:)-কে আল্লাহতা’লার ঘরটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন, “আল্লাহতা’লা পয়গম্বর আদম (আ:)-এর সাথে একটি হীরের মোড়কের ভেতরে কা’বা ঘরটি দুনিয়াতে নামিয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, ‘ওহে আদম! আমি আমার গৃহ তোমার সাথে পৃথিবীতে পাঠালাম। এটাকে তওয়াফ করতে হবে এবং এর পাশে এবাদত-বন্দেগীও করতে হবে, ঠিক যেমনটি করা হয় আমার ’আরশে।’ ফেরেশতাকুল ওই ঘরের সাথে অবতীর্ণ হন এবং এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও এর নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন। হযরত আদম (আ:) এই কা’বা ঘরের তওয়াফ করতেন, যেমনভাবে ’আরশকে ঘিরে তা করা হয়। আর তিনি এর পাশে নামায-দোয়াও আদায় করতেন, যেমনটি তিনি ’আরশের পাশে প্রার্থনা করতেন।” [আল-আযরাক্বী রচিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৩৯]

. পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) ছাড়াও অসংখ্য আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) কা’বা ঘরের তওয়াফ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত মুজা’হিদ (রহ:) বলেন, “পঁচাত্তর জন পয়গম্বর (আ:) হজ্জ্ব পালন করেন। এঁরা সবাই কা’বা ঘরকেতওয়াফ করেন।” [আল-আযরাক্বী কৃত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৭-৬৮; আল-ফা’কাহী প্রণীত ‘আখবার মক্কা ফী ক্বাদীম অাল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ৪:২৬৮ #২৫৯৯; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-’ইলাল ওয়া মা’রিফা আল-রিজা’ল’, ৩:১৯৩ #৪৮৩১]

কা’বা শরীফকে সাতবার তওয়াফ করাও পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলীরই রীতি (সুন্নাহ)।
. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন: “পয়গম্বর আদম (আ:) হজ্জ্ব পালন করেন এবং কা’বা ঘরকে সাতবার প্রদক্ষিণ (তওয়াফ) করেন।” [আল-আযরাক্বী কৃত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৪৫; এবং আল-সুয়ূতী লিখিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ১:৩২০]

. ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে আবী সুলাইমান বলেন: পয়গম্বর আদম (আ:) দুনিয়াতে অবতরণের পরে কা’বা ঘরকে সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-আযরাক্বী প্রণীত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৪৩]

. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব সর্ব-পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ও ইসমাঈল (আ:)-এর তওয়াফ প্রসঙ্গে লেখেন: পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলউল্লাহ (আলাইহিস্ সালাম) পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণ সুসম্পন্ন করার পর হযরত জিবরীল (আ:) তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, ‘এটাকে সাতবার তাওয়াফ করুন।’ এমতাবস্থায় সর্ব-পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ও ইসমাঈল (আ:) কা’বা ঘরকে সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-আযরাক্বী লিখিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৫; এবং আল-কুরতুবী কৃত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআন, ২:১২৯]

সর্বশেষ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের এই আচরিত প্রথাটিকে কা’বা শরীফের সাতবার তাওয়াফ দ্বারা সংরক্ষণ করেন।

. হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা:) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (দ:) মক্কা মোয়াযযমায় প্রবেশ করে কা’বা গৃহকে সাতবার তাওয়াফ করেন। [আল-বুখারী লিখিত ‘সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘যে ব্যক্তি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমের পেছনে তাওয়াফ-পরবর্তী দুই রাক’আত নামায আদায় করেন’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮৮ #১৫৪৭; আল-বুখারী কৃত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী সাঈ সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৯৩ #১৫৬৩; আল-বুখারী প্রণীত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা-শেষে এহরাম খোলার সময়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৬৩৬ #১৭০০; এবং মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘হজ্জ্বে এহরাম বাঁধা ব্যক্তির প্রতি আরোপিত বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯০৬ #১২৩৪]  

. হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:) বর্ণনা করেন: মহানবী (দ:) মক্কা শরীফে প্রবেশ করলে তিনি কা’বা ঘর সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-তিরমিযী রচিত ‘আল-জা’মে’ আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘আল-মারওয়ার আগে আল-সাফা’য় আরম্ভ করা প্রসঙ্গে বর্ণনাসমূহ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২১৬ #৮৬২; আল-তিরমিযী কৃত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ’: আবওয়াব আল-তাফা’সীর, ‘সূরা আল-বাক্বারা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫: ২১০ #২৯৬৭; আল-নাসাঈ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতাব মানা’সিক আল-হাজ্জ্ব, ‘তাওয়াফ-পরবর্তী দুই রাক’আত নামাযশেষে বক্তব্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২৩৫ #২৯৬১; ইবনে খুযায়মা লিখিত ’আল-সহীহ’, ৪:১৭০ #২৬২০; এবং আল-তাবারানী রচিত ‘’আল-মু’জাম আল-সগীর’, ১:১২৬ #১৮৭]
এসব রওয়ায়াত হতে সহজে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে তাওয়াফ (সাতবার প্রদক্ষিণসহ) পালন করাটা পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দেরই পদাঙ্ক অনুসরণ; এর পালনের মাধ্যমে আমরা পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের পুনঃপুনঃ স্মৃতিচারণ করে থাকি।

১.১১ রামল: মহানবী (দ:) ও সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর দ্বারা অনুশীলিত তওয়াফ-পদ্ধতির স্মরণে

তাওয়াফ পালন হজ্জ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের একটি। পুরুষ হাজ্বীদের আদেশ করা হয়েছে যেন তাঁরা তাওয়াফ তথা প্রদক্ষিণের প্রথম তিনবার কিছুটা গর্বের সাথেই তা সম্পন্ন করেন। এর ইসলামী পারিভাষিক শব্দ হচ্ছে ‘রামল’। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, গর্বভরে হাঁটা ঔদ্ধত্যেরই একটি চিহ্ন এবং এটা আল্লাহতা’লা পছন্দ করেন না; তবে হজ্জ্বের সময় এর বিপরীত-ই ঘটে থাকে। [নোট: হা’রিসা বিনতে ওয়াহহাব অাল-খুযাঈ (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “আমি কি তোমাদেরকে বেহেশতী মানুষদের সম্পর্কে জানাবো না? তারা হলো যারা দুর্বল এবং দুর্বল বলে মনে করা হয়। কিন্তু যদি তারা আল্লাহর নামে কসম/শপথ করে, আল্লাহতা’লা তা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করে দেন। আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামী লোকদের সম্পর্কে বলবো না? তারা হলো যারা অমার্জিত, উদ্ধত ও অহঙ্কারী।” এ হাদীস বর্ণনা করেন অাল-বুখারী তাঁর ‘সহীহ’: কিতা’ব আল-তাফসীর, সূরা নূন ওয়াল্ ক্বালাম’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৮৭০ #৪৬৩৪ গ্রন্থে; আল্-বুখারী প্রণীত ‘আল-সহীহ’: কিতা‘ব আল-আদাব, ’ঔদ্ধত্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৫৫ #৫৭২৩; এবং মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতা’ব আল-জান্নাহ ওয়া সিফা নাঈমিহা’ ওয়া আহলিহা’, ‘দাম্ভিক জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং দুর্বল জান্নাতে প্রবেশ করবে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২১৯০ #২৮৫৩। হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন: শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে আমারই ভূষণ এবং অহঙ্কার আমারই পরিধেয়। যে কেউ এগুলোর কোনোটি আমার কাছ থেকে অপসারণ করতে চাইবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” এ হাদীস বর্ণনা করেন ইবনে আবী শায়বা নিজ ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:৩২৯ #২৬,৫৭৯ গ্রন্থে; আল-তাবারানী এটা হযরত আলী (ক:) হতে উদ্ধৃত করেন নিজ ‘আল-মু’জাম আল-আওসাত’, ৩:৩৫২ #৩৩৮০ পুস্তকে; আল-ক্বাদা’ঈ কৃত ‘মুসনাদ আল-শিহা’ব’, ২:৩৩১ #১৪৬৪; আল-বায়হাক্বী লিখিত ‘শু’আব আল-ঈমা’ন’, ৬:৩৮০ #৮১৫৭]
এতে নিহিত (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা এই যে, মদীনায় হিজরতের পরে মুসলমানবৃন্দ অবিরত অনেক সংগ্রামের ফলে দুর্বল ও ক্ষীণকায় হয়ে পড়েন। হুদায়বিয়ার সন্ধি স্থাপিত হওয়ার এক বছর পর তাঁরা মক্কা মোয়াযযমায় উমরাহ হজ্জ্ব পালন করতে ফেরত গেলে তাঁদের শরীরে এই দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়। মক্কার কুফফার (অবিশ্বাসী গোষ্ঠী) দেখতে পায় যে মুসলমানবৃন্দ তাওয়াফ পালনে ধীরগতিসম্পন্ন; আর তাই তারা মুসলমানদেরকে এ মর্মে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে যে তাঁরা মক্কা ছেড়ে যাওয়ায় এতোই ক্ষীণকায় হয়েছেন, যার দরুন তাঁরা এমন কি ঠিকভাবে হাঁটতেও পারছেন না। এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) সম্মানিত সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে সাড়ম্বরে হাঁটতে নির্দেশ দেন, যাতে অবিশ্বাসীদের মস্তিষ্ক থেকে এই ধারণা দূর হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের পরে যদিও কোনো অমুসলিম আর সেখানে অবশিষ্ট ছিল না, তবুও তাওয়াফের এ রীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই একই রকমভাবে পালিত হয়ে আসছে।

