হাই-ওয়েতে নেমেই গাড়ি পুরো অটো করে দিলাম। ক্রুজ কন্ট্রোলার অন করে দিলাম। যাতে স্পীড বাড়ানো বা কমানোর জন্য আমাকে ভাবতে না হয়। এ বিশেষ সিস্টেম নিজে থেকেই সামনের গাড়ির সাথে দূরত্ব বজায় রেখে স্পীড নিয়ন্ত্রণ করে। ওয়াইপার অটো করে দিলাম যাতে বৃষ্টির ফোটা পড়ার সাথে সাথে তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু হয়ে যায়। হাই স্পীডে গাড়ি চলতে থাকলে বৃষ্টির সময় ওয়াইপার চালু করতে দেরি হলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা। তাই অটো করে দেয়াই নিরাপদ। রাডার সিস্টেম অন করলাম যাতে গাড়ি নিজে থেকেই নিজস্ব লেইনে থাকে। যেখানে রাস্তা বেঁকে চলে গেছে, এই রাডার সিস্টেমের কারণে গাড়ি নিজে থেকেই লেইন অনুসরণ করে চলবে। ইন্ডিকেটর ছাড়া এদিকসেদিন নিতে গেলে মনে হবে স্টিয়ারিং লক হয়ে আছে। প্রয়োজনে তখন একটু শক্ত করে ঘোরাতে হয়।
হাই-ওয়ে দিয়ে চলতে গেলে আধুনিক টেকনোলজির অনেক সুবিধা ব্যবহার করা যায়। গাড়ি চলছে ১২৫ কিমি বেগে। পুরো অটো। এই গতি থেকে না কমছে আর না বাড়ছে। শুক্রবার বিকেলে রাস্তা বলা যায় একেবারে ফাঁকা। তাছাড়া শহরের বাইরে হাই-ওয়েতে তেমন একটা জট থাকে না। এক্সেলারেটর থেকে পা তুলে নিলাম। স্টিয়ারিং-এর উপর নামে মাত্র হাত রেখে চলছিলাম। প্রযুক্তির উপর পুরোপুরি নির্ভর করা ঠিক হবে না। যদিও গাড়ির সামনে সেন্সর সেট করা আছে, মাঝে মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিও ভুল করতে পারে। অনেক সময় সেন্সর ঠিক মতো কাজ নাও করতে পারে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা বুদ্ধিমানের কাজ। হাই-ওয়ের উপর সাদা দাগ কাটা থাকে। প্রতিটা লেইনের দুপাশে দাগ থাকে। গাড়ির সামনে ছাদে এক বিশেষ ধরণের ক্যামেরা স্থাপন করা আছে। এর সাহায্যে অটোমোবাইল রাস্তার সাদা দাগ রীড করে গাড়ি যে লেইনে আছে সে লেইনে অবিচল থাকে। সামনে গাড়ির সাথে দূরত্ব মেপে সিদ্ধান্ত নেয় কখন ব্রেক করতে হবে এবং কতোটুকু গতি কমাতে হবে। সামনের গাড়ি খুব নিকটে চলে এলে নিজ থেকে কষে ব্রেক করে। না পারলে টিক টিক সিগন্যাল দিয়ে সাবধান করতে থাকে। সামনের গাড়ি ছুটে চললে, সেও আবার চলতে শুরু করে। ইন্ডিকেটর ছাড়া লেইন পরিবর্তন করতে গেলেই হুঁশিয়ারি সিগন্যাল বেজে উঠে। বৃষ্টির ফোটা সামনের গ্লাসে বিশেষ ক্যামেরার উপর পড়তেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে ওয়াইপার চালু হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির গতি এবং অবস্থা নির্ণয় করে দ্রুত বা ধীরে ওয়াইপার চলছে।
প্রায় দু ঘণ্টা পার হতেই স্কোনে কাউন্টি (Skåne County) অতিক্রম করে গেলাম। সুইডেনের যে অঞ্চলে আমরা বসবাস করছি, সে অঞ্চল মূলত কৃষি প্রধান। উঁচুনিচু পাহাড় পুরো দেশেই রয়েছে, তবে আমাদের অঞ্চলে পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে রয়েছে চাষযোগ্য জমি। সেখানে এই মুহূর্তে গম আর যবের চাষ করা হয়েছে। এগুলো পেকে সোনালি রঙ ধারণ করে আছে। স্কোনে কাউন্টির পর রয়েছে বিস্তৃত বনাঞ্চল। উঁচুনিচু পাহাড়, পাহাড় জুড়ে বনাঞ্চল। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে রয়েছে অসম্ভব সুন্দর উপত্যকা। এসব উপত্যকা পেরিয়ে চলে গেছে হাই-ওয়ে। দূর থেকে দূরান্তরে। এক শহর হেকে অন্য শহরে। বিশাল উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে ভ্যালী বা উপত্যকা। এসব পাহাড় আবার পাথরের। পাথরের ভাঁজে ভাঁজে বেড়ে উঠেছে ঝাউ গাছ, কেরোসিন গাছের বাগান। পুরো প্রাকৃতিক ভাবে। কোথাও আবার এসব গাছের চাষ করা হয়। পুরনো গাছ কেটে নতুন গাছ রোপণ করা হয়। তবে এসবই হয় সরকারী তত্ত্বাবধানে। প্রশিক্ষিত চাষিরা এসব বনাঞ্চল সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য লীজ নিয়ে দেখাশুনা করে থাকে। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সুইডেনের প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে লক্ষণীয়।
উল্লেখ্য, এই অঞ্চলে পাথরের পাহাড় থাকায় চাষাবাদের তেমন জমি নেই। আজ থেকে একশ বছর আগে এই অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক মানুষ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। আমেরিকার শিকাগোতে রয়েছে সুইডিশদের কলোনি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুইডিশদেরই বংশধর। আগের প্রেসিডেন্ট বুশ ছিল আয়ারল্যান্ড থেকে পাড়ি দেয়া প্রবাসীদের বংশধর।
গাড়ি অটো চলছে। চারপাশের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য অবলোকন করছিলাম আর চলছিলাম। ঘাড় বাঁকা করে তাকালেই পেছন থেকে বাচ্চারা আর স্ত্রী সাবধান করছে, সামনে দেখে যেন গাড়ি চালাই। সামনের সীটে আমার পাশে পালা করে একবার বুশরা আরেকবার আয়েশা বসছে। যেই আমার পাশে থাকুক না কেন, গাড়ি চালাতে এরাও আমাকে সাহায্য করছিল। কোনও একশনে একটু ত্রুটি ধরা পড়লেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলে না এরা। বাচ্চারা আমাদের চেয়ে বেশি সচেতন এবং সাবধানী। স্কোনে কাউন্টি পার হতেই হাই-ওয়ের গতি ১২০-এ সীমিত। কিন্তু লক্ষ্য করলাম কেউ এ গতিসীমা মানছে না। ১২০ লেখা থাকলেও বেশিরভাগ গাড়িই চলছিল ১৩০-এ। কেউ কেউ ১৩৫ কিংবা ১৪০-এ চলছিল। আমি চালাচ্ছিলাম ১৩৫-এ। তবে রাস্তা এতো মসৃণ যে, এতো গতিতেও গাড়ি একটুও দুলছিল না। বাইরে না তাকালে মনেই হবে না গাড়ি চলছে। গাড়ির ভেতরে কেউ চাইলে হেলান দিয়ে বই পড়তে পারবে কোনও সমস্যা ছাড়াই। কোথাও কোনও উঁচু বা নিচু নেই। রাস্তায় কোথাও গর্ত বা রাস্তার উপর পাথরের টুকরোও নেই। ফলে গাড়ি চলছিল অত্যন্ত স্থির ভাবে।
হাই-ওয়ে ঠিক রাখতে কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও আবার পাহাড়ের বাঁক বেয়ে রাস্তা উঁচুতে চলে গেছে, কোথাও উল্টো, মানে পাহাড় বেয়ে আবার নিচে নেমে গাছে। উপরে উঠতে উঠতে বাচ্চারাসহ আমরা সবাই ‘আল্লাহু আকবর’ রব তুলছিলাম। আবার নিচে নামতে ‘সুবহানাল্লাহ’ রব জিকির করছিলাম। এটা সুন্নত। উঁচুতে উঠতে গেলে আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিতেন। আবার নিচে নামতে গেলে সুবহানাল্লাহ ধ্বনি দিতেন। উঁচুতে বা নিচুতে যাবার সময় পেটে এক ধরণের শির শির ভাব অনুভব করছিলাম। এতো দ্রুত চলছিলাম যে সামান্য ঢালে মনে হচ্ছিল গাড়ি হাওয়ায় ভাসছিল। এই মুহূর্তে বাতাসের তেমন গতি নেই। ঝরো হাওয়া হলে গাড়ির গতি অবশ্যই কমিয়ে নিতে হতো। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে রাস্তার উপরে এবং পাশে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন তথ্য দেয়া থাকে। তবে আমাদের গাড়িতে আইপ্যাডের মতো বিশাল ডিসপ্লে থাকায় সেখানে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দেখতে অধিক সুবিধা হচ্ছিল। এ পর্যন্ত আমাদের একেকজন কয়েকশ বার দরুদ শরীফ শেষ করে নাত গাওয়া শুরু করলাম। বাচ্চারা ভালো গাইতে পারে। তারা খুব অনুকরণ প্রিয়। ইউটিউবে যেমন দেখে তেমন করেই গাইতে চেষ্টা করে।
১ম পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।