মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কি মদ স্পর্শ করেছেন? – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।
মওলা আলী ইবনে আবি ত্বালিব আলাইহিস সালাম ওয়া রাদ্বিয়াল্লহু আনহু

“মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নামাযে সূরা আল-কাফিরুনে পেঁচ লাগিয়ে দিয়েছে.. ” নাউজুবিল্লাহ। এরকম বেয়াদবিপূর্ণ বর্ণনা কোনও হাদিসে নেই। মদপানের কিছু ঘটনার কথা হাদিসে আছে। তবে সব বর্ণনা সত্য নয়। মিথ্যা হাদিস বর্ণনায় উমাইয়্যা, খারেজী এবং শিয়ারা সমানভাবে অবদান রেখেছে। অনেক মিথ্যা কথাও সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোনও বর্ণনা সত্য না মিথ্যা তা কীভাবে বুঝবেন? মুহাদ্দিসগণ হাজার বছর পূর্বেই সত্য/মিথ্যা আমাদের কাছে পরিষ্কার করে গেছেন। একই সনদে যখন বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যাবে, তখন সবগুলো বর্ণনা সত্য হতে পারে না। এর একটি সত্য এবং বাকিগুলো মিথ্যা বলে পরিগণিত হবে। মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মদপানের ব্যাপারে উপরের বক্তব্যটিও মিথ্যা। সে কথাই মুহাদ্দেসীনে কেরামের পর্যালোচনার আলোকে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো ইন শা আল্লাহ। 

মদ হারাম হবার পূর্বেও মানুষ মদ খাওয়াকে খারাপ মনে করতো। হারাম হবার পরেও একে খারাপ মনে করতো। কি মুসলমান, কি কাফের, কেউই মদকে ভালো হিসেবে গ্রহণ করতো না। মাদক মানেই মন্দ। এরপরও অনেকেই মদ পান করতো, নেশা করতো। মন্দ জিনিসেরর প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বভাবগত। তবে মদ যে মন্দ তা অনেকেই উপলব্ধি করতেন। মদ হারাম হবার পূর্বে সাহাবাদের কেউ কেউ মদ পান করতেন, এমন কথা হাদিসে রয়েছে। তবে মদ নিষিদ্ধের আয়াত নাযিল হবার সাথে সাথে সাহাবাদের যার সামনে যে পরিমাণ মদ ছিল, তারা তা মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে ছিলেন। মদ যে মন্দ তা মদ নিষিদ্ধ হবার বাসনায় উমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ’র দোয়া থেকেই শক্তভাবে প্রমাণিত হয়। সূরা আল-মায়িদাহঃ ৯০-৯১ আয়াত নাযিল হবার সাথে সাথেই উমার (রাঃ) বললেন, “আমরা এসব কাজ বর্জন করলাম”। [সুনান আবূ দাউদ – ৩৬৭০]

মদের আয়াত নাযিলের যে চারটি ঘটনা হাদিসগুলোতে এসেছে, এর একটি উমর রাঃ’র বাসনা ও দোয়া। উপরে রেফারেন্সে উল্লেখিত হাদিসটি লক্ষণীয়।

মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জন্মের পর থেকেই রাসূল ﷺ-এঁর সাথী ছিলেন। তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে তিনি বড় হয়েছেন। তিনি আহলে বাইত আতহারগণের অন্যতম। তাঁর পবিত্রতার পক্ষে আল্লাহ পাক গ্যারান্টি দিয়েছেন সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে। হারাম হবার পূর্বেও তিনি মদ স্পর্শ করেন নি, আর হারাম হবার পর তো মদ স্পর্শ করার প্রশ্নই আসে না। কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অপবাদ খারেজীদের কাজ। সেকথাই প্রমাণিত হবে নিচের তথ্যভিত্তিক আলোচনায়।

উসুলে হাদিসের একটি সূত্র রয়েছে। সূত্রটি হল, হাদিসের কোনও বক্তব্য কুরআনের আয়াতের বিরুদ্ধে গেলে ওই হাদিসের বক্তব্য পরিহার্য। ঠিক একই ভাবে এক হাদিসের বক্তব্য অন্য হাদিসের বক্তব্যের বিরুদ্ধে গেলে অধিক নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হাদিসটি গ্রহণীয়, বাকিগুলো পরিত্যাজ্য। এটাই উসুলে হাদিসের ডিক্রি।

