কুরআন এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে দলীল সমৃদ্ধ আলোচনা!
– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
কিছু লোক বলে বেড়ায় ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ পালন করা বিদাত। কেউ কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে ফতোয়াই দিয়ে বসে ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ পালন শিরক। যেমন সৌদি দরবারী মুফতি এবং তাদের অনুসরণকারী ঘোমটা মৌ-লোভীরা। কেউ কেউ আবার ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ উপলক্ষ্যে জশনে জুলুসকে হিন্দুদের জন্মাষ্টমী কিংবা খৃষ্টানদের বড়দিন পালনের সাথে তুলনা করে থাকে। নাউজুবিল্লাহ! কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ নিয়ে আলোচনা করলে বুঝতে সহজ হবে ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে নেয়ামত, নাকি শিরক-বিদাত।
‘ঈদ’ মানে আনন্দ তা আমরা সবাই জানি। আর ‘মীলাদ’ মানে হচ্ছে জন্ম। অর্থাৎ নবী করীম ﷺ-এঁর বেলাদাত শরীফ বা জন্মে আনন্দ প্রকাশ করাই হলো ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ। এই মহিমান্বিত দিবসটি উপলক্ষে তাঁর (ﷺ) বেলাদাত শরীফ, তাঁর জীবন, তাঁর কর্ম এক কথায় মহান আল্লাহ্ পাক কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর শান ও মান বর্ণনার মাধ্যমে তিনি কীভাবে আমাদের সবার জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তা অনুধাবন করাই হলো ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ-এঁর মূল বিষয়।
আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যেমন বলেছেন, পুরো ত্রিশ পারা কুরআনে আল্লাহ্ পাক রাসূল ﷺ-এঁর প্রশংসা করেছেন, কাজেই আমরা তাঁর কি প্রশংসা করতে পারি? প্রথমেই আমরা দেখব মহান রাব্বুল ‘আলামীন রাসুলে পাক ﷺ-এঁর বেলাদত শরীফ নিয়ে পবিত্র কুরআনে আলোচনা করেছেন কিনা! রাসুল ﷺ নিজে কি তাঁর নিজের বেলাদত শরীফ নিয়ে আলোচনা করেছেন? সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম কি এ নিয়ে আলোচনা করেছেন? তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়িম্যায়ে মুজতাহেদীন, মুফাসসেরীনে কেরাম, মুহাদ্দেসীনে কেরাম সহ সকল ওলী-গাউস-কুতুব এবং আল্লাহ পাকের নেক বান্দাগণ কি এ নিয়ে আলোচনা করেছেন? এই নিয়ে তাঁরা কি খুশি প্রকাশ করেছেন?
আল্লাহ্ পাক কি রাসুল ﷺ-এঁর জন্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন?
সর্ব প্রথমেই দেখা যাক আল্লাহ্ পাক এ নিয়ে কি বলেছেন। পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে আমাদের নবী ﷺ-এঁর বেলাদত শরীফের কথা উল্লেখ তো রয়েছেই, সাথে সাথে আরো কিছু নবী-রাসুলের জন্ম নিয়েও আলোচনা রয়েছে। যেমন মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইয়াহইয়া (আঃ) এবং ঈসা (আঃ) সহ কয়েকজন নবী-রাসুলের জন্ম বৃত্তান্ত, মৃত্যু দিবস এবং পুনরুত্থান সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। নিচে এর কয়েকটি পেশ করা হলোঃ
{হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) সম্পর্কে} “আর শান্তি বর্ষিত হোক ইয়াহইয়ার প্রতি, যেদিন তিনি জন্মলাভ করেছেন, যেদিন তাঁর মৃত্যু হবে এবং যেদিন তাঁকে জীবিত পুনরোত্থিত করা হবে।“
(সূরা মরিয়ম : ১৫)
{হযরত ঈসা (আঃ)} “আর আমার প্রতি শান্তি, যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমাকে জীবিত উত্থিত করা হবে।“
সূরা মরিয়ম : ৩৩)
{নূরে মুজাসসাম ﷺ সম্পর্কে} “(হে আমার মহিমান্বিত হাবীব!) শপথ (আপনার) পিতা (আদম অথবা ইবরাহীম আলাইহিমাস সালাম)-এঁর এবং শপথ (তাঁদের), যারা জন্মগ্রহণ করেছেন।“
(সূরা বালাদ : ৩)
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নিম্নোক্ত আয়াতটি যেখানে আল্লাহ্ পাক সমস্ত নবী-রাসুলগণকে রূহানী জগতে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে ইমামুল মুরসালীন এবং রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন ﷺ-এঁর পৃথিবীতে শুভাগমন সম্পর্কে আলোচনা করে তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে তাঁকে স্বীকৃতি এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন।
“আর (হে প্রিয়তম! স্মরণ করুন সে সময়ের কথা) যখন আল্লাহ্ নবীগণের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, ‘যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করবো, অতঃপর তোমাদের নিকট আগমন করবেন (সর্বোপরি মহত্তের অধিকারী) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম) যিনি সত্যায়ন করবেন সেসব কিতাব যা তোমাদের কাছে থাকবে; তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে এবং অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করে নিলে এবং (এ শর্তে) আমার অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করলে’? সবাই বললেন, ‘আমরা স্বীকার করে নিলাম’। তিনি বললেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম’।
সূরা আল ইমরান ৮১]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ সুন্নতে এলাহী! অর্থাৎ নবী ﷺ-এঁর আগমন সম্পর্কে আলোচনা করা এবং তাঁর শান ও মান বর্ণনা করা স্বয়ং রাব্বুল আলামীনের সুন্নত বা রীতি।
রাসুল ﷺ নিজে কি তাঁর বেলাদত শরীফ আলোচনা করেছেন?
রাসুল (ﷺ) নিজে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন এভাবেঃ
রাসুলে করীম (ﷺ)-এঁর চাচা হযরত আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী (ﷺ)-ঁএর নিকট ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আসলাম। কারণ আমি হুযুর করীম (ﷺ)-এঁর বংশ বুনিয়াদ সম্পর্কে বিরুপ কিছু মন্তব্য শুনেছি। [তা নবী (ﷺ)-কে অবহিত করি] তখন হুযুর (ﷺ) মিম্বরে আরোহণ করেন (বরকতময় ভাষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে)। অতঃপর তিনি সাহাবা কেরামগণের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি কে?” উত্তরে তাঁরা বলেন, “আপনি আল্লাহর রাসুল”। তখন হুযুর আকরাম (ﷺ) এরশাদ করেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র মুহাম্মদ (দরুদ)। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মানব-দানব সবই সৃষ্টি করেন। এতে আমাকে উত্তম পক্ষের (অর্থাৎ মানবজাতির) মধ্যে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাদের (মানবজাতি)-কে দু’সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেন (অর্থাৎ আরবীয় ও অনারবীয়) এতেও আমাকে উত্তম সম্প্রদয়ে (আরবীয়) সৃষ্টি করেন। অতঃপর আরব জাতিকে অনেক গোত্রে বিভক্ত করেন আর আমাকে গোত্রের দিক দিয়ে উত্তম গোত্রে (কোরাইশ গোত্রে) প্রেরণ করেন। তারপর তাদেরকে (কোরাইশ) বিভিন্ন উপগোত্রে ভাগ করেন। আর আমাকে উপগোত্রের দিক দিয়ে উত্তম উপগোত্রে (বনী হাশেমে) প্রেরণ করেন। সুতরাং আমি তাদের মধ্যে সত্তাগত, বংশগত ও গোত্রগত দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
[তিরমিযী, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা নং-২০১; মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা নং-৫১৩]
[অন্য সূত্রে বর্ণীত এই সম্পর্কিত আরও হাদীসের জন্য দেখুন জামে তীরমিযী ২য় খন্ড ২০১ পৃঃ, মুসনাদে ইমাম আহমদ ১ম খন্ড ৯ পৃঃ, দালায়েলুল নবুওত বায়হাকী ১ম খন্ড ১৬৯ পৃ, কানযুল উম্মাল ২য় খন্ড ১৭৫ পৃঃ]
হযরত যাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন- আমি নবী করীম ﷺ-কে লক্ষ্য করে বললাম- হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ)! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কোরবান হোক। আমাকে কি আপনি অবহিত করবেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন বস্তু সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন? তদুত্তরে রাসুল করীম ﷺ এরশাদ করেন- হে জাবির! সমস্ত বস্তুর সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তার আপন নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐ নূর কুদরতে যেথায় সেথায় ভ্রমণ করছিল। ঐ সময় লওহ-কলম, বেহেশত-দোজখ, ফেরেশতা, আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, জিন-ইনসান কিছুই ছিল না।
[বিস্তারিত একটি হাদিসের অংশ বিশেষ যা ইমাম আব্দুর রাজ্জাক রহঃ তাঁর মুসান্নাফে ১৮ নং হাদিসে বর্ণনা করেন। আরো দেখুন মাওয়াহেবুল লাদুন্নিইয়া, শরহে জুরকানি, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৮৯]
উপরের দুটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ সুন্নতে রাসুল! এ ধরণের আরো অনেকগুলো হাদিস রয়েছে। সবগুলো উল্লেখ করতে গেলে লিখা অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় তা করা হলো না।
সাহাব কেরামগণ কি ঈদে মীলাদুন্নাবী পালন করেছেন?
আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত। একদা তিনি রসূলে পাক (ﷺ)-এঁর সাথে আমির আনছারী (রা)-এর গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তিনি বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে তাঁর সন্তানাদি, আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও পাড়া-প্রতিবেশীকে নিয়ে নবী (ﷺ)-এঁর বিলাদত শরীফের ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছেন এবং বলছেন, “এই দিবস; এই দিবস” (অর্থাৎ এই দিবসে রাসুল (ﷺ) যমীনে তাশরীফ এনেছেন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটেছে)। নবী (ﷺ) তা শ্রবণ করে অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রহমতের দরজা তোমার জন্য উন্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত ফেরেশতাগণ তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন আর যে কেউ তোমার মতো এরূপ করবে সেও তোমার মতো নাজাত (ফযীলত) লাভ করবে।“
(মীলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি:) ঈদে মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’ গ্রন্থে এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদে মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হাক্বীক্বতে মুহম্মদী ও মীলাদে আহমদী পৃষ্ঠা- ৩৫৫)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি একদা বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে তাঁর নিজগৃহে সাহাবীগণকে সমবেত করে নবী (ﷺ)-এঁর বিলাদত শরীফের ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছিলেন। এতে শ্রবণকারীগণ আনন্দও খুশি প্রকাশ করছিলেন এবং আল্লাহ পাকের প্রশংসা তথা তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করছিলেন এবং রাসুল (ﷺ)-এঁর উপর দুরূদ (সালাত-সালাম) পাঠ করছিলেন। এমন সময় রাসূল (ﷺ) তথায় উপস্থিত হয়ে বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করতে দেখে বললেন: “তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেলো।” {আল্লামা জালাল উদ্দীন সূয়ুতী (রাহ) এর বিখ্যাত কিতাব “সুবলুল হুদা ফি মাওলেদে মুস্তাফা (ﷺ)” এ শেষের হাদিস দুটি উল্লেখিত হয়েছে। # দুররুল মুনাযযাম – সপ্তম অধ্যায় – প্রথম পরিচ্ছেদ # ইশবাউল কালাম # হাক্বীকতে মুহম্মদী মীলাদে আহমদী ৩৫৫ পৃষ্ঠা}
হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) রাসুল (ﷺ)-এঁর নির্দেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে কবিতার মাধ্যমে মীলাদুন্নাবী ﷺ পাঠ করেছেন। দীর্ঘ কবিতার একাংশ নিচে উদ্ধৃত করা হলঃ
ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি সমস্ত দোষত্রুটি হতে মুক্ত হয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। আপনার এই বর্তমান সুরত মনে হয় আপনার ইচ্ছানুযায়ীই সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর নাম আযানে নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছেন, যখন মুয়াজ্জিন পাঞ্জেগানা নামাযের জন্য “আসহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” বলে আযান দেয়। আল্লাহ তা’আলা আপন নামের অংশ দিয়ে আপনার নাম রেখেছেন- আপনাকে অধিক মর্যাদাশীল করার লক্ষ্যে। আরশের অধিপতির নাম হল ‘মাহমুদ’ এবং আপনার নাম হল ‘মুহাম্মদ’ (ﷺ)।
[দিওয়ানে হাসান]
হযরত হাসসান (রাঃ) এর এই কাসীদা শুনে নবী করীম (ﷺ) বলতেন ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে জিবরাইল মারফত সাহায্য করো’। তাফসীরে খাজাইনুল ইরফানে উল্লেখ আছে, যারা নবী করিম (ﷺ)-এঁর প্রশংসাগীতি করে তাদের পিছনে জিবরাইল (আঃ)-এঁর গায়েবী মদদ থাকে (সূরা মুজাদালাহ এবং সহীহ মুসলিম শরীফের কিতাব ৩১ এবং অধ্যায় ৩৪ এ অনেকগুলো হাদীসে এর উল্লেখ রয়েছে); মিলাদ কিয়ামের জন্য এটি একটি শক্ত ও উতকৃষ্ট দলীল।
এর থেকে প্রমাণিত হলো ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ সুন্নতে সাহাবা!
জশনে জুলুস করা কি বিদাত?
মহানবী ﷺ-এঁর এ ধরাধামে আগমনে ফেরেশতাকুল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি সহ এ সৃষ্টি জগতের সকল বস্তু আনন্দে আন্দোলিত হয়েছিল। আকাশে উল্কারাজি নিক্ষিপ্ত করে শয়তান আর জীনদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পারস্যে অগ্নিপূজকদের অগ্নি নির্বাপিত হয়েছিল আর পারস্যের রাজপ্রাসাদের ১৪টি স্তম্ভ সেদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন হাদিস থেকে এর প্রমাণ মেলে। দলিলের জন্য ইবনে কাসীরই যথেষ্ট। সে রাতে মক্কার লোকজন বিশেষ এমন কিছু অনুভব করেছিলেন যা এর পূর্বে কখনো অনুভত হয়নি। তাছাড়া নবীজি ﷺ যখন মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরত করে চলে আসেন, মদীনার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আর ছোট ছোট মেয়েরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ‘তালা’আল বাদরু আলাইনা’ বলে দফ বাজিয়ে নেচে নেচে গান গেয়েছিল। কাকতালীয় ভাবে সেদিনটি ছিল ১২ ই রবিউল আউয়াল। মানুষজন সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে দিকবেদিক ছোটাছুটি করছিল। হিজরতের চেয়ে রাসুলে পাক্ক ﷺ-এঁর জন্ম নিঃসন্দেহে আরো বেশি আনন্দের এবং খুশির। এজন্যে আল্লাহ্ পাক তাঁর হাবীবের আগমনে খুশী প্রকাশ করার জন্য তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিচ্ছেন এভাবেঃ-
বলে দিন, ‘(এ সবকিছু) আল্লাহ্র অনুগ্রহ এবং তাঁর রহমতের কারণে (যা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের মাধ্যমে তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে)। কাজেই মুসলমানদের উচিত এতে আনন্দ উদযাপন করা। তা (সমস্ত ধন-সম্পদ) থেকে উৎকৃষ্টতর যা তারা জমা করে রাখে।’ (সূরা ইউনূছ ৫৮) রঈছুল মুফাসসেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রহমত’ দ্বারা এই আয়াতে নবী করীম ﷺ-কে বোঝানো হয়েছে।
(সূরা ইউনূছ ৫৮)
কাজেই ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ উপলক্ষ্যে জশনে জুলুসের মাধ্যমে আনন্দ করায় কোন নিষেধাজ্ঞা কুরআন কিংবা হাদিসে নেই। আর এই জশনে জুলুস দ্বারা যেহেতু ইসলামী শরীয়তের কোন বিধি নিষেধের অবমাননা হয় না, নিঃসন্দেহে এটি একটি উত্তম কাজ। রাস্তাঘাট আলোকসজ্জা করা, ঝাড়বাতি লাগানো, সুন্দর জামাকাপড় পরিধান করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, মানুষকে ভালো খাওয়ানো – এ সবই ইসলামী শরিয়তে জায়েজ এবং উত্তম কাজ। আর বিভিন্ন যুগের প্রসিদ্ধ ইমামগণ এই মতোই পোষণ করে গেছেন।
বিঃ দ্রঃ- বর্তমান ধারার জশনে জুলুস প্রথম চালু হয় ৬ষ্ঠ হিজরিতে ইরাকে। কাজেই হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর সাথে এর তুলনা করা মূর্খতার নামান্তর। আর যারা খৃষ্টানদের বড়দিনের সাথে এর তুলনা করে, তারাও মুর্খের স্বর্গে বাস করছে। কেননা, খৃষ্টানরাই বরং মুসলমানদের এই ঝাকঝমকপূর্ণ জশনে জুলুস থেকে আলোকসজ্জা সহকারে বড়দিন পালন শুরু করে। কেননা খৃষ্টান জগতে এই বড়দিন পালন ৩০০ খ্রিঃ সম্রাট কনস্টান্টাইনের যুগ থেকে শুরু। আর তখন বর্তমান কালের মতো করে পালিত হতো না। স্পেইনে মুসলমান সভ্যতা আর তুরুস্কের উসমানীদের কাছ থেকে মূলত খৃষ্টানরা এ ধারণা লাভ করে এবং আলোকসজ্জা সহকারে অতি ঝাকঝমক সহকারে তা পালন করতে থাকে।
এ বিশাল আলোচনা থেকে পরিষ্কার হলো যে ঈদে মীলাদুন্নাবী ﷺ সুন্নতে এলাহী, সুন্নতে রাসুল, সুন্নতে সাহাবা এবং সুন্নতে সালেহীন। আর বর্তমান কালের জশনে জুলুস যদিও ৬ষ্ঠ হিজরিতে প্রচলিত এবং বিদাতে হাসানা, তবে এতে হিজরতের আনন্দ প্রকাশের কারণে সুন্নতে সাহাবার মর্যাদা অর্জিত হয়েছে। যারা ইতিহাস আর কুরআন হাদিস না বুঝে একে শিরক-বিদাত আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের সাথে তুলনা করে তারা এমন একটি নেয়ামত থেকে চরমভাবে বঞ্চিত এবং আল্লাহ্ পাকের রহমতের ছায়া থেকে বিতাড়িত। যেমন অভশপ্ত শয়তান! জাযাকাল্লাহ