ইমাম সাইয়্যেদুনা হাসান মুঝতবা আলাইহিস সালাম ওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পবিত্র মাজার শরীফ, জানাতুল বাকী, মদিনা মনোয়ারা, ১৯২৪ সালে ওহাবীদের কর্তৃক ধ্বংস করার পূর্বে।
দুনিয়ার তাবৎ মুসলিম জানে সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান মুজতবা এবং সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন আলাইহিমাস সালাম জান্নাতের সরদার। জান্নাতে সবাই যুবক হবেন, কাজেই যুবক আর বয়স্কদের জন্য আলাদা কোন নেতা সেখানে থাকবেন না। কিন্তু দুনিয়ার বেশিরভাগ মুসলিমই জানে না দুনিয়ার জীবনে জান্নাতের এই যুবকদ্বয়ের কি কি অর্জন ছিল। ইমাম হুসাইন আঃ’র ব্যাপারে মানুষ কিছুটা জানে, কারবালার ঘটনার কারণে। কিন্তু ইমাম হাসান আঃ’র ব্যাপারে বিষপানে শাহাদাত বরণের বাইরে তেমন কিছুই জানে না। অথচ তাঁরা উভয়ে আহলে বাইতের অন্তর্গত। আর ইমাম সুয়ুতীর মতে প্রায় ৮০০ আয়াত নাযিল হয়েছে আহলে বাইতের শানে। তাঁদের শানে হাদিসের সংখ্যা অগণিত।
অবাক করার বিষয় হলো আমাদের উপমহাদেশে নিজ পীর, মাসলাকের ইমাম এবং এমন কি আহলে বাইতের দুশমনদেরও উরস পালিত হয়। অথচ জান্নাতের যাঁরা বণ্টনকারী, জান্নাতে যাঁরা নেতা, যাঁদের সুপারিশ ছাড়া জান্নাতে যাবার উপায় নেই, যাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মারা গেলে তার ঠিকানা সোজা জাহান্নাম, যাঁদেরকে নুহ আলাইহিস সালামের কিস্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে, যাতে আরোহণ না করলে, যাঁদের অনুসরণ না করলে ধ্বংস নিশ্চিত, তাঁদেরকেই মুসলিম সমাজ ভুলে বসে আছে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের দুনিয়ার জীবনের অবসানের সময়, ১০ম হিজরীতে, ইমাম হাসানের বয়স ছিল প্রায় ৭ বছর এবং ইমান হুসাইনের বয়স ছিল প্রায় ৫ বছর। তাঁদের শানে যত হাদিস এসেছে, তার বেশিরভাগই এসেছে এই সময়ের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা হিসেবে। এর পরের ঘটনার বিষয়ে মুসলিম সমাজ খুব একটা জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। এর প্রধান কারণ হলো দীর্ঘ ৮৯ বছরের উমাইয়্যারা রাজত্ব। এই দীর্ঘ সময়ে তারা আহলে বাইতের নাম, পরিচয়, শান ও মর্যাদা কেবল ধূলায় মিশিয়ে দেবারই চেষ্টা করেনি, মিথ্যা হাদিস রচনা করে আহলে বাইতের প্রতিটি সদস্যকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেছে। তাঁদের শান ও মর্যাদা কেউ বর্ণনা করলে তাকে নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার, গুম ও হত্যা করা হতো। ফলে মুহাদ্দিসগণের কেউ কেউ জঙ্গলে লুকিয়ে হাদিস চর্চা করতেন। যারা সাহস করে সত্য তুলে ধরতেন তাঁদের উপর নেমে আসতো অবর্ণনীয় নির্যাতন। ফলে মিথ্যা হাদিস মুসলিম সমাজে প্রাধান্য পায় এবং আহলে বাইত আতহারগণ ধীরে ধীরে স্মৃতির অতল গভীরে তলিয়ে যেতে থাকেন। এখন যদিও উমাইয়্যা শাসন নেই, তবে উমাইয়্যাদের সাজানো মিথ্যা হাদিস রয়ে গেছে। তাদের পোষ্য উচ্ছিষ্টভোগী দুনিয়ালোভী আলেমদের মিথ্যা বয়ান সবখানেই বিরাজমান। ফলে সে ধারা আজো বিদ্যমান। আহলে বাইতকে শিয়াদের দিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব। ঈমানের মূল থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। আর তাতেই আমরা নিজেদেরকে খাঁটি মুমিন মনে করি।
তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাপার ছিল, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন আ:’র জন্মের ঠিক পরপরই আল্লাহ পাক জিব্রাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁদের একজনকে বিষ দিয়ে এবং অন্যজনকে নির্মমভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় শহীদ করা হবে। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের সংবাদের সাথে কারবালার কিছু মাটিও জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের কাছে দিয়েছিলেন। সে মাটি তিনি উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছে দিয়ে বলেছিলেন, যেদিন এ মাটি রক্তবর্ণ ধারণ করবে সেদিন জানবে হুসাইন কারবালায় শাহাদাত বরণ করেছেন। এই হাদিসে রাসূল [ﷺ]-এঁর হৃদয়বিদারক আর্তনাদের কথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তাঁদের নামের ব্যাপারেও রয়েছে সহীহ বর্ণনায় একাধিক হাদিস। হাসান এবং হুসাইন নামের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে শাহাদাতের ইঙ্গিত। এ নামদুটো পৃথিবীতে তাঁদের পূর্বে কারো নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয় নি। এগুলো বেহেশতি নাম হলেও বেহেশতবাসির মাঝেও এর পূর্বে এ নামে কারো নামকরণ হয়নি। আল্লাহ পাক যেভাবে নূরের পর্দা দিয়ে আপন মাহবুবকে আড়াল করে রেখেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবেই হুসন-এর পর্দা দিয়ে তাঁদের দুজনকে আড়াল করে রেখেছিলেন। হাসান এবং হুসাইন নামদুটো একই মূল থেকে। শাহাদাতের মৃত্যুর মাঝে লুকিয়ে আছে এক অসম্ভব মহান উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সৌন্দর্য। তাই আরবি ভাষায় হুসন শব্দ দিয়েও শাহাদাতকে বোঝানো হয়। শাহাদাতের মৃত্যুর পর বিনা প্রতিবন্ধকতায় একজন শহীদ মওলা পাকের সরাসরি সাক্ষাৎ লাভ করে থাকেন। শাহাদাতের মুহূর্তে আমরা যে কষ্ট দেখতে পাই তা ক্ষণিকের মাত্র। শাহাদাত লাভের সাথে সাথে রাব্বুল আলামীনের দীদারে একজন শহীদ যে প্রশান্তি এবং উচ্চ মর্যাদা লাভ করেন তা অন্য কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়।
রাসূলে পাক [ﷺ]-এঁর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণী, তাঁর এই দুই দৌহিত্র দুনিয়ায় জান্নাতের দুটি পুষ্প। তাঁদের একজন ইমাম হাসান ছিলেন মাথা মুবারক থেকে কোমর পর্যন্ত রাসূল [ﷺ]-এর সদৃশ। আর অন্যজন, ইমাম হুসাইন ছিলেন কোমর থেকে পা পর্যন্ত রাসূল [ﷺ]-এর সদৃশ। তাই তাঁরা উভয়ে যেন স্বয়ং রাসূলের মূর্ত প্রতিচ্ছবি ছিলেন।
মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববীতে সাইয়্যেদুনা হাসান মুঝতবার নাম মুবারক
তাঁদের সাথে ঘোড়া ও বাহনের খেলার কথা বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। রাসূল [ﷺ] তাঁদেরকে প্রায়ই চাদরের নিচে লুকিয়ে রাখতেন এমন বর্ণনাও রয়েছে। আর এই চাদরে লুকিয়ে রেখেই তিনি আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেছিলেন আল্লাহ পাক যেন তাঁদেরকে অর্থাৎ আহলে বাইত আতহার আলাইহিমুস সালামগণকে পবিত্র রাখেন এবং সমস্ত অপবিত্রতা তাঁদের থেকে দূরে রাখেন। আল্লাহ পাক কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে রাসূল [ﷺ]-কে সে গ্যারান্টি দিয়েছিলেন। এ কারণেই আহলে বাইতের অপরনাম আহলে আবা, চাদরের অধিবাসী।
শিশু হাসান একবার খেলা করতে করতে মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছে চলে গিয়েছিলেন। রাসূল [ﷺ] তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। তিনি শিশু হাসানকে কোলে নিলেন এবং ঘোষণা করলেন, আমার এই সন্তান সাইয়্যেদ। সম্ভবত তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ পাক মুসলমানদের দুটো বিবদমান দলকে একত্রিত করবেন। এই ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হয় ৪১ হিজরীতে যখন সাইয়্যেদুনা হাসান মুজতবা আলাইহিস সালাম মুসলমানদের মাঝে রক্তপাত বন্ধ করতে আত্মত্যাগের এক মহান নিদর্শন স্থাপন করেন আমীরে শামের বিপক্ষে নিজেকে খেলাফত থেকে সরিয়ে নিয়ে। এই সিদ্ধান্ত মুসলমানদের মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব নিরসন করলেও এর ফলে আহলে বাইতের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা। মসজিদের মিম্বরে মিম্বরে তাঁদেরকে গালি ও লানত দেবার ঘৃণ্য রীতি চালু করে উমাইয়্যারা। এমন কি মসজিদে নববীতে আহলে বাইতের সম্মানিত সদস্যগণের উপস্থিতিতেই পাপিষ্ঠ মারওয়ান মওলা আলী আলাইহিস সালামকে গালি দিতো এবং লানত বর্ষণ করতো। ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন এবং নবী-পরিবারের অন্যান্যরা তখন মসজিদে কেবল জামাতটুকু আদায় করার জন্যে অপেক্ষামান থাকতেন আম্মাজান আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ঘরে। এ অবস্থা চলে দীর্ঘ ৫৯ বছর ধরে। [এ বর্ণনাটি ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ুতী রহঃ-এর তারিখুল খোলাফা গ্রন্থে পাবেন।]
দুনিয়া এবং ক্ষমতার লোভ সংবরণ করে তিনি আপন রবের আরো নিকটবর্তী হতে রাতে তাহাজ্জুদে নিমগ্ন থাকতেন আর দিনের বেশিরভাগ সময়ই মসজিদে পড়ে থাকতেন। কিন্তু সেখানেও তাঁকে স্বস্তি দেয় নি পাপিষ্ঠ উমাইয়্যা বানরেরা [হাদিসে ঠিক এ রকমই উল্লেখ রয়েছে]।
খেলাফতের গুরু দায়িত্ব ছেড়ে তিনি একনিষ্ঠ ভাবে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। একবার একলোক মসজিদে নামাজ আদায় করে আল্লাহ পাকের কাছে নিজের প্রয়োজন ব্যক্ত করে ৪ হাজার দিনারের জন্য সাহায্য চাইছিল। ইমাম হাসান আড়ালে থেকে এ দোয়া শুনে নিজের ঘরে গিয়ে ৪ হাজার দিনার এনে লোকটিকে দান করে দেন। কখনো কোন অভাবী ব্যক্তি, দরিদ্র ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে যেতে পারতো না। তিনি অভাবীর অভাব দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনলে তিনি তা দূর করার জন্য সম্ভব সবকিছু করতেন। তিনি ছিলেন ধৈর্যের পাহাড়। মসজিদে নববীতে যখন মারওয়ান মিম্বরে দাঁড়িয়ে পিতা মওলা আলিউল মুরতজা আলাইহিস সালামকে গালি ও লানত দিতো, ছোটো ভাই ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এবং পরিবারের অন্যেরা যখন ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন, ইমাম হাসান তখনো তাঁদের সবাইকে নানাজানের কথা বলে শান্ত রাখতেন। একবার দামেস্ক থেকে এক লোক এসে মদিনায় মওলা আলীর নাম ধরে গালাগালি করছিল। ইমাম হাসান তাকে নিজ ঘরে আপ্যায়ন করেন এবং ৩ দিন রাখেন। তিনদিন পর সে লোকের ভুল ভাঙে। তখন সে জানায় সিরিয়ার দামেস্কে মানুষজন আহলে বাইত বলতে উমাইয়্যা রাজা আর তার ছেলে এজিদকে বুঝে। (মাআজাল্লাহ!)
তিনি ছিলেন একাধারে বাগ্মী, উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন একজন সেরা বিতার্কিক এবং সুবক্তা। পিতা যেমন ছিলেন নবীজি [ﷺ]-এঁর জ্ঞানের শহরের দরোজা, তিনিও ছিলেন কুরআন, সুন্নাহ এবং ইসলামী জ্ঞানে একজন পরিপূর্ণ সাধক। মাঝে মাঝে তাঁর পিতা তাঁকে মিম্বরে দাঁড় করিয়ে দিতেন বক্তব্য দিতে। পুত্রের বক্তব্য শুনে পিতা তৃপ্তি পেতেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন।
আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া, ইবনে কাসীর, ইবনে আসীর, তারিখে দামেশক সহ তারিখের প্রায় সব গ্রন্থেই সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান আলাইহিস সালামকে বিষপানে উমাইয়্যা রাজার হাত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। বিষের যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছিলেন, ছোটো ভাই হুসাইন তখন ধৈর্য রাখতে পারছিলেন না। তিনি বারবার বিষ দাতার নাম জানতে চাইছিলেন। উত্তরে তিনি কেবল বললেন, তুমি তার পরিচয় জানলে তাকে হত্যা করে এই কাজের প্রতিশোধ নিবে। কিন্তু যদি আমার ধারণা ভুল হয় আর তুমি ভুল মানুষকে শাস্তি দাও, তখন নানাজানের কাছে কাল হাশরে এর কী জবাব দেবো? সুবহানআল্লাহ! আম্মাজান আয়েশা রা’র কাছ থেকে মৃত্যুর পূর্বে এবং পরে দুইবার অনুমুতি নেবার পরও উমাইয়্যা বানর মারওয়ান সাইয়্যেদুনা হাসান মুজতবাকে নানার পাশে কবর দিতে দেয় নি। রক্তারক্তি এড়াতে আবু হুরায়রা রা সেখানে উপস্থিত হয়ে হাশেমীদেরকে শান্ত হতে অনুরোধ করেন এবং সাইয়্যেদুনা হাসান মুজতবার শেষ কথাটি স্মরণ করিয়ে দেনঃ “যদি তোমরা রক্তারক্তির আশংকা করো, তাহলে আমাকে জান্নাতুল বাকিতেই কবর দিও।” জান্নাতুল বাকির সে কবরও ওহাবীরা ভেঙে ফেলে।
আমরা আসলে জান্নাতের সরদারকেই ভুলে গিয়েছি, অথচ তাঁর অধীনেই জান্নাতের আশা করি!!!