মদ নিষিদ্ধ হবার চারটি ঘটনা রয়েছে। এক. মদের মাদকতা সম্পর্কে সাহাবাগণের অনেকেই সচেতন ছিলেন এবং এ নিয়ে রাসূল ﷺ-কে প্রশ্ন করেন। এর উত্তরে আয়াত নাযিল হয়। দুই. মদ নিষিদ্ধ হবার বাসনায় উমর রাঃ’র দোয়া করেন এবং তাঁর দোয়ার জবাবে আল্লাহ পাক আয়াত নাযিল করেন, তিন. এক আনসারী সাহাবী কয়েকজনকে দাওয়াত করেন এবং সেখানে মদ পরিবেশন করেন। এতে অনেকেই নেশার ঘোরে এমন কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন যাতে আনসারগণকে ছোটো করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয় এবং চার. এক আনসারী সাহাবী মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুর রহমান বিন আউফ রা-কে দাওয়াত করেন এবং সেখানে মদের ব্যবস্থা করেন। মাগরিবের নামাযের সময় হলে তাদের একজন ইমামতি করেন এবং সূরা আল-কাফিরুনে ভুল করেন। এর জবাবে আয়াত নাযিল হয়। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা মায়েদার ৯০ নং আয়াত দ্রষ্টব্য]

মদ নিষিদ্ধের আয়াত নাযিল হয় বিদায় হজ্বের কিছুদিন পূর্বে। অথচ মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং আহলে বাইত আতহারগণকে “রিজস” থেকে পবিত্র রাখার ওয়াদা সম্বলিত আয়াত নাযিল হয় তারও প্রায় ২ বছর পূর্বে। সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, “আল্লাহ তা’আলা তো চান আহলে বাইত হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” এ আয়াত নাযিল হবার পর নবীজী ﷺ ফাতিমাহ, হাসান ও হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ডাকলেন এবং তাদেরকে একটি কম্বলের ভেতর ঢেকে নিলেন। আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তার পিছনে ছিলেন। তিনি তাকেও কম্বলের ভিতর নিয়ে নিলেন। তারপর তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত (পরিবারের সদস্য)। তুমি তাদের ভিতর হতে অপরিচ্ছন্নতা দূর করে দাও এবং সম্পূর্ণরূপে পরিচ্ছন্ন করে দাও।” [সূনান আত তিরমিজী – ৩২০৫]

অপরদিকে মদ নিষিদ্ধের আয়াতে আল্লাহ পাক মদকে “রিজস” বা অপবিত্র বলেছেন। মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মদ পান করেছেন বলে যে বর্ণনা রয়েছে তা সত্যি হলে তো কুরআনের উল্লেখিত আল্লাহ পাকের ওয়াদা আহলে বাইতকে রিজস থেকে পবিত্র রাখার কথা মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয় এবং খোদ রাসূল ﷺ -এর দোয়াও বিফলে গিয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়। নাউজুবিল্লাহ। উসূলে হাদিসের সূত্রমতে এই হাদিসের বক্তব্য কুরআনের আয়াত এবং রাসূল ﷺ-এঁর দোয়ার বিরুদ্ধে যায়। কাজেই এই হাদিস গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্যদিকে একই সনদে বর্ণিত এই হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন রকমের মতন বা বর্ণনা পাওয়া যায়। যা হাদিস শাস্ত্রের সূত্র অনুযায়ী হাদিসটির বক্তব্য প্রত্যাখ্যাত হবার জন্য যথেষ্ট।

আবু দাউদ শরীফের ৩৬৭১ এবং তিরমিজি শরীফের ৩০২৬ নং হাদিসের সনদ এক এবং অদ্বিতীয়। অথচ লক্ষ্য করুন একই সনদে বর্ণিত হলেও হাদিসের মতনে বেশ কিছু গড়মিল রয়েছে। ঠিক একই সনদের একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমাম হাকেম নিশাপুরী রহঃ। পরপর এই তিনটি হাদিস উল্লেখ করছি, দেখুন কীভাবে একই সনদের হাদিসে ভিন ভিন্ন কথা এসেছে। ফলে মুহাদ্দেসীনে কেরামের ফায়সালা মতে একমাত্র মুসতাদরাকে হাকীমের হাদিসটিই গ্রহণযোগ্য। আর বাকি দুটি হাদিস অগ্রহণযোগ্য এবং পরিত্যাজ্য।

আবু দাউদ শরীফের ৩৬৭১ নং হাদিসটি এরকমঃ

حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى، عَنْ سُفْيَانَ، حَدَّثَنَا عَطَاءُ بْنُ السَّائِبِ، عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ السُّلَمِيِّ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ عَلَيْهِ السَّلَام: أَنَّ رَجُلًا، مِنَ الْأَنْصَارِ دَعَاهُ وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ فَسَقَاهُمَا قَبْلَ أَنْ تُحَرَّمَ الْخَمْرُ، فَأَمَّهُمْ عَلِيٌّ فِي الْمَغْرِبِ فَقَرَأَ قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ فَخَلَطَ فِيهَا، فَنَزَلَتْ (لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ) [النساء: ٤٣]

আলী ইবনু আবূ তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত। একদা আনসার গোত্রের এক লোক তাকে ও আব্দুর রাহমান ইবনু আওফ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে দা‘ওয়াত করে উভয়কে মদ পান করালেন তা হারাম হওয়ার পূর্বে। অতঃপর মাগরিবের সালাতে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাদের ইমামতি করলেন। তিনি সূরা ‘‘কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন’’ পাঠ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অতঃপর এ আয়াত অবতীর্ণ হলোঃ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন মাতাল অবস্থায় থাকো তখন সালাতের কাছেও যেও না। সালাত তখনই পড়বে, যখন তোমরা কি বলছো তা সঠিকরূাপ বুঝতে পারো।’’ (সূরা আন-নিসাঃ ৪৩)

বিঃ দ্রঃ এই হাদিসটি মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে বলা হলেও তিনি বলেছেন একথা এবারতে আসেনি। এবং বলা হচ্ছে, “একদা আনসার গোত্রের এক লোক তাকে ও আব্দুর রাহমান ইবনু আওফ (রাঃ)-কে দা‘ওয়াত করে.. “। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই হাদিসের বর্ণনাকারী হলে তিনি কখনোই বলবেন না, “তাকে” দাওয়াত করেছিল। তিনি বলতেন, “আমাকে দাওয়াত করেছিল”। এবং তিনি বলতেন, নামাযে আমি ইমামতি করলাম। তিনি বর্ণনাকারী হলে কখনোই বলবেন না, আলী ইমামতি করলেন। এতে এই হাদিসের মতনে গড়বর লক্ষ্য করা যায়।

এবার দেখুন তিরমিজি শরীফে বর্ণিত একই সনদের হাদিসটি।

حَدَّثَنَا عَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ سَعْدٍ، عَنْ أَبِي جَعْفَرٍ الرَّازِيِّ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ السَّائِبِ، عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ السُّلَمِيِّ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ صَنَعَ لَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ طَعَامًا فَدَعَانَا وَسَقَانَا مِنَ الْخَمْرِ فَأَخَذَتِ الْخَمْرُ مِنَّا وَحَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَقَدَّمُونِي فَقَرَأْتُ ‏:‏ ‏(‏ قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ ‏)‏ لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ وَنَحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ‏.‏ قَالَ فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى ‏:‏ ‏(‏ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَقْرَبُوا الصَّلاَةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ ‏)‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ ‏.

আলী ইবন আবূ তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আবদুর রহমান ইবন আওফ একবার আমাদের জন্য আহারের আয়োজন করেন এবং আমাদের দাওয়াত করলেন। সেখানে আমাদের মদ পান করান (তখনও মদ হারাম হয়নি)। আমাদেরকে মদের নেশায় ধরে। ইতোমধ্যে সালাতের ওয়াক্ত এসে পড়ে। এমতাবস্থায় লোকেরা আমাকেই ইমামত করতে এগিয়ে দেন। আমি (সালাতে) কিরআত করলামঃ (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ ‏ لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ وَنَحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ) এবং  (وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ)  এর স্থলে পড়ে পড়লাম  (وَنَحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ)  তোমরা যাদের ইবাদত কর আমরাও তাদের ইবাদত করি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এই আয়াত নাযিল করেনঃ হে মুমিনগণ! মদ্যপানোম্মত্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হবে না যতক্ষণ না তোমরা বল তা বুঝতে পার। (৪: ৪৩)। [সূনান তিরমিজী ৩০২৬]

অথচ দুটো হাদিসই মওলা আলী থেকে আব্দুর রহমান সুলামী এবং তার থেকে আত্বা ইবনে সায়েব বর্ণনা করেছেন।  এবার একই সনদে বর্ণিত মুসতাদরাক থেকে হাদিসটি দেখুন।

أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ دُحَيْمٍ الشَّيْبَانِيُّ، ثنا أَحْمَدُ بْنُ حَازِمٍ الْغِفَارِيُّ، ثنا أَبُو نُعَيْمٍ، وَقَبِيصَةُ، قَالَا: ثنا سُفْيَانُ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ السَّائِبِ، عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: دَعَانَا رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ قَبْلَ تَحْرِيمِ الْخَمْرِ، فَحَضَرَتْ صَلَاةُ الْمَغْرِبِ، فَتَقَدَّمَ رَجُلٌ ” §فَقَرَأَ قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ فَالْتَبَسَ عَلَيْهِ فَنَزَلَتْ {لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ} [النساء: 43] الْآيَةُ «هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَلَمْ يُخْرِجَاهُ» وَفِي هَذَا الْحَدِيثِ فَائِدَةٌ كَثِيرَةٌ وَهِيَ أَنَّ الْخَوَارِجَ تَنْسِبُ هَذَا السُّكْرَ، وَهَذِهِ الْقِرَاءَةَ إِلَى أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ دُونَ غَيْرِهِ وَقَدْ بَرَّأَهُ اللَّهُ مِنْهَا فَإِنَّهُ رَاوِي هَذَا الْحَدِيثِ 

আলী ইবন আবূ তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমাদেরকে একবার এক আনসারী দাওয়াত করলেন, মদ হারাম হবার পূর্বে। ইতোমধ্যে মাগরেবের নামাযের সময় এসে পড়ে। একলোক ইমামতিতে দাঁড়িয়ে ক্বিরআত পাঠ করলো, قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ । অতঃপর এতে গোলমাল করে ফেলল। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এই আয়াত নাযিল করেনঃ হে মুমিনগণ! মদ্যপানোম্মত্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হবে না যতক্ষণ না তোমরা বল তা বুঝতে পার। (৪: ৪৩)।

ইমাম হাকীম এরপর মন্তব্য করেন, এই হাদিসটি সনদের দিক থেকে বিশুদ্ধ তবে বুখারি ও মুসলিম এই হাদিসটি বর্ণনা করেন নি। এই হাদিসটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। খারেজীরা এই হাদিসে পরিবর্তন এনে মদ এবং নামাযে ক্বিরআত পাঠকে আমিরুল মু’মেনীন আলী ইবনে আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সম্পৃক্ত করেছে। অথচ এই হাদিস বর্ণিত হবার অনেক আগেই আল্লাহ পাক তাঁকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। [মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন: ৩১৯৯]

এবার সম্মানিত পাঠকই বিচার করুন, একই সনদের হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন মতন বা বর্ণনা রয়েছে। একটিতে দাওয়াতের আয়োজন করেন আনসারী এক সাহাবি, অন্যটিতে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ এবং প্রথম দুটিতে নামাযে ইমামতি করেন মওলা আলী এবং শেষেরটিতে ইমামতি করেন এক ব্যক্তি। মুহাদ্দেসীনে কেরাম এই হাদিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, আতা ইবনে সায়েব নামে এক ব্যক্তি বিশ্বস্ত রাবি। তবে তিনি শেষ বয়সে এমনই স্মৃতিশক্তিহীন হয়ে পড়েন যে, একই হাদিস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করতেন। ফলে এই আতা ইবনে সায়েবের প্রথম জীবনের হাদিসগুলো বিনা দ্বিধায় গ্রহণযোগ্য এবং শেষ জীবনের হাদিসগুলো বাতিল বলে সর্বসম্মতিক্রমে সাব্যস্ত হয়। তার থেকে যারা প্রথম জীবনে হাদিস গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে একজন হলেন সুফিয়ান সাওরী। উল্লেখ্য, ইমাম হাকিম থেকে বর্ণিত হাদিসটির রাবি সুফিয়ান সাওরী। ফলে আহলে হাদিসের গুরু শায়খ ইবনে তাইমিয়াও মুসতাদরাকে বর্ণিত এই হাদিসটিকে সহীহ বলে মত দিয়েছেন।

সে যুগে খারেজীরা মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কাফের ফতোয়া দিতো, আর এই যুগেও নব্য খারেজীরা মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শান ও মানকে ধুলায় লুণ্ঠিত করতে নিজ ইলম অনুযায়ী বর্জিত হাদিস বর্ণনা করছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে ঈমানের মূল মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে।

[তথ্যসূত্রঃ মুজাদ্দেদে জামান ডঃ প্রফেসর তাহিরুল কাদরী মাঃ জিঃ আঃ, সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী, শায়খ সাইফুল আযম আজহারী, ইবনে কাসীর, মুসতাদরাকে হাকীম আলাস সাহিহাইন, তিরমিজি ও আবু দাউদ।]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

3 thoughts on “মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কি মদ স্পর্শ করেছেন? – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী”

  1. মুসতাদরাক এ বর্ণিত হাদিসটি পড়লাম। পড়ার পর কয়েকটি প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। যেমন :
    ১. আমন্ত্রিতদের মধ্যে মাওলা আলী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু সবচেয়ে বেশি যোগ্য। সুতরাং তাঁকে বাদ দিতে আর কারো নামাজ পড়ানো কতটা গ্রহণযো?
    ২. মদ্যপানে নেশা হয়। সুতরাং মদপান করেছেন এমন একজন সম্মানিত সাহাবীকে (র) ইমামতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে?

    Reply
    • ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

      ১। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, সাহাবাগণ সে সময়ে বয়স বা যোগ্যতা দেখে ইমামতির দায়িত্ব পালন করতেন না। নামাযের সময় হলে কেউ একজনকে সামনে এগিয়ে দেয়া হতো আর তিনি নামায পড়াতেন, হাদিসে যেমনটি এসেছে। তবে কেউ বিশেষ কোনও দায়িত্ব থাকলে তিনিই পদাতিকার বলে ইমামতি করতেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। যেমন কেউ যুদ্ধে সেনাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বা কোনও অঞ্চলের কাজী বা শাসক নির্বাচিত হয়েছেন তখন তিনিই নামাযে ইমামতি করবেন বা করতেন। আলোচ্য ঘটনাটি ছিল একজন সাহাবীর ঘরে দাওয়াত। কাজেই যে কেউ ইমামতি করতে পারেন। এটা অস্বাভাবিক কিছু বিষয় নয়।

      ২। মদ্যপান নেশা হয় বলেই তো পরবর্তীতে তা হারাম করা হয় এবং এ নিয়ে কুরআনে পরপর সাবধান বাণী এসেছে। আর মদপান হারাম হবার পূর্বে সাহাবাগণের অনেকেই তা পান করতেন, তবে সবাই নয়। যেমন হযরত আবু বকর রা এবং উসমান রা তা কখনোই করতেন না। পর্যায়ক্রমে মদপান হারাম হবার সময় যেসব সাহাবা মদপানে মত্ত ছিলেন, মদপান হারামের ঘোষণা শুনার পর সাথে সাথে তারা তাদের সামনে থাকা মদ মাটিতে ফেলে দিয়েছেন। মদের আয়াতের তাফসীর দেখলেই এর সত্যতা খুঁজে পাবেন।

      তবে আহলে বাইতের ব্যাপারে যেহেতু আল্লাহ্‌ পাক নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁদেরকে সব ধরণের নাজাসাত বা অপবিত্রতা থেকে হেফাজত করবেন, কাজেই মদ হারাম হবার পূর্বে বা পরে কখনো আহলে বাইতের কেউ তা পান করেন নি। ধন্যবাদ।

      Reply
  2. সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে মহানবীর জীবদ্দশায়। যদি মহানবীর নবুয়ত প্রাপ্তির দিন থেকে হাদীস সংকলন সহী শুদ্ধভাবে শুরু করা হত এবং মহানবীর মৃত্যুতে তার সমাপ্তি হত তাহলে আজ আর জাল, সহী, ভূয়া ইত্যাদি হাদীস নিয়ে আলেম ওলামাদের মধ্যে এত মতানৈক্য হত না, মানুষও বিভ্রান্তির শিকার হত না। কেন যে সেটা করা হলো না তা বোধগম্য হচ্ছে না। স্কুলের ইসলামী শিক্ষার শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছিলাম, মহানবীই নাকি হাদীস লিখে রাখতে নিষেধ করেছিলেন যাতে কোরানের হাদীসের সাথে মিশামিশি হয়ে না যায়। অজুহাতটি খুব সুবিধের নয়।

    Reply

Leave a Comment