দূরত্ব প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। উল্টো আসতেও একই দূরত্ব। সাথে ঘোরাঘুরি। সব মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটারের পথ। একক জার্নি হিসেবে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে লম্বা কার ড্রাইভ। আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিলাম মালমো থেকে রাজধানী স্টকহোমে যাবার। রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু পেরিয়ে একেবারে শেষের শহর মেরস্টা। সেখান থেকেও আরো ১০ কিমি পেরিয়ে একটি ছোট্ট গ্রাম, নাম সিগতুনা। ছোটবোন সপরিবারে সেখানে থাকে। গ্রীষ্মে অফিসে তেমন কাজ নেই, তাই উইকেন্ডে যাবার এই তড়িৎ সিদ্ধান্ত।
আমরাও যাচ্ছি সপরিবারে। বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম বিভিন্ন কারণে। এর আগে বহুবার রাজধানীতে গিয়েছি। দ্রুতগামী ট্রেনে সাড়ে চার ঘণ্টার জার্নি। অন্যগুলোতে ৬ ঘণ্টা। প্লেনে গেলে মাত্র একঘণ্টা। তবে প্লেনে বা ট্রেনে যাবার পরও বাসায় পৌঁছুতে আরো সময়। সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টার পথ। গোগল ম্যাপে দেখলাম ৭ ঘণ্টা দেখাচ্ছে, কার ড্রাইভ করলে। এই সময়ের মধ্যে পৌঁছুতে হলে ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিমি বেগে গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে।
তবে পুলকিত বোধ করছি অন্য কারণে। প্রাকৃতিক লীলাভূমি সুইডেনের অপরূপ দৃশ্য ট্রেনে গেলে পুরো উপভোগ করা সম্ভব হয় না। দ্রুতগামী ট্রেনে সামনে না তাকিয়ে পাশ থেকে তেমন কিছুই ভালো করে দেখাও যায় না। তবে গাড়িতে গেলে আশেপাশে সবকিছু দেখা সহজ হয়। ইচ্ছেমত থেমে যা মনে চায় তা দেখা যায়। বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ বড় সুইডেন আসলে উত্তরে-দক্ষিণে লম্বা এক বিশাল ভূখণ্ড। উত্তর মেরুর কাছাকাছির এ দেশটির উত্তরের সাথে দক্ষিণের আবহাওয়ায় তাই আকাশ-পাতাল ব্যবধান। দক্ষিণে চকচকে গ্রীষ্ম তো, উত্তরে পুরো বরফঢাকা শুভ্র বুড়ি। উত্তরে সূর্য অস্ত যায় দুয়েক ঘণ্টার জন্য। রাত হলেও বাইরে আলো থাকে সারারাত। সে তুলনায় সর্বদক্ষিণে রাতের দৈর্ঘ সর্বনিম্ন ৬ ঘণ্টা। আর শীতে এর উল্টো।
দক্ষিণ থেকে উত্তরের দূরত্ব প্রায় ২১শ কিমি। এ বিশাল ভূখণ্ডের প্রায় ৬০ ভাগ আবার বনাঞ্চল। ইউনিসেফ থেকে বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে কাঠ পাঠানো হয় অনুদান হিসেবে। সে কাঠগুলো থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসে বলে এগুলোকে কেরোসিন কাঠ বলা হয়। সে কেরোসিন কাঠ উৎপন্ন হয় এই সুইডেনে। বিস্তীর্ণ ভূমি পেরিয়ে গেলে রাস্তার দুপাশে কেবল বিশাল বিশাল গাছগাছালি চোখে পড়ে। আঁকাবাঁকা নয়, একেবারে সোজা উঁচু বৃক্ষ। পৃথিবীতে কাগজ উৎপন্নের দিক থেকে সুইডেনের অবস্থান ৯ম, বাৎসরিক কাগজ উৎপন্নের পরিমাণ ১০ মিলিয়ন টনের বেশি। বাংলাদেশের চেয়েও এদেশে তাই কাগজের দাম কম। তাও আমরা কেবল অফসেট কাগজ ব্যবহার করে থাকি। সাবধান না হলে মজবুত কাগজের ধারে হাত কেটে যেতে পারে। ড্রাইভ করে গেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা যায় বলেই মনে মনে পুলক অনুভব করছিলাম।
জুমার নামায পড়েই রওয়ানা দিলাম। নিজ শহর মালমো থেকে তেলের ট্যাঙ্ক পূর্ণ করে নিলাম। ৪৩ লিটার অকটেনে ৭০০ কিলোমিটার ড্রাইভ করতে পারার কথা। না হলে পথে কোথাও আবার তেল নিতে হবে। গাড়িতে বসার সাথে সাথেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। মনে মনে আরো পুলক অনুভব করলাম। বহুদিনের ইচ্ছে বৃষ্টিতে লং ড্রাইভে বের হবো। মুসা আলাইহিস সালাম একবার আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আল্লাহ খুশি হলে কী করেন? আল্লাহ পাক জবাবে বলেছিলেন, খুশি হলে তিনি বৃষ্টি দেন। আরো বেশি খুশি হলে মেহমান পাঠান। আরো বেশি খুশি হলে তিনি কন্যা সন্তান দান করেন। আমরা যাচ্ছি আমার বোনের মেহমান হয়ে। সাথে আছে কন্যা সন্তান আর এখন নামলো বৃষ্টি। এই বৃষ্টির সময় যেহেতু আল্লাহ পাক খুশি থাকেন, তাই এই সময়ে দোয়া করলে আল্লাহ পাক তা ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবধ করেন। মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ পাক ফিরিয়ে দেন না। আমরা মুসাফির। তাই বাচ্চাদেরকে নিয়ে দোয়া করতে শুরু করলাম। নিজেদের জন্য দোয়া করলাম। আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া করলাম। দুনিয়ার সমস্ত মুমিন-মুসলমান এবং সমস্ত মজলুমের জন্য দোয়া করলাম।
মালমো শহরের উপকণ্ঠে নেমেই হাই-ওয়ে ধরে চলতে শুরু করলাম। হালকা বৃষ্টি। তবে বেশ রোমাঞ্চকর। গাড়ি চলছে ১২০ গতিতে। জিপিএস চালু করে নিলাম। এদেশে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে অসংখ্য রাস্তা। এক রাস্তা ভুল করলে তাই অন্য যে কোনও রাস্তা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। তবে সবচেয়ে নিরাপদে এবং নিশ্চিত ভাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে জিপিএসের সাহায্য নেয়াই উত্তম। এতে দরকারি অনেক তথ্য দেখা যায়। গাড়ির প্রকৃত গতি, অবস্থান, সামনে পেছনে অবস্থিত দর্শনীয় স্থান, পাম্প হাউস, খাবারের দোকান, রিপ্রেশ হবার স্থানসহ রিয়েল টাইম তথ্যও পাওয়া যায়। রাস্তায় কোনও দুর্ঘটনা হয়ে থাকলে বা কোনও গাড়ি অস্বাভাবিক ভাবে থেমে থাকলেও জিপিএসে সে তথ্য দেখা যায়। বিজ্ঞানের উন্নতির প্রায় সব রকমের সুফল পাওয়া যায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আর আমাদের গাড়িও অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনে এগিয়ে চলতে লাগলো।
১ম পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
https://www.facebook.com/drbaten.miaji/posts/3046278162092052
[২য় পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/drbaten.miaji/posts/3047688931950975 ]
৩য় পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/drbaten.miaji/posts/3051507211569147
চতুর্থ পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3053765761343292&id=100001296940524