মালমো থেকে স্টকহোম এ্যা জার্নি বাই কার [তৃতীয় পর্ব]- ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

২০২০-এর মডেলের গাড়ি। প্রযুক্তির উৎকর্ষ পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়েছে এই মডেলে। চালকবিহীন গাড়ির একধাপ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কেবল সাবধানতার জন্য স্টিয়ারিং-এ হাত রাখা। এক্সেলারেটর থেকে পা তুলে নিয়েছি সেই শুরু থেকেই। তবে যে কোনও পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে একটু সজাগ থাকা চাই। সে ধরণের সাবধানতা অবলম্বন করে পথ চলছি। ১৩৫-কিমি থেকে গতি কমিয়ে আনতে হল। সামনের রাস্তা ১২০ থেকে কমে ১১০-এ এসে গেছে। এরপর লক্ষ্য করলাম তা কমে ৯০-এ চলে এলো।

মালমো থেকে স্টকহোম যেতে ছোটবড় অনেক শহর অতিক্রম করতে হয়। রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডে সেসব শহরের নাম, দূরত্ব এবং রাস্তার নম্বর বা নাম উল্লেখ করা আছে। তা দেখে বুঝলাম আমরা ইয়ংশপিং অতিক্রম করছি। অকস্মাৎ লক্ষ্য করলাম আমরা পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে ছুটছি আর হাতের বামপাশে পাথুরে রাস্তার একেবারে নিচে বয়ে চলেছে বিশাল সাগর। গুগোল ম্যাপে লক্ষ্য করলাম, সেখানে নীল রঙ, মানে পানির রঙ। সুইডেনের ভেতরে তো কোনও সাগর নেই। তাহলে এই বিশাল সাগর কোত্থেকে এলো? সুইডেনের পশ্চিম পাশে রয়েছে সাউন্ড সাগর আর পূর্বদিকে রয়েছে বাল্টিক সাগর। ভেতরে না কোনও সাগর আছে আর না কোনও নদী। এবার বুঝতে পারলাম, যে বিশাল সাগরের মতো পানি দেখা যাচ্ছে তা আসলে একটি লেক। অসংখ্য লেক রয়েছে পুরো সুইডেন জুড়ে। তবে দুটো লেক বিশাল আকৃতির, প্রশস্তের দিক দিয়ে সাগরের কাছাকাছি। এর একটি হল ভেত্তের্ন (Vättern) আর অন্যটি হলো ভেনের্ন (Vänern)। ভেত্তের্নের দৈর্ঘ প্রায় ১৩৫ কিমি আর প্রশস্ত ১০ থেকে ৩০ কিমি। অপরদিকে ভেনের্নের দৈর্ঘ ১৫০ কিমি আর প্রশস্ত সর্বোচ্চ ৮০ কিমি। এতো বিশাল লেককে সাগর বললেও ভুল বলা হবে না। তবে এগুলোকে সাগর না বলার একটি কারণ হল যে, লেকগুলোর চারপাশ ভূমি দিয়ে ঘেরা, অন্য কোনও সাগরের সাথে এরা মিশেনি।

একটি গোপন তথ্য জানাই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামী, আলফ্রেড নোবেলের দেশের মানুষেরা আবার বোকা টাইপেরও। বাল্টিক সাগরকে এরা মনে করতো একটি বিশাল লেক। এর সাথে যে সর্ব দক্ষিণের শহর মালমো আর ডেনমার্কের সীমান্তে সাউন্ড সাগরের সংযোগ ঘটেছে তা তারা বুঝতে না পারায় এর নাম দিয়েছে পূর্ব পাশের লেক। যা সুইডিশ ভাষায় আজো ওস্তার শোন (Östersjön) বলা হয়। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “প্রাচ্য ঝিল”।

১৩৫ কিমি লেকের পার দিয়ে প্রায় ৬০ কিমি রাস্তা আমাদের পার হতে হবে। মজার ব্যাপার হল এই রাস্তা চলে গেছে লেকের পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশ বেয়ে। কোথাও কোথাও পানির উপরিভাগ থেকে পাহাড়ের উপরের রাস্তার উচ্চতা কয়েকশ মিটার। গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় তাই নিচের দিকে তাকালে হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হতে পারেন। এ কারণেই এই হাই-ওয়েতে গতি যথেষ্ট কমিয়ে আনা হয়েছে। আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু গুগোল মামা আমাদেরকে এই রাস্তায় নিয়ে এসেছে। আর এখন বুঝতে পারছি এ রাস্তায় না এলে এমন মজার এবং রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম। এই বিশাল লেকটি বাম পাশে রেখে সামনে এগিয়ে চলেছি। হাতের ডানে সুউচ্চ পাহাড়মণ্ডলী। সে পাহাড়মণ্ডলী আবার সবুজ গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত। এই একটি স্থানে এসেই প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্য-সুষমা উদার হস্তে ঢেলে দিয়েছে। সারি সারি পাহাড়, পাহাড় জুড়ে সুবিশাল বৃক্ষ আর সবুজের মিলনমেলা। এখন গ্রীষ্মকাল। তাই গাঢ় সবুজের সমারোহ যেন। সমুদ্ররুপী বিশাল লেকের মনোরম দৃশ্য উঁচু থেকে আরো মনোরম লাগছিল। এই বিশাল লেকের মাঝে মাঝে আবার ছোট ছোট দীপ রয়েছে। লেকে ছোটবড় অনেক জাহাজ লক্ষ্য করলাম। দূরে দৃষ্টি দিলে লেকের অপর পাড়ের শহর এবং বন্দর দৃষ্টিগোচর হয়। এমন অপূর্ব সৌন্দর্য-সুধা যেন স্রষ্টা নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছেন। সুবহানাল্লাহ!

মালমো থেকে রওয়ানা দিয়েছি অনেক আগে। তিন ঘণ্টার অধিক পার হয়ে গেছে। একটু একটু ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে। সাথে পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। তবে গাড়ি থামিয়ে সবাই একসাথে বসে খেলে মজা হবে, লম্বা জার্নিতে ছোটখাটো একটা পিকনিক হয়ে যাবে। তাই হাই-ওয়ে থেকে নামার এক্সিট পয়েন্ট খুঁজছিলাম। আমাদের দেশে তো হাই-ওয়ে থেকে নামা এবং হাই-ওয়েতে উঠা খুব সহজ। এসব দেশে নির্দিষ্ট টার্নীং-পয়েন্ট ছাড়া হাই-ওয়েতে উঠাও যায় না, আবার হাই-ওয়ে থেকে নামাও যায় না। নিরাপত্তা এবং নিশ্চিত ভাবে পথ চলার জন্য এ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্সিট পয়েন্ট খুঁজতে খুঁজতে আমরা আরো প্রায় ৪০ কিমি পথ অতিক্রম করে ফেললাম। অবশেষে একটা এক্সিট পেলাম। যে শহরতলীর দিকে যাচ্ছি তার নাম লক্ষ্য করলাম গ্রেনা (Gränna)। ৩৭০ বছর পুরনো শহর। পাহাড়ের গা ঘেঁষে লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে এই সুদর্শন শহরটি। পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকে নামতে নামতে এই শহরটির অপরূপ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।

লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লম্বা রাস্তা থেকে ছোট ছোট অনেক রাস্তা চলে গেছে লেকের দিকে। দুপাশে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর। জিপিএস খুঁজে কিছু দোকানের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। এদেশে বড় আকারের গ্রোসারির দোকানে টয়লেট থাকে। বাচ্চাদের রিপ্রেশ করার ব্যবস্থাও থাকে। ডিজিটাল যুগে ফুয়েল পাম্পে এখন আর এসব ব্যবস্থা থাকে না। অনেক ফুয়েল পাম্প থেকে এ ব্যবস্থা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে খরচ বাঁচানোর জন্য। একটা মাল্টিপল গ্রোসারি দোকান খুঁজে পেলাম। ইকা (Ica), এর সাথে আরেকটি দোকান আছে, নাম কুপ (Coop)। এসব দোকানে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকার কথা। গাড়ি পার্ক করে ইকাতে ঢুকে হতাশ হলাম। এখানে টয়লেট নেই। পাশের কুপে গেলাম। ঢুকতেই গেটের কাছে লক্ষ্য করলাম ৪টি কিশোর বসে আছে। আমাকে দেখে চারজন একসাথে আমাকে সম্ভাষণ জানালো, “হেই!” এটা সুইডিশদের সম্ভাষণের পদ্ধতি। হঠাৎ চমকে কিশোরগুলোর দিকে তাকালাম। তারা আমাকে দেখে হাসছে। আমি দ্রিলিস আরতুগ্রুল সিরিয়ালের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালাম। তারাও আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। উঁকি মেরে দেখলাম, এই দোকানেও টয়লেট নেই।

দোকান থেকে বের হতেই সেই চার কিশোর আবার সমস্বরে আমাকে বিদায় জানালো, “হেইডো!” আমি এবার ঘুরে দাঁড়ালাম। তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, এ শহরের নাম কি? তারা উত্তরে জানালো, গ্রেনা। আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি এই শহরের বাসিন্দা? তারা সবাই সমস্বরে জবাব দিল, হ্যাঁ। খুব চমৎকার তোমাদের শহর। আরো চমৎকার এই শহরের মানুষগুলো। তারা এবার সবাই একসাথে মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিল, থাক। এর মানে ধন্যবাদ। সুইডেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোকে মানুষ না বলে ফেরেশতা বললেