– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
শিক্ষা জীবন শুরু হয় আমিয়াপুর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে। পঞ্চম শ্রেণী সমাপনির পর স্কুল ছেড়ে দিলাম। তা হয়েছিল আমার বাবার ইচ্ছায়। ভর্তি হলাম বদরপুর আদমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। পঞ্চম শ্রেণীর পর মাদ্রাসায় ইবতেদায়িতে। অর্থাৎ ক্লাস সিক্স-এ ভর্তি না হয়ে মাদ্রাসায় আবার প্রথমশ্রেণীতে ভর্তি হলাম। ছাত্র হিসেবে খুব তুখোড় থাকায় এক বছরে দু বার অটো প্রমোশন নিয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলাম। পরের বছরও একইভাবে আবার অটো প্রমোশন দেয়া হলো মাদ্রাসা সুপারের পক্ষ থেকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক বিশেষ অর্ডিন্যান্সে মাদ্রাসা শিক্ষাকে উন্নীত করার লক্ষ্যে দাখিলকে মেট্রিকের মান ঘোষণা করলেন। পূর্বে তা ছিল ৮ম শ্রেণীর সমমানের। ফলে অটো-প্রমোশন এবং এই বিশেষ অর্ডিন্যান্সের কারণে আমার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে গ্যাপ কমে দুবছরে নেমে এলো। প্রাইমারি স্কুলের আমার সাথীরা যখন মেট্রিক পাশ করেছে, আমি তখন এইট পাশ করলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবো। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে গেল। ভর্তি হলাম ঢাকা মুহাম্মাদপুরের তৎকালীন সর্ববৃহৎ আলিয়া মাদ্রাসা জামেয়া কাদেরারিয়া তৈয়্যবিয়াতে। দুবছর পর দাখিল পরীক্ষা দিলাম। আলিম পাশ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং মেধা তালিকায় প্রথম দিকেই স্থান করলাম। মাদ্রাসায় পড়াশুনার সময় থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে জড়িত ছিলাম। ফলে সাহিত্য আমার কাছে প্রিয় বিষয় ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ একটি নিয়মের কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ভর্তি হতে পারলাম না। মাদ্রাসায় উচ্চমাধ্যমিকে বাংলায় মাত্র ১০০ নম্বর। তাদের শর্ত ছিল এতে ২০০ নম্বর থাকতে হবে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আমি আমার নিজের মাতৃভাষায় ভর্তি হবার জন্যে অযোগ্য বিবেচিত হলেও ইংরেজ বেনিয়াদের ভাষায় ভর্তি হবার জন্যে ঠিকই যোগ্য বিবেচিত হলাম।
তিনমাস পর এডজাস্টমেন্টের সুযোগ দেয়া হয়। সে সুযোগে ইংরেজি সাহিত্য থেকে জাম্প করলাম ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে। ভিনদেশি ভাষা নিয়ে পড়াশুনা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হলো। তারচে বরং ইসলামের ইতিহাস আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ায় এতে আমার রেজাল্ট ছিল চমকপ্রদ।
১৯৯৫ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা চলাকালীন সুইডেনের লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির অফার পেলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব-র্যাঙ্কিং-এ ৬০ থেকে ৭০ এর মধ্যে উঠানামা করে। ফলে কোনও চিন্তাভাবনা না করেই তা গ্রহণ করলাম এবং সুইডেন চলে এলাম। প্রথম বছরটি গেল সুইডিশ ভাষা শিখতে এবং পরের বছরটি গেল শর্তানুযায়ী আরেকবার মাস্টার্স করার। সেটি ছিল কম্পারেটিভ রিলিজিয়নের উপর। বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে ভিন দেশে কিছুতেই মন টিকছিল না।
বিশেষ করে মায়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। তখনকার দিনে মোবাইল, ইন্টারনেট, অনলাইন কল কিছুই ছিল না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। জরুরী কিছু হলে ফ্যাক্সেও যোগাযোগ করেছি। মায়ের চিঠি পেলেই জানতে পারতাম মা আমায় না দেখে কান্নাকাটি করতেন। আমার মায়ের সবচে বেশি রাগ হতো সেই বিমানটির উপর যে বিমানটি আমাকে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিয়েছিল। আকাশে উড়ন্ত বিমান দেখলেই মা আমার অঝোরে কাঁদতেন। সে কান্নার রোল ১২ হাজার কিমি দূরে সুইডেনে আমার মনে এসে প্রভাব বিস্তার করতো। ফলে বছরে একবার করে দেশে যেতাম এবং অন্তত তিন মাস অবস্থান করতাম। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ে পিএইচডি সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়লো। যেহেতু এ দেশের সরকারের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছিলাম, তাই আমারও তাড়াহুড়োর কিছু ছিল না। সুইডিশ জনগণ প্রায়ই একটি কথা বলে থাকে, থ দে লুগ্ন। ধীরে চলো। আমেরিকা হলো এই ধীরে চলো নীতির পুরো উল্টো। সেখানে সবাই থাকে দৌড়ের উপর। যে যতো বেশি দৌড়াতে পারে সে ততো বেশি সফল হয়। তবে পরিশ্রম করলে সোনার হরিণ ঠিকই ধরা দেয়।
এক সময় পিএইচডির আগ্রহই হারিয়ে ফেললাম। যদিও থিসিসের কাজ প্রায় শেষের দিকে ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রচণ্ড এক আকাংখায় পেয়ে বসলো আমাকে। কিন্তু আমি তো আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ডের। কী করা যায়! কথা বললাম ইউনিভার্সিটির মেনটরদের সাথে। তারা পরামর্শ দিল মনের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে। ভর্তি হলাম এডাল্ট এডুকেশনে যা একেবারে ফ্রী। শুরু করলাম নতুন অধ্যায়। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ। ম্যাথ আর ফিজিক্সে সহজে ভর্তি নিলেও বাধ সাধল কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতে গেলে। সায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় তারা সংশয় প্রকাশ করছিল। আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করলাম। পড়া তো শুরু করি। পারলে চালিয়ে যাব আর না পারলে বাদ দেবো। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথে অতি চমৎকার রেজাল্ট নিয়ে পাশ করলাম। কেমিস্ট্রির শিক্ষক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অভিবাদন জানালেন।
আপাতত পিএইচডি কোর্স থেকে ছুটি নিলাম এবং লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়েই লুন্দ টেকনিক্যাল (Lunds tekniska högskolan) স্কুলে ভর্তি হলাম। সমগ্র বিশ্বে এই লুন্দ টেকনিক্যাল স্কুল বেশ নামকরা। সাবজেক্ট পছন্দ করলাম Information and Communication Technology. যে বয়সে সকাল সকাল চাকরিতে যাবার কথা, আর বিকেলে ঘরে ফেরার কথা, সে বয়সে ঘরে বউ-বাচ্ছা রেখে আমি যেতাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ঘরে ফিরতাম রাত করে। মাঝে মধ্যে ছুটির দিনেও স্কুলে যেতে হতো। কিছু কিছু পরীক্ষা হতো সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে।
বছর খানেক পার করার পর ইসলামিক স্টাডিজ-এর সুপারভাইজার বদলি হলো। নতুন সুপারভাইজার এসেই আমাকে শক্ত করে ধরলেন। হয় সে কোর্স একেবারে ছাড়তে হবে আর না হয় অতি দ্রুত তা সম্পন্ন করতে হবে। আমি চাইলেই আগের মতো সেখান থেকে ছুটি নিয়ে অন্য কিছু করতে পারবো না। বাধ্য হয়ে এবার ছুটি নিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে। সুপারভাইজারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় খুব অল্প অস্ময়ের মধ্যেই পিএইচডি সম্পন্ন করলাম। ডিফেন্সের তারিখ নির্ধারণ হলে এ দেশের একাডেমিক অঙ্গনের নিয়মানুযায়ী থিসিসটি দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, যাতে যে কেউ দেখতে পারে। সে অনুষ্ঠানে আমার সুপারভাইজার সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, আমার থিসিসটি তথ্য আর সাহিত্যে ভরপুর। এই সুখপাঠ্য থিসিস যে কারো পড়া উচিত।
সুপারভাইজারের আন্তরিকতায় তাঁরই একটি প্রোজেক্টে রিসার্চ সহযোগী হিসেবে যোগ দিলাম। এ প্রোজেক্ট শেষ হবার পর এক সমস্যা দেখা দিল। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্টডকের জন্যে সিলেকশন হয়ে থাকে সুইডেনের কেন্দ্রিয় গবেষণা কাউন্সিলের মাধ্যমে। পরপর তিনবার আমার প্রোজেক্ট সেরা বিবেচিত হবার পরও আমাকে বাদ দেয়া হলো। আমার সুপারভাইজারের সাথে কথা বললাম, তিনি সন্দেহ করলেন, টপ লেভেলে যে ফাইনালি সিলেক্ট করে, সে হয়তো আমাকে জানে এবং সে চায় না আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্টডক করার সুযোগ পাই। এতে আমি মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। এসব দেশেও যে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বৈষম্য রয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলাম। উপায়ন্তর না দেখে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, মাঝপথে রেখে দেয়া ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করবো। যা ভাবা তাই করা।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করলাম, ঠিক পরের মাসেই চাকরিতে জয়েন করলাম। লক্ষ্য করলাম বিজ্ঞানের এই শাখায় তাদের বৈষম্য নীতি একেবারেই অচল। এসব সেক্টরে এদের প্রচুর জনবলের প্রয়োজন, কাজেই কালো/বাদামী চামড়া দেখে বর্ণবৈষম্য করার সুযোগ এসব ফিল্ডে নেই বললেই চলে।
গত তিন বছরে তিনটি কোম্পানি ছেড়ে চতুর্থ কোম্পানিতে আছি। চাকরির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেতন বেড়েছে প্রায় ১৫০%। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারায় মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়া।
এখন আমার মাঝে একই সাথে দুটো ভিন্ন সত্তা কাজ করে। একদিকে আমি একজন আইটি প্রকৌশলী, অন্যদিকে আমি একজন ইসলামিক স্কলার। পরের প্রোফাইলটি বরং বেশি সচল এবং অগ্রগণ্য। গবেষণা, লেখালেখি এসব চলে ইসলামের উপর, বিশেষ করে কম্পারেটিভ রিলিজিয়নের উপর। গত এপ্রিলে আমার অনূদিত কুরআনুল কারীমের বিজ্ঞানময় অনুবাদ ইরফানুল কুরআন বের হয়েছে। অনেক বই ও লেখা বের হবার পথে। অপরদিকে জীবিকার তাগিদে দিনভর কাজ চলে আইটি ফিল্ডে। হাতে যতো কাজ জমে আছে, ইন-শা-আল্লাহ, শেষ করতে পারবো কিনা সেটাই ভাবছি।