ইমাম মুসলিম তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থের ‘কিতাবুল হজ্জ্ব’ বইয়ের ‘এসতেহবা’ব আল-রামল ফী আল-তাওয়া’ফ ওয়া আল-উমরা ওয়া ফী আল-তাওয়া’ফ আল-আওয়াল মিন আল-হাজ্জ্ব’ (উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা) শীর্ষক অধ্যায়ে এ বিষয়ে অনেক রওয়ায়াতের উল্লেখ করেন, যা নিম্নে লিপিবদ্ধ হলো:

. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে প্রিয়নবী (দ:) ও তাঁর মহান সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) মদীনা মোনাওয়ারায় এক মহামারী দেখা দিলে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা (হুদায়বিয়ার সন্ধির এক বছর পর উমরা’র উদ্দেশ্যে) মক্কা মোয়াযযমায় উপস্থিত হওয়ার সময় (সেখানকার) মুশরিক নেতৃবর্গ তাদের অনুসারীদের বলে, ‘তোমাদের কাছে এমন এক জাতি আগমন করবে যারা রোগে দুর্বল হয়ে গিয়েছে।’ এতদশ্রবণে মক্কাবাসী মানুষ কালো পাথরের কাছে গিয়ে বসেন। অতঃপর মুসলমানবৃন্দ সেখানে পৌঁছুলে রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদেরকে প্রথম তিন তওয়াফ সাড়ম্বরে পালন করতে নির্দেশ দেন এবং দুই কোণার (অর্থাৎ, ইয়েমেনী কোণা ও কালো পাথরের কোণা) মধ্যবর্তী স্থানে হাঁটতে বলেন, যাতে মুশরিকবর্গ তাঁদেরকে শক্ত-সামর্থ্য দেখতে পায়। (এ দৃশ্য দর্শনে) মুশরিকবর্গ বিস্ময়ভরে বলে, ‘তোমরা কি আমাদের এ কথা বিশ্বাস করতে বলো যে এই মানুষগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গিয়েছে? সত্যি তারা ভীষণ বলবান এবং তোমরা যা দাবি করছো তা হতে (সম্পূর্ণ) মুক্ত!’ [ইমাম মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯২৩ #১২৬৬; ইমাম বুখারী প্রণীত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘রামল যেভাবে সূচিত হয়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮১ #১৫২৫; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯৪; এবং ইমাম বায়হাক্বী লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৬]

. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) আরেকটি রওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ:) কা’বা ঘরের চারদিক দ্রুত হেঁটে প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করেন এবং আল-সাফাআল-মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে (জোরে) সাঈ করেন, যাতে তিনি তাঁর দৈহিক শক্তি মুশরিকদের দেখাতে সক্ষম হন। [আল-বুখারী কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ সম্পর্কে যা যা বর্ণিত’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৯৪ #১৫৬২; মুসলিম প্রণীত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ অধ্যায়, ২:৯২৩ #১২৬৬; আল-তিরমিযী রচিত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ সম্পর্কে যা যা বর্ণিত’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২১৭ #৮৬৩; আল-নাসাঈ লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪০৫ #৩৯৪১; আল-হুমায়দী কৃত ‘আল-মুসনাদ, ১:২৩২ #৪৯৭; এবং আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘অাল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৭-৫৮]
. আবূ তোফায়ল আমির বিন ওয়া’সিলা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) মক্কা মোয়াযযমায় প্রবেশ করলে অবিশ্বাসীরা বলে, ‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাথীবৃন্দ ক্ষীণকায় হওয়ার দরুন কা’বা ঘরের তাওয়াফ করতে অক্ষম’। মুশরিকবর্গ তাঁর প্রতি হিংসাবোধ করতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (দ:) সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে তওয়াফের প্রথম তিনবার রামল এবং পরবর্তী চারবার হাঁটতে নির্দেশ দেন। [মুসলিম রচিত ‘সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘উমরা’র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯২১-৯২২ #১২৬৪; ইবনে হিব্বান লিখিত ‘সহীহ’, ৯:১৫৪ #৩৮৪৫; এবং আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৭-৯০৫৮]

১.১২ ইদতিবা’: সর্বশেষ নবী (দ:)-এর সুন্নাহ
তাওয়াফ পালনকালে এহরাম-এর কাপড় ডান হাতের বগলের নিচে গোঁজা এবং এর উভয় প্রান্ত বাম কাঁধের ওপরে স্থাপন করাকেই ইদতিবা’ বলে। [ইবনে মানযূর রচিত ‘লিসা’ন আল-আরব’, ৮:২১৬]
আমরা ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে, মহাসম্মানিত পয়গম্বর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) (শারীরিক) শক্তি ও সম্ভ্রম-জাগানোর এক প্রদর্শনী দিতে নিজ মহান সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে রামল পালন করতে আদেশ করেছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি তাওয়াফ পালনকালে এদতেবা’ পালনেরও নির্দেশ দেন, যার নজির তিনি-ই সর্বপ্রথমে স্থাপন করেন (এবং সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে এতে নেতৃত্ব দেন)। হজ্জ্বউমরা’র উদ্দেশ্যে যেসব হাজ্বী সাহেব/সাহেবা সফর করেন, তাঁদের জন্যে এই প্রিয় সুন্নাহ’কে আঁকড়ে ধরা বাধ্যতামূলক। হাজ্বীবৃন্দ তাঁদের প্রিয়নবী (দ:)-এর অনুশীলিত এই রীতির স্মারক উদযাপন করে থাকেন।
. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ:) ও তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দ ‘জি’রা’না হতে উমরা পালন করতেন। তাঁরা কা’বা ঘরের চারদিকে রামল পালন করতেন এবং নিজেদের (এহরামের) কাপড় (ডান) হাতের বগলের নিচে গুঁজে অপর প্রান্ত বাম কাঁধের ওপরে ছেড়ে দিতেন। [আবূ দাউদ রচিত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক (হজ্বের রীতিনীতিসম্পর্কিত বই), ‘তাওয়াফ পালনকালে এদতেবা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৭৭ #১৮৮৪; আহমদ বিন হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ, ১:৩০৬; আল-তাবারা’নী কৃত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর, ১২:৬২ #১২,৪৭৮; বায়হাক্বী লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৭৯ #৯০৩৮-৯০৩৯; এবং আল-মাক্বদাসী রচিত ‘আল-আহা’দীস আল-মুখতা’রা, ১০:২০৭-২০৮ #২১৩-২১৫]
. এয়া’লা বিন উমাইয়া (রা:) বলেন, মহানবী (দ:) সবুজ (এহরামের) কাগড় পরা অবস্থায় এদতেবা’ সহকারে তাওয়াফ পালন করেন। [আবূ দাউদ প্রণীত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক, ‘তাওয়াফ পালনকালে এদতেবা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৭৭ #১৮৮৩; আল-তিরমিযী কৃত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘মহানবী (দ:)-এর এদতেবা’ সহকারে তাওয়াফ পালন সম্পর্কে যা যা বর্ণিত’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২১৪ #৮৫৯; ইবনে মা’জাহ রচিত ‘আল-সুনান: কিতাবুল মানা’সিক, ‘এদতেবা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯৮৪ #২৯৫৪; আল-দা’রিমী লিখিত ‘আল-সুনান, ২:৬৫ #১৮৪৩; এবং আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৭৯ #৯০৩৫]
৩. আল-তিবী (রহ:) এদতেবা’র অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা ব্যাখ্যাকালে বলেন, এটা স্রেফ সাহসের নিদর্শনস্বরূপ করা হয়েছিল, ঠিক যেমনটি করা হয়েছিল তাওয়াফের সময় রামল পালনের সময়। [আযীম আবা’দী রচিত ‘আওন আল-মা’বূদ আলা’ সুনানে আবী দা’ঊদ’, ৫:২৩৬; এবং মুবা’রাকপূরী লিখিত ‘তোহফা আল-আহওয়াযী ফী শারহে জামে’ তিরমিযী’, ৩:৫০৬]
মক্কা মোয়াযযমায় কুফফার-বর্গের অস্তিত্বের সময়কাল হতে চৌদ্দ’শ বছর পরে আমাদের এই যুগেও প্রিয়নবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দের সুন্নাহ (রীতি)-এর অনুকরণে এদতেবা’ পালন করা আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক (আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলোয়) আলোকিত হয়, আর এতে আমরা ওই ধরনের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আজো অটল, অবিচল থাকার প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা পাই।

১.১৩ কালো পাথর চুম্বন: আল্লাহর প্রিয় বান্দার অনুশীলিত প্রথার স্মরণে
আল-হাজর আল-আসওয়াদ তথা কালো পাথরকে পবিত্র মনে করার কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো, এটা জিবরাঈল ফেরেশতা (আ:) বেহেশত থেকে নিয়ে এসেছিলেন [আল-আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র, ১:৬২, ৬৪ এবং ৩২৫; ইবনে আবী শায়বা প্রণীত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৩:২৭৫ #১৪,১৪৬; ইবনে আল-জা’আদ লিখিত ‘আল-মুসনাদ’, ১৪৮ পৃষ্ঠা #৯৪০; আল-ফা’কাহী রচিত ‘আখবার মক্কা ফী ক্বাদীম আল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ১:৯১ #২৫; এবং আল-হায়সামী কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়াঈদ’, ৩:২৪২]। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার আদেশক্রমে পয়গম্বরবৃন্দ (আলাইহিমুস্ সালাম) এই কালো পাথরকে চুম্বন করতেন এবং এসতেসলা’ম তথা সম্ভাষণ জানাতেন। সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আপন পূর্বসূরী পয়গম্বর ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সুন্নাহ তথা রীতি অনুসরণ করে নিজ পবিত্র হাত মোবারক দ্বারা কালো পাথরটিকে তার নির্ধারিত স্থানে বসিয়ে দেন এবং নিজের পবিত্র ঠোঁট দ্বারা চুম্বন করেন। এরই ফলশ্রুতিতে এটা হজ্জ্বের একটি প্রথায় পরিণত হয়। আজকে ঈমানদারবৃন্দ এই পাথরকে চুম্বন করার একমাত্র কারণ হচ্ছে মহানবী (দ:) এটাকে চুমো দিয়েছিলেন।
এই বাস্তবতা (খলীফা) হযরত উমর ফারূক (রা:)-এর বক্তব্য দ্বারা পরিস্ফুট হয়, যিনি একবার তাওয়াফ পালনকালে হজরে আসওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমি ভালো করেই জানি তুমি স্রেফ একটি পাথর। তুমি কারো উপকার বা ক্ষতি করতে অক্ষম। (খোদ) রাসূলুল্লাহ (দ:) তোমাকে চুম্বন করেছেন, এমনটি যদি আমি না দেখতাম, তাহলে কখনোই আমি এরকম করতাম না।” [আল-বুখারী প্রণীত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘কালো পাথর সম্পর্কে যা উল্লেখিত হয়েছে’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৭৯ #১৫২০; আল-বুখারী কৃত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ’হজ্জ্ব ও উমরা’য় পালিত রামল’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮২ #১৫২৮; আল-বুখারী রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, কালো পাথর চুম্বন’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮৩ #১৫৩২; মুসলিম লিখিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘তাওয়াফ পালনকালে কালো পাথর চুম্বনের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯২৫ #১২৭০; ইবনে মা’জাহ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক’, ‘কালো পাথরের প্রতি সম্ভাষণ’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯৮১ #২৯৪৩; আল-নাসাঈ কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪০০ #৩৯১৮; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৪৬ #৩২৫]
অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর ফারূক (রা:) বলেন, “তুমি নিতান্ত-ই একটি পাথর মাত্র। রাসূলুল্লাহ (দ:) তোমাকে চুম্বন করেছেন, এমনটি না দেখলে আমি কখনো এরকম করতাম না।।” [ইমাম মালেক কৃত ‘মোওয়াত্তা: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘সম্ভাষণের সময় হজরে আসওয়াদের কোণা চুম্বন’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৩৬৭ #৮১৮; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৫৩ #৩৮০]
এই কথা বলার পর হযরত উমর ফারূক (রা:) কালো পাথরকে চুম্বন করতে অগ্রসর হন। ঘটনাটি এ বাস্তবতাকে পরিস্ফুট করে যে মহান সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কালো পাথরকে চুমো খেতেন মহানবী (দ:)-এর পদাঙ্ক অনুসরণেরই উদ্দেশ্যে; এটা ছিল তাঁদের জন্যে (হুযূর পাককে) স্মরণ করার খাতিরেই একটি অনুশীলিত রীতি। আর শেষ বিচার দিবস অবধি এই সুন্নাহ তথা রীতি বাক্বি বা অবশিষ্ট (মানে টিকে) থাকবে।

১: ১৪ মাক্বামে ইবরাহীম: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর স্মরণে

মাক্বাম (মর্যাদাপূর্ণ স্থান) বলতে (আরবী) ভাষাবিদ্যায় এমন এক স্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে কারো পা স্থাপিত হয়েছে [আল-ফারা’হীদী কৃত ‘কিতা’ব আল-’আইন’, ৫:২৩২; ফায়রূয আবা’দী প্রণীত ‘আল-ক্বা’মূস আল-মুহীত’, ৪:১৭০; ইবনে মানযূর রচিত ‘লিসা’ন আল-’আরব’, ১২:৪৯৮; এবং আল-যাবীদী লিখিত ‘তা’জ আল-উরূস’ মিন জওয়া’হির আল-ক্বা’মূস’, ১৭:৫৯২]মাক্বাম-এ-ইবরাহীম সম্পর্কে বিভিন্ন মত বিদ্যমান। উলামাবৃন্দ ও মুফাসসিরীন-মণ্ডলী [সর্ব-হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:), আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), ক্বাতাদা (রা:) প্রমুখের মতামতের ভিত্তিতে] বিশ্বাস পোষণ করেন যে ‘মাক্বাম-এ-ইবরাহীম’ হচ্ছে এই স্থানে অবস্থিত পাথরটির নাম। এখানে দুই রাক’আত নামায আদায় করা হয়ে থাকে। এটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত। [আল-তাবারী প্রণীত ‘জামেউল বয়া’ন ফী তাফসীরিল ক্বুরআ’ন’, ১:৫৩৭; আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ২:১১২; আল-রা’যী কৃত ‘আল-তাফসীর আল-কবীর’, ৪:৪৫; আল-আলূসী লিখিত ‘রূহুল মা’আনী ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন ওয়া সাব’ আল-মাসা’নী’, ১:৩৭৯; এবং আল-আসক্বালা’নী প্রণীত ‘ফাতহুল বা’রী’, ১:৪৯৯]

ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী) বর্ণিত একটি হাদীসে ওপরের বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ মর্মে যে, কা’বা শরীফ নির্মাণের সময় পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:) পাথরগুলো জড়ো করতে থাকেন, আর পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) দেয়ালগুলো দাঁড় করাতে থাকেন। দেয়ালগুলো যখন বেশ উঁচু হয়, তখন পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) এই পাথরটির (মাক্বামে ইবরাহীম) ওপর ওঠে দাঁড়ান যাতে শীর্ষদেশে পৌঁছে ইমারতটির নির্মাণ সুসম্পন্ন করা যায়। [আল-বুখারী রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’, দ্রুত ফেরত যাওয়া: তাড়াতাড়ি হাঁটা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৩৫ #৩১৮৪; আবদুর রাযযাক্ব প্রণীত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:১১০ #৯১০৭; আল-তাবারী কৃত ‘জামেউল বয়া’ন ফী তাফসীরিল ক্বুরআ’ন’, ১:৫৫০; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম’, ১:১৭৮; এবং আল-ক্বাযউইনী রচিত ‘আল-তাদউয়ীন ফী আখবা’র ক্বাযউয়ীন’, ১:১০৫]

অপর এক রওয়ায়াতে বিবৃত হয় যে, পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর আনা পাথরগুলো বহন করা যখনই পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর জন্যে কষ্টসাধ্য হতো, তৎক্ষণাৎ তিনি মাক্বামে ইবরাহীমের ওপর ওঠে দাঁড়াতেন এবং সেটা তাঁকে মাটি থেকে ওপরে তুলে ইমারতটির চারপাশ ঘুরিয়ে আনতো, যতোক্ষণ না কা’বা শরীফ নির্মাণ সুসম্পন্ন হয়। [আল-আযরাক্বী লিখিত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ১:৫৮ ও ২:৩৩]

হযরত আনাস (রা:) বর্ণনা করেন যে হযরত উমর ফারূক (রা:) রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি যদি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমকে সালা’ত বা নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ করতেন!” অতঃপর আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হয়: “আর (বল্লাম,) ’ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’। [আল-ক্বুরআন, ২:১২৫]
সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রিয়নবী (দ:) অবিলম্বে মাক্বামে ইবরাহীমে নামায আদায় করে এই ঐশী আজ্ঞা পালন করেন। [আল-বুখারী রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-তাফসীর’, “আল্লাহর বাণী – ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’” শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৬২৯ #৪২১৩; আল-তিরমিযী লিখিত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ: আবওয়া’ব আল-তাফসীর’, ‘সূরা আল-বাক্বারা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২০৬ #২৯৬০; ইবনে মা’জাহ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব এক্বা’মা আল-সালা’হ ওয়াল-সুন্না ফীহা’, ‘ক্বিবলা’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৩২২ #১০০৮; আল-নাসা’ঈ কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৬:২৮৯ #১০,৯৯৮; ইবনে হিব্বা’ন লিখিত ‘আল-সহীহ’, ১৫:৩১৯ #৬৮৯৬; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৩৬ #২৫০]

হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:) বর্ণনা করেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাথে যখন কা’বা শরীফের সামনে উপস্থিত হই, তিনি তখন তাওয়াফ (তিনবার রামল ও চারবার স্বাভাবিক গতিতে) পালন করেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হন এবং “আর (বল্লাম,) ’ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’ – ক্বুরআ’ন মজীদের এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তিনি কা’বা মাক্বামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে দুই রাকআত নামায আদায় করেন। [মুসলিম রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হজ্জ্ব’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৮৮৭ #১২১৮]

পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) যে পাথরটির ওপর দাঁড়িয়ে পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন, আল্লাহতা’লা তাকে এবাদতগাহ (উপাসনার স্থান) করার আদেশ দেন, যেহেতু এটা ছিল শীর্ষস্থানীয় সাহাবী (পুণ্যাত্মা) হযরত উমর ফারূক (রা:)-এর (প্রাণের) আকাঙ্ক্ষা। এই পাথরটি আশীর্বাদধন্য, কেননা এর পাশেই দাঁড়িয়ে মহানতম পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নামায পড়েন। শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো হাজ্বী সাহেবান কা’বা শরীফের তাওয়াফ করবেন, তাঁদের জন্যে মাক্বামে ইবরাহীমের পাশে দুই রাকআত নামায আদায় করা ওয়া’জিব (বাধ্যতামূলক) হবে; এতে ব্যর্থ হলে তাওয়াফ পালন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অবশ্য কোনো স্থান সংকুলান না হলে অন্যত্র নামায পড়ার অনুমতি আছে, যদিও ওই মাক্বামের কাছে নামায পড়াটা প্রশংসনীয় বলে সাব্যস্ত হয়েছে। [আল-সারখাসী লিখিত ‘কিতা’ব আল-মাবসূত’, ৪:১২; আল-কা’সা’নী রচিত ‘বাদা’ঈ আল-সানা’ঈ ফী তারতীব আল-শারা’ঈ’, ২:১৪৮; আল-সামারক্বান্দী কৃত ‘তোহফা আল-ফুক্বাহা’, ১:৪০২; এবং ইবনে নুজাইম প্রণীত ‘আল-বাহর আল–রা’ইক্ব শারহে কানয আল-দাক্বা’ইক্ব’, ২:৩৫৬]

যেহেতু পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর পবিত্র পদচিহ্ন মাক্বামে ইবরাহীম পাথরটির ওপর অঙ্কিত রয়েছে, সেহেতু কা’বা ঘর নির্মাণে তাঁর কর্মপ্রয়াসের স্মরণে মুসলমান সমাজ চিরকাল এটাকে শ্রদ্ধা করবেন এবং এর পাশে নফল নামায-ও আদায় করবেন।

১:১৫ সাফা ও মারওয়া’র সাঈ: হযরত মা হাজেরের সুন্নাহর স্মরণে

আল্লাহতা’লার পছন্দকৃত বান্দাদের এমন কিছু কাজ বিদ্যমান, যেগুলো দৃশ্যতঃ এবাদত-বন্দেগীর মতো দেখায় না এবং এবাদতের নিয়্যতেও সেগুলো পালিত হয়নি, কিন্তু মহান আল্লাহ পাক সেগুলোকে মহামূল্যবান বিবেচনা করে সংরক্ষণ করেছেন এমনভাবে যে, তিনি সেগুলোকে একটি সামষ্টিক এবাদতের অংশ হিসেবেই ঘোষণা করেছেন।

এর একটি (উৎকৃষ্ট) উদাহরণ হলো মা হাজেরা (রা:)-এর ঘটনাটি, যেখানে তিনি তাঁর শিশুপুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর জন্যে পানির তালাশে মরিয়া হয়ে আল-সাফা’আল-মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ছুটোছুটি করেছিলেন। আল্লাহতা’লা তাঁর এই কাজটিকে এতো-ই পছন্দ করেন যে তিনি এ মর্মে আদেশ জারি করেন যেন হাজ্বী সাহেবান হজ্জ্বের অঙ্গ হিসেবে ওই দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একইভাবে দ্রুত চলাচল করেন। এর পরিভাষাগত শব্দ হচ্ছে সা’ঈ। হজ্জ্ব ও উমরা উভয় ক্ষেত্রেই সা’ঈওয়া’জিব তথা অবশ্যকর্তব্য।
মনে রাখতে হবে যে সাতবার সা’ঈ পালনকালে সুনির্দিষ্ট কোনো ক্বুরআ’ন মজীদের আয়াত তেলাওয়াত কিংবা কোনো যিকর পাঠ নির্ধারণ করা হয়নি। যার যেমন ইচ্ছে সে মোতাবেক ক্বুরআ’ন মজীদের যে কোনো আয়াত তেলাওয়াত করার অনুমতি আছে; আর মহানবী (দ:)-এর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ-ও জায়েয। মুখস্থ কিছু জানা না থাকলেও আল্লাহতা’লার মহিমাপূর্ণ নামগুলো জপা কিংবা বিশ্বাসসংক্রান্ত কলেমা-বাক্য মুখে আওড়ানোই যথেষ্ট হবে। নতুবা স্রেফ নিশ্চুপ থেকেও সা’ঈ সুসম্পন্ন করা বৈধ।

ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী) ও অসংখ্য হাদীসশাস্ত্র বিশারদ এবং তাফসীরবিদ আল-সাফা আল-মারওয়া’র তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু আহাদীস রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছেন। এর একটি নমুনা নিম্নরূপ:

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) মা হাজেরা (রা:) ও (তাঁর শিশুপুত্র) পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-কে সিরিয়া হতে মক্কা মোয়াযযমায় নিয়ে যান। ওই সময় নগরীটি বসতিহীন ছিল এবং পানির উৎস-ও দৃশ্যমান ছিল না। পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে আল্লাহর ঘরের পাশে রেখে তাঁদের কাছে কিছু খেজুর ও পানির মওজূদ জমা দিয়ে বিদায় নিতে গেলে মা হাজেরা (রা:) বেদনার্তস্বরে বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি, ইবরাহীম?’ আপনি কি আমাদেরকে এই বিরাণ মরু-উপত্যকায় রেখে চলে যাচ্ছেন?’ তিনি এই প্রশ্নটি বারংবার করতে থাকেন। কিন্তু পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) তাঁর দিকে পেছন ফিরে তাকাননি। এমতাবস্থায় মা হাজেরা (রা:) জিজ্ঞেস করেন, ‘মহান আল্লাহতা’লা আপনাকে আদেশ করার কারণেই কি আপনি আমাদেরকে এখানে ছেড়ে যাচ্ছেন?’ তিনি এর প্রতি হাঁ-সূচক উত্তর দেন। অতঃপর মা হাজেরা (রা:) বলেন, ‘এ-ই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আল্লাহতা’লা আমাদেরকে পরিত্যাগ করবেন না।’

এরপর মা হাজেরা (রা:) ওই স্থানেই বসে থাকেন যতোক্ষণ না পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) তাঁর যাত্রায় দৃষ্টির বাইরে চলে যান। তিনি যখন ‘সানিয়্যা’ নামের একটি জায়গায় পৌঁছেন, তখন দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন:

“হে আমার রব্ব! আমি আমার কিছু বংশধরকে (মানে মা হাজেরা ও পুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল এবং পুত্রের অনাগত বংশধরদের) এমন এক উপত্যকায় বসতি স্থাপন করালাম, যেখানে ক্ষেত হয় না এবং যে স্থানটি আপনারই সম্মানিত ঘরের সন্নিকটে; হে আমাদের রব্ব! (এটা) এই জন্যে যে তারা নামায ক্বায়েম রাখবে। অতঃপর আপনি কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের দিকে অনুরাগী করে দিন এবং তাদেরকে কিছু ফলমূল খেতে দিন; হয়তো তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।” [আল-ক্বুরআ’ন, ১৪:৩৭; মুফতী আহমদ এয়ার খান (রহ:) প্রণীত নূরুল এরফান]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, মা হাজেরা (রা:) তাঁর শিশু পুত্রকে বুকের দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করেন এবং পানির মওজূদ হতে পান করতে থাকেন যতোক্ষণ না পাত্রের জল ফুরিয়ে যায়। এরপর তিনি ও তাঁর শিশু তৃষ্ণার্ত হন। মা হাজেরা (রা:) লক্ষ্য করেন যে তাঁর শিশুপুত্র বেজায় তৃষ্ণার্ত হয়ে কাতরাচ্ছেন এবং এর দরুন মাটিতে পা দ্বারা আঘাত করছেন। তিনি শিশুর এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারেননি। আল-সাফা ছিল সবচেয়ে কাছে অবস্থিত পাহাড়। তাই তিনি তাতে আরোহণ করে উপত্যকার ওপারে মানুষজনের খোঁজ করেন। কাউকে না পেয়ে তিনি এরপর উপত্যকা অতিক্রম করে আল-মারওয়াপাহাড়ে ওঠেন। এরকম তিনি সাতবার করেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে মহা্নবী (দ:) এরশাদ ফরমান: এই দুটো পাহড়ের মধ্যবর্তী স্থানে মানুষের সা’ঈ করার কারণ এটাই। [আল-বুখারী রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’,“আল্লাহর বাণী – ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’” শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২২৮-১২২৯ #৩১৮৪; অাল-নাসা’ঈ লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১০০ #৮৩৭৯; আবদুর রাযযাক্ব কৃত আল-মুসান্নাফ, ৫:১০৫-১০৬ #৯১০৭; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১০০ #৮৩৭৯; আল-নাসা’ঈ লিখিত ‘ফাযা’ইলে সাহা’বা’, ১:৮২ #২৭৩; আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ৯:৩৬৮-৩৬৯; এবং ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম’, ১:১৭৭]

মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দীর ধার্মিকতা এতোই সযত্নে লালন করেন যে তিনি একে তাঁর নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।” [আল-ক্বুরআ’ন, ২:১৫৮]
এই ঘটনা আনুমানিক চার হাজার বছর আগে ঘটেছিল। ওই উপত্যকা ও পাহাড়গুলো তাদের মৌলিক আকৃতিতে এখন আর বিরাজ করছে ন। আর খোদাতা’লার প্রিয় বান্দীর শঙ্কাও বর্তমানে অস্তিত্বশীল নেই। তথাপিও হাজ্বী সাহেবান আল্লাহতা’লার আদিষ্ট দুই পাহাড়ের মাঝে সা’ঈ পালন করে থাকেন। এসব কিছুই মা হাজেরা (রা:) কর্তৃক তাঁর পুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর প্রতি অনুভূত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং তাঁরই অস্বস্তিকর ও পেরেশানি অবস্থার স্মরণার্থে করা হয়।

১:১৫.১ যমযম কূপ: নামের উৎপত্তির কারণ

পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:) তীব্র তেষ্টাবোধের কারণে মাটিতে পা দ্বারা আঘাত করলে সেখান থেকে পানির নহর প্রবাহিত হয়। মা হাজেরা (রা:) এতো জোরে পানির স্রোত বইতে শুরু করায় আশঙ্কা করেন যে হয়তো পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর এতে ক্ষতি হতে পারে। তাই তিনি উচ্চস্বরে বলেন, ‘যাম যাম’ (থামো, থামো)! এমতাবস্থায় জলপ্রবাহের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। এ কারণেই অদ্যাবধি এই পানির উৎসকে যমযম নামে অভিহিত করা হয়।

সহস্র সহস্র বছর যাবত প্রবাহিত যমযম কূপের পানি হাজ্বী সাহেবানদের জন্যে এক ঐশী দান বটে। এই পানি ওযূ অবস্থায় ক্বিবলা তথা কা’বার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পান করাটা প্রথাসিদ্ধ; পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর সাথে এর সম্পৃক্ততার দরুন-ই এই বিশেষ বিধান জারি করা হয় [আল-বুখারী রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘যমযম সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়াদি’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৯০ #১৫৫৬; আল-বুখারী কৃত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আশরিবা’, দাঁড়িয়ে পান করা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২১৩০ #৫২৯৪; মুসলিম প্রণীত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আশরিবা’, দাঁড়িয়ে যমযমের পানি পান’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩: ১৬০১-১৬০২ #২০২৭; এবং আল-আইনী লিখিত ‘উমদাত আল-ক্বা’রী শারহে সহীহ আল-বুখারী’, ৯:২৭৭]। বস্তুতঃ যমযম হচ্ছে ধরণীর বুকে সেরা (পানীয়) জল, আর এতে অনেক রোগের আরোগ্য-ও রয়েছে নিহিত।

ওপরোক্ত বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে দ্বীন-ইসলাম কেবল অতীতের ঘটনাবলী স্মরণ-ই করে না, বরঞ্চ বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সেগুলোর উদযাপনকে বাধ্যতামূলক-ও করে দেয়। মওলিদুন্নবী (দ:)-কে ওই একই আঙ্গিক বা দৃষ্টিকোণ্ থেকে দেখতে বা মূল্যায়ন করতে হবে। হযরতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন বিশ্বজগতের জন্যে খোদাতা’লার করুণা, দয়া ও আশীর্বাদের সেরা উৎস। মওলিদুন্নবী (দ:)-তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, যা দ্বারা তাঁর প্রতি প্রত্যেকের ভালোবাসা ও আনুগত্য সুদৃঢ় হয়, তা-ই এ উদযাপনের ভিত্তিমূল।

১.১৬ আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনা: পয়গম্বর আদম (আ:)-এর স্মরণে

প্রতি যিলহজ্জ মাসের নবম দিবসে হাজ্বী সাহেবান আরাফা’ ময়দানে অবস্থান করেন। লক্ষণীয় যে, সুনির্দিষ্ট কোনো এবাদত-বন্দেগীর আদেশ এখানে দেয়া হয়নি। আরাফাতে স্রেফ উপস্থিত থাকাটাই হজ্জ্বের অবশ্য পালনীয় শর্ত পূরণের জন্যে যথেষ্ট। আরাফাত আমাদেরকে পয়গম্বর আদম (আ:) ও মা হাওয়া (রা:)-এর পুনর্মিলিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেটা ৯ই যিলহাজ্ব তারিখে ঘটেছিল; ঠিক যেমনটি এক রওয়ায়াতে প্রমাণিত হয় –

. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: পয়গম্বর আদম (আ:) ভারতে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (রা:) জেদ্দায়। বাবা আদম (আ:) তাঁর স্ত্রীর খোঁজ করতে থাকেন যতোক্ষণ না তাঁরা অবশেষে একে অপরের দেখা পান। মা হাওয়া (রা:) তাঁর কাছে আসেন, যার দরুন তাঁকে ‘মুযদালিফা’ তথা ‘(বাবা আদমের) নিকটে গমনকারিনী’ নামে অভিহিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে ‘আরাফাতে’ চিনতে পারেন, তাই এর নাম আরাফাত (অর্থাৎ, যেখানে একে অপরকে চিনতে পারেন)। তাঁরা জাম’-এ পুনর্মিলিত হন, সে মোতাবেক-ই এর নামকরণ হয়েছে (মানে পুনর্মিলনের স্থান)। [আল-তাবারী লিখিত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল-মুলূক’, ১:৭৯; ইবনে আল-আসীর কৃত ‘আল-কা’মিল ফী আল-তা’রীখ’, ১:৩৪; ইবনে সা’আদ প্রণীত ‘আল-তাবাক্বা’ত আল-কুবরা’, ১:৩৯; এবং ইবনে আসা’কির রচিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৬৯:১০৯]
. পয়গম্বর আদম (আ:) ভারত উপমহাদেশের ‘নাওয়ায’ নামের এক পাহাড়ে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (রা:)-কে জেদ্দায় প্রেরণ করা হয়। ইবনে সা’আদ (১৬৮-২৩০ হিজরী), আল-তাবারী (২৬৪-৩১০ হিজরী) ও ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৭ হিজরী) এই অভিমত পোষণ করেন যে, বাবা আদম (আ:) তাঁর স্ত্রীর সাথে আবার মিলিত হন আরাফাত নামের স্থানে, যার দরুন এই নামকরণ হয়েছে। [আল-তাবারী প্রণীত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল-মুলূক’, ১:৭৯; ইবনে সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বা’ত আল-কুবরা’, ১:৩৫-৩৬; এবং আল-নববী রচিত ‘তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল-লুগা’ত’, ৩:২৩৭]

. আল-ক্বুরতুবী (২৮৪-৩৮০ হিজরী) নিজ ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’ গ্রন্থে লেখেন: পয়গম্বর আদম (আ:) ভারত উপমহাদেশে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (রা:) জেদ্দায়। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সাক্ষাৎ পান আরাফা দিবসে আরাফা’তেরই ময়দানে। অতএব, এই দিনটি আরাফা’ নামে পরিচিত হয়, আর স্থানটি খ্যাত হয় আরাফাত নামে। এটা আল-দাহহা’কের বক্তব্য। [আল-ক্বুরতুবী প্রণীত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ২:৪১৫]

. আল-মুযদালিফা নামকরণের ব্যাপারে ইবনে হাজর আল-আসক্বালা’নী (৭৭৩-৮৫২ হিজরী), এয়া’কূত আল-হামাভী (জন্ম:৬২৬ হিজরী) এবং আল-শওকানী (১১৭৩-১২৫০ হিজরী) লেখেন: আল-মুযদালিফাকে ’জাম’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়, কেননা বাবা আদম (আ:) সেখানেই মা হাওয়া (রা:)-এর সাথে পুনরায় মিলিত হন এবং তাঁর সান্নিধ্য পান। [আল-আসক্বালা’নী রচিত ‘ফাতহুল বা’রী’, ৩:৫২৩; এয়া’কূত আল-হামাভী কৃত ‘মু’জাম আল-বুলদা’ন’, ৫:১২১; এবং আল-শওকা’নী লিখিত ‘নায়ল আল-আওতা’র শারহ মুনতাক্বা’ আল-আখবা’র’, ১:৪২৩]

. মিনা’ নামকরণ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: মিনা’ নামকরণ হয় যখন হযরত জিবরাঈল (আ:) পয়গম্বর আদম (আ:) হতে পৃথক হতে চান এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তিনি (বাবা আদম) কোনো কিছু কামনা করেন কি না। হযরত আদম (আ:) উত্তর দেন, ‘বেহেশত’। একারণেই এই স্থানকে মিনা’ নামে ডাকা হয় – পয়গম্বর আদম (আ:)-এর আকাঙ্ক্ষার দরুন। [আল-আযরাক্বী রচিত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আ’সার’, ২:১৮০; আল-নববী প্রণীত ‘তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল-লুগা’ত’, ৩:৩৩৩; এবং আল-ক্বুরতুবী কৃত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ৩:৭]     
’রামী’ তথা পাথর নিক্ষেপের রীতির মতোই ’সা’ঈ’’তালবিয়্যা’ প্রথাগুলোও আল্লাহতা’লার নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের সম্মানার্থে উদযাপিত আমল। অনুরূপভাবে, ‘আরাফা’ত’‘মুযদালিফা’ স্থানগুলোও সম্মানিত হয়েছে, যেহেতু বাবা আদম (আ:) ও মা হাওয়া (রা:) দীর্ঘকাল পরে সেখানে পুনরায় মিলিত হন। এখানে গুরুত্বারোপ করতে হবে যে, আক্ষরিক অর্খে ‘আরাফা’ত’ বলতে ’চেনা’কে বোঝায়, আর ‘মুযদালিফা’ মানে ’সান্নিধ্য’। মহান আল্লাহতা’লা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পুনর্মিলনের স্মৃতি প্রতি বছর যেলহজ্জ্ব মাসের ৯ তারিখে কীভাবে সেখানে হাজ্বী সাহেবানের উপস্থিতিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়ে পুনর্জাগরিত করেছেন, তা গভীরভাবে ভেবে দেখুন।

১.১৭ আরাফাত ও মুযদালিফায় আদায়কৃত নামাযের একত্রীভবন: মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ

মুসলমানবৃন্দ আল্লাহতা’লার ইচ্ছা মোতাবেক সর্বদা নির্দিষ্ট ওয়াক্তের নামায যথাসময়ে আদায় করে থাকেন। কিন্তু (এর ব্যতিক্রমস্বরূপ) আরাফাতের ময়দানে হাজ্বী সাহেবান যোহর ও আসর ওয়াক্তের নামায একত্রে পড়েন। এটা শুধু এ কারণেই যে প্রিয়নবী (দ:) এই দুই ওয়াক্তের নামায একত্রে পড়েছিলেন; আর তাই হাজ্বী সাহেবানের প্রতি অনুরূপ রীতি পালনের (শরঈ) বিধান জারি করা হয়। একইভাবে, সূর্য ডোবার সাথে সাথে হাজ্বী সাহেবান মাগরেব ও এশা’র নামায-ও একত্রে পড়েন। তাঁরা সরাসরি নামায আদায় করেন না, বরং মুযদালিফায় না পৌঁছুনো পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করেন। এটা নিম্নের রওয়ায়াত দ্বারা সপ্রমাণিত:

. মুহাদ্দেসীনে কেরাম হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:) হতে মহানবী (দ:)-এর বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পর্কে একটি বিশদ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) আরাফাত ময়দানে এক আযান ও দুই এক্বা’মত সহকারে যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করেছিলেন, আর মুযদালিফায় মাগরেব ও এ’শার নামাযের ক্ষেত্রেও একই রকম করা হয়েছিল। [মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘মহানবী (দ:)-এর হজ্জ্ব’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৮৮৬-৮৯২ #১২১৭; এবং আবূ দাউদ লিখিত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক’, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হজ্জ্বের বিবরণ’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৮৫ #১৯০৫]

. ইমাম জা’ফর আল-সা’দিক্ব (রহ:) তাঁর পিতা ইমাম বা’ক্বির (রহ:) হতে বর্ণনা করেন: হুযূর পূর নূর (দ:) আরাফা’তে যোহর ও আসরের নামায এক আ’যা’ন ও দুইটি এক্বা’মত সহকারে (একত্রে) আদায় করেন। তিনি উভয়ের মাঝে আল্লাহ পাকের কোনো ‘তাসবীহ’ (প্রশংসা-বাক্য) পাঠ করেননি। অতঃপর তিনি এক আ’যা’ন ও দুইটি এক্বা’মত সহকারে মাগরেব ও এ’শার নামাযও (মুযদালিফায়) আদায় করেন এবং সেখানেও তিনি উভয়ের মাঝে কোনো তাসবীহ পাঠ করেননি। [আবূ দাউদ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক’, ‘রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হজ্জ্বের বিবরণ’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৮৬ #১৯০৬; এবং আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১:৪০০ #১৭৪১]

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা:) বলেন: আমি কখনোই রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে নামায তার নির্দিষ্ট ওয়াক্ত ছাড়া পড়তে দেখিনি (মানে নামায তরক করেননি); ব্যতিক্রম শুধু (হজ্জ্বের সময়) দুইটি নামায – মাগরেব ও এশা’ একত্রে আদায়। [মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘মুযদালিফায় নাহর দিবসে অন্ধকার থাকতে ফজরের নামায আদায়ের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯৩৮ #১২৮৯; এবং আল-বুখারী লিখিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘জাম’ (মুযদালিফা)-এ ফজরের নামায পড়ার সময়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯০৪ #১৫৯৮]
ক্বুরআ’ন মজীদে যদিও নামায সুনির্দিষ্ট ওয়াক্ত অনুযায়ী আদায়ের হুকুম রয়েছে [আল-ক্বুরআ’ন ৪:১০৩], তবুও হজ্জ্বের সময় আরাফা’তমুযদালিফায় এই সাধারণ আদেশের ব্যতিক্রম করা হয়েছে। এটা প্রিয়নবী (দ:)-এর অনুশীলিত রীতির কারণেই হয়েছে।

১.১৮ পশু কুরবানি: পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর স্মরণে

হজ্জ্বের রীতি পালন করতে হাজ্বী সাহেবান এবং পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর সুন্নাহ’র (স্মারক) উদযাপন করতে বিশ্বব্যাপী মুসলমান সর্বসাধারণ ঈদুল আযহা’র দিন পশু কুরবানি দেন। এই কুরবানী মূলতঃ হযরত ইবরাহীম (আ:) কর্তৃক তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে আল্লাহতা’লার রেযামন্দির খাতিরে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকারই স্মৃতিচারণমূলক আমল বা নেক কাজ। (তাঁর) এই কুরবানির এতোখানি সযত্ন মূল্যায়ন হয়েছিল যে এর ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর হজ্জ্বে হাজ্বী সাহেবানকে একটি করে কুরবানি দিতে (খোদায়ী) নির্দেশ জারি করা হয়। শুধু হাজ্বী সাহেবান-ই নন, প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের প্রতিও আল্লাহতা’লার ওয়াস্তে পশু কুরবানি দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।

ইমাম হাসান আল-বসরী (২১-১১০ হিজরী) বলেন: পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর পরিবর্তে ‘সাবীর’ উপত্যকায় (মক্কা পাহাড়ে) একটি বড় ও হৃষ্টপুষ্ট মদ্দা ভেড়া/দুম্বা কুরবানি দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ এরশাদ ফরমান, “আমি তার (ইসমাঈল আলাইহিস সালামের) স্থলে উৎসর্গস্বরূপ একটি বড় (পশু) কুরবানি (গ্রহণ) করি” [আল-আয়াত]। হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর কুরবানির পরিবর্তে ভেড়া জবাইকেই এই (ঐশী) কুরবানি নির্দেশ করেছে। এতদসত্ত্বেও শেষ বিচার দিবস অবধি প্রতি বছর পশু কুরবানি দেয়ার জন্যে এই উম্মতকে আদেশ করা হয়েছে। (ইমাম হাসান আল-বসরী এরপর শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন) ‘ওহে মানুষ, তোমাদের জানা উচিত যে এই কুরবানি ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদেকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, আর তাই তোমাদেরও এই কুরবানি করা উচিত!’ [আল-তাবারী প্রণীত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল মুলূক’, ১:১৬৭; আল-তাবারী কৃত ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ২৩:৮৭-৮৮; এবং আল-ফা’কাহী রচিত ‘আখবার মক্কা ফী ক্বাদীম আল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ৫:১২৪]

এই আমল (পুণ্যদায়ক কর্ম) নিঃসন্দেহে সর্ব-পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ও ইসমাঈল (আ:)-এর মহা কুরবানিরই উদযাপন, যার দরুন ঈমানদারবৃন্দ প্রত্যাশা অনুযায়ী এ দ্বীনের মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করতে পারেন এবং ফলস্বরূপ আল্লাহতা’লার রেযামন্দির খাতিরে নিজেদের জান ও মাল সমর্পণ করতে প্রস্তুত থাকেন।

১.১৮.১ কুরবানির পশু: আল্লাহর চিহ্নগুলোর একটি

সারা বিশ্বে যদিও পশু জবাই হয়ে থাকে, তবুও পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:)-এর স্মরণে পশু কুরবানি হওয়া একটি অনন্য ঘটনা। এগুলোকে আল্লাহতা’লার ‘শ’আয়ের’ বা চিহ্ন বলা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। এরশাদ হয়েছে: “এবং ক্বোরবানির মোটাতাজা পশুকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম করেছি।” [আল-ক্বুরআ’ন, ২২:৩৬]
আজকে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর এই সুন্নাত পশু কুরবানি দ্বারা পুনর্যাপিত হচ্ছে। এটা একটা পুণ্যদায়ক কর্ম এবং আল্লাহতা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।

১.১৯ কঙ্কর নিক্ষেপ প্রথা: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর সুন্নাহ  

হাজ্বী সাহেবান (হজ্জ্বের অংশ হিসেবে) তিন দিন মিনা’তে অবস্থান করেন এবং তাঁরা সেখানে ‘জামারা’ত’ নামে পরিচিত স্তম্ভগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। এই আমলটি পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর স্মৃতি রক্ষার্থে পালিত হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: হযরত জিবরীল আমীন (আ:) পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-কে ‘জামরা আল-’আক্বাবা’য় নিয়ে গেলে সেখানে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ইবরাহীম (আ:) সাতটি কঙ্কর তার দিকে ছুঁড়ে মারেন, যার দরুন শয়তান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ‘জামরা আল-উসতা’য় অগ্রসর হলে শয়তান আবারো (দ্বিতীয়বার) আবির্ভূত হয়। তিনি তার দিকে (পুনরায়) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলে শয়তান পুনরায় মাটিতে পড়ে যায়। অতঃপর পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় অগ্রসর হলে শয়তান আবারো (তৃতীয়বারের মতো) আবির্ভূত হয়। হযরত ইবরাহীম (আ:) পুনরায় সাতটি কঙ্কর তার দিকে নিক্ষেপ করেন, যার ফলে শয়তান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। [আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৩০৬; আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মোসতাদরাক’, ১:৬৩৮ #১৭১৩; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৫৩ #৯৪৭৫; আল-মাক্বদাসী লিখিত ‘আল-আহা’দীস আল-মুখতা’রা’, ১০:২৮৩ #২৯৬; আল-মুনযিরী রচিত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিনাল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১৩৪ #১৮০৭; এবং আল-হায়সামী কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৩:২৫৯]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) স্বয়ং বলেন: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-কে হজ্জ্বের রীতিনীতি পালনের আদেশ দেয়া হলে পরে হযরত জিবরীল (আ:) তাঁকে ‘জামরা আল-আক্বাবা’য় নিয়ে যান। সেখানে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ইবরাহীম (আ:) তার দিকে (একে একে) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন যতোক্ষণ না সে পালিয়ে যায়। ‘জামরা আল-’উসতা’য়ও সে আবার দেখা দেয়, আর ইবরাহীম (আ:) তার দিকে আবার সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। [অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহূ একটি ক্বুরআ’নের আয়াত তেলাওয়াত করেন যা ঘোষণা করে, “এবং পিতা ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈলকে মাথার ওপর ভর করে শায়িত করলো” (আল-ক্বুরআ’ন, ৩৭:১০৩)]। পয়গম্বর ইসমাঈল (আ:) একটি সাদা রংয়ের জামা পরেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাবা, কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহারের জন্যে আমার তো কোনো কাপড় নেই। অতএব, অনুগ্রহ করে এই জামাটি আমার শরীর থেকে অপসারণ করুন, যাতে আপনি এটা দিয়ে আমাকে দাফন-কাফন করতে পারেন।’ হযরত ইবরাহীম (আ:) যেই তা সরাতে যাবেন, অমনি তিনি এক গায়েবী কণ্ঠস্বর শুনতে পান যা ঘোষণা করে, “হে ইবরাহীম! নিশ্চয় তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে” [প্রাগুক্ত আল-ক্বুরআ’ন, ৩৭:১০৪-১০৫]। হযরত ইবরাহীম (আ:) ঘুরে তাকিয়ে দেখেন একটি সুন্দর, বড় চোখবিশিষ্ট সাদা মদ্দা ভেড়া দাঁড়িয়ে আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) (প্রসঙ্গতঃ) বলেন, “আমরা এ ধরনের ভেড়া/দুম্বা একই জায়গায় বিক্রি করতাম।” অতঃপর তিনি আরো বলেন, “হযরত জিবরীল ফেরেশতা (আ:) পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-কে ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলে সেখানে শয়তান আবির্ভূত হয়। হযরত ইবরাহীম (আ:) তার দিকে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলে সে পালিয়ে যায়। [আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯৭; আল-তাবারা’নী কৃত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ১০:২৬৮ #১০,৬২৮; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৫৩-১৫৪; আল-হায়সামী লিখিত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৩:২৫৯; আল-তাবারী রচিত ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ২৩:৮০; এবং ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-’আযীম’, ৪:১৬]
হযরত ইবরাহীম (আ:) শয়তানের দিকে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় যুগপৎভাবে আল্লাহর ‘তাকবীর’ (শ্রেষ্ঠত্ব) পাঠ করেছিলেন। এর প্রমাণস্বরূপ হযরত মুজাহিদ ইবনে যুবায়র (বেসাল: ১০৪ হিজরী) বলেন: পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) হযরত জিবরীল ফেরেশতা (আ:)-এর সাথে অগ্রসর হন। ‘জামরা আল-’আক্বাবা’ অতিক্রমকালে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত জিবরীল (আ:) বলেন, ‘আপনি তাকবীর পাঠ করে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ শয়তান আবারো ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় দেখা দিলে জিবরীল ফেরেশতা (আ:) আবারো পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-কে বলেন, ‘তাকবীর পাঠ করে তাকে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ [আল-আযরাক্বী প্রণীত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আ’সার’, ১:৬৮]   

শয়তানের দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা শুধু পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এরই সুন্নাত নয়, বরঞ্চ এটা পয়গম্বর আদম (আ:)-এরও সুন্নাত। ইমাম আল-কালবী লেখেন: জিমা’র (কঙ্কর যে স্থানটিতে নিক্ষেপ করা হয়) নামকরণ হয়েছে, কেননা পয়গম্বর আদম (আ:) ইবলীস শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতেন যখনই সে তাঁর সামনে থেকে পালাতে থাকতো। [আল-আযরাক্বী রচিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ২: ১৮১]

সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রিয় বান্দার হাতে হাজার হাজার বছর আগে সংঘটিত এই কাজটি মহাপ্রভুর কাছে এতোই সন্তুষ্টির ছিল যে তিনি এই উম্মতের প্রতি (হজ্জ্বের রীতি হিসেবে) তা আবারো পালনের আদেশ জারি করেন। এটা হজ্জ্বের প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে যায়; যা ব্যতিরেকে হজ্জ্ব অসম্পূর্ণ রবে।

এই আমল উদ্দেশ্য ও অর্থহীন নয়। কেননা, এটা আমাদেরকে তিনটি বিষয় শিক্ষা দেয়:

(১) আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের সুন্নাতের ধারাবাহিকতা;

(২) এ কাজের অনুকরণের ফলে আম্বিয়া (আ:)-এর প্রতি মহব্বত ও আনুগত্য প্রকাশ হয়;

(৩) শয়তানের প্রতিনিধিত্বকারী স্তম্ভের দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করে মুসলমানবৃন্দ শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন।

এই পুরো আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করে আবেগের বহিঃপ্রকাশ কেবল শরীয়তে জায়েয-ই নয়, বরং এটা মহান আল্লাহতা’লার আরোপিত একটি রীতি-ও। এরই আলোকে মুসলমান সর্বসাধারণ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে খুশি প্রকাশার্থে ধর্মীয় সভা-সমাবেশ/মাহফিলের আয়োজন করেন, তাহলে তা সম্পূর্ণ জায়েয বা বৈধ হবে।
এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন মহানবী (দ:)-এর সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন সৃদৃঢ় করে থাকে এবং তাঁর প্রতি আমাদের এশক্ব-মহব্বত ও বিশ্বাস-ও বৃদ্ধি করে বটে। প্রেমাস্পদকে স্মরণ করা এবং তাঁর মহব্বতে বিলীন হওয়া এমনই সব আহওয়াল (আধ্যাত্মিক অবস্থা) যা আল্লাহর দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যায়িত একটি বিষয়। খালেস নিয়্যতে তথা সৎ উদ্দেশ্যে পবিত্র কা’বায় হজ্জ্বে গমন পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:)-এর প্রতি আমাদের স্মৃতি জাগরূক রাখে, আর এরই ফলে মহান আল্লাহতা’লা আমাদের ছোট-বড় সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন [হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহূ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, ‘যে কেউ হজ্জ্ব পালন করলে, এবং কোনো অশোভনীয় আচরণ বা অপরাধ না করলে, সে তার মায়ে তাকে জন্ম দেয়ার দিনের মতোই নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ এই হাদীসটি রওয়ায়াত করেছেন আল-বুখারী নিজ ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘ক্ববূল হজ্জ্বের গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ২: ৫৫৩ #১৪৪৯ গ্রন্থে; ইবনে আল-জা’আদ তাঁর ‘আল-মুসনাদ’, পৃষ্ঠা ১৪১ #৮৯৬ পুস্তকে; ইবনে মুনদাহ আপন ‘আল-ঈমান’, পৃষ্ঠা ৩৯২ #২৩০ বইয়ে; আল-মাক্বদিসী তাঁর ‘ফাদা’য়েল আল-আ’মাল’, পৃষ্ঠা ৮১ #৩৪৭ কিতাবে; এবং আল-তাবারী নিজ ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ২:২৭৭ পুস্তকে]। সে তুলনায় মওলিদুন্নবী (দ:) উদযাপনের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি যে মুসলমান-ব্যক্তি সালাত-সালাম পেশ করেন এবং হুযূরে পূর নূর (দ:)-এর সাথে নিজ আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় করেন, তাঁর জন্যে কী (ঐশী) পুরস্কার মঞ্জুর হতে পারে? বস্তুতঃ রাসূল-প্রেম ঈমানের সার তথা নির্যাস নয় কি?

১.১৯.১ একটি আপত্তি

অনেক মানুষ আছেন যারা মওলিদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেন না। তাদের আপত্তি হলো, মহানবী (দ:)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের উদযাপন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কেননা, তাঁকে প্রেরণের (ঐশী) উদ্দেশ্য আমাদেরকে সঠিক পথপ্রদর্শন ও শরীয়তের জ্ঞান শিক্ষা দান ছাড়া কিছু নয়। তাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত তাঁরই শিক্ষার অনুসরণে কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আমাদের জীবন যাপন করা এবং অন্যদেরকেও একই রকম করতে বলা। এই আপত্তি উত্থাপনকারীদের মতে, মওলিদ উদযাপন স্রেফ পণ্ডশ্রম এবং সময়েরও অপচয়।

১.১৯.২ আপত্তির প্রতি আমাদের জবাব

এব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মহানতম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যে তাঁর সুন্নাহ-রূপী হেদায়াতের আলো দ্বারা আমাদেরকে আশীর্বাদধন্য করতে (আল্লাহতা’লা কর্তৃক) প্রেরিত হয়েছিলেন এবং দ্বীন-ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য-ই নেই। হুযূর পাক (দ;)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ এবং ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন যাপন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আমাদের প্রতি। আর আমরাও খোদাতা’লার অনুগ্রহ ও দয়ায় ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠার জন্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যবহারিকভাবে সংগ্রাম বা সাধনা  করেছি। আমরা যে ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করছি, তা হচ্ছে মওলিদুন্নবী (দ:)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যের ব্যাপারে, আর এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা বিষয়।

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এবং তা অনুসরণ করার কোনো আলোচনাই এখানে নিহিত নেই, কেননা সেটা ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে (ধর্মের) আরো অনেক দিক রয়েছে। ধর্মের মধ্যে শুধু আমল (নেক কাজ) অন্তর্ভুক্ত নয়, বরঞ্চ এতে এশক্ব-মহব্বত ও ভক্তির মতো আবেগ-ও বিদ্যমান। আর এই দিকটির সাথেই মওলিদুন্নবী (দ:) উদযাপনের বিষয়টি (গভীরভাবে) সম্পর্কিত।

মহান প্রভু আল্লাহতা’লা তাঁরই রাসূল (দ:)-কে আমাদের মাঝ হতে আবির্ভূত করে আপন সর্ববৃহৎ নেয়ামত (মানে আশীর্বাদ) মানব সভ্যতার প্রতি মঞ্জুর করেছেন। যেদিনটিতে তাঁর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) হয়, সেদিনটি মহা আনন্দের এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও বটে। (খোদায়ী) আশীর্বাদরূপী বিশ্বনবী (দ:)-এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদের প্রতি তাঁরই করুণা ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন। এই কারণেই হুযূরে পূর নূর (দ:)-এর বেলাদত দিবস উদযাপন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মহামূল্যবান একটি কাজ। এটা এমন-ই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা অবহেলা বা অবজ্ঞা করার মতো নয়।

আমাদের যুগ হতে হাজার হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলোতে (ঐশী) শিক্ষা বিদ্যমান। হজ্জ্বের রীতিগুলোই ধরুন, প্রথম নজরে এর বিভিন্ন রীতির মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক-ই (খুঁজে) পাওয়া যাবে না। দৃশ্যতঃ এগুলো বিচ্ছিন্ন বা পৃথক পৃথক ঘটনা, যেগুলো এখন অতীত। ব্যবহারিক অর্থে এসব ঘটনা আমাদের জন্যে কী শিক্ষা বহন করে? অতএব, এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে ইসলাম ধর্ম উভয় বাস্তবতাকেই দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করে: দ্বীন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐশী বিধানের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় শিক্ষার দিকগুলো যেমন দ্বীন-ইসলাম তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করে, ঠিক তেমনি আবেগের দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে, যেটা আমাদের মন ও মগজে ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃৃতি জাগরূক রেখে আমাদেরই জীবনে ভূমিকা পালন করে থাকে। সার কথা হলো, ইসলাম ধর্ম অতীত ঘটনাবলীকে দেখে থাকে দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে: ব্যবহারিক/বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং আবেগের দৃষ্টিভঙ্গি।

প্রিয়নবী (দ:)-এর বেলাদত উপলক্ষে অন্তহীন খুশি প্রকাশ হচ্ছে এর ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। অর্থাৎ, এই ঘটনা আমাদের স্মৃতিপটে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে কখনোই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। তাই মওলিদুন্নবী (দ:)-এর শুভলগ্নে খুশি ও আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করে। ওর প্রাপ্য সম্মান দেয়ার জন্যেই তা করা হয়।
এই বইয়ের পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলো হতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে হজ্জ্বের রীতিগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লার প্রিয় ও আশীর্বাদধন্য বান্দাদের জীবনের সাথে জড়িত ঘটনাসংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব ঘটনার স্মৃতি খোদাতা’লার নিদর্শনস্বরূপ সংরক্ষিত হয়েছে। এব্যাপারে যদি কোনো ভিন্নমত বা মতপার্থক্য না থাকে, তাহলে মওলিদুন্নবী (দ:) উদযাপনের ব্যাপারেও কোনো আপত্তি আর থাকা উচিত নয়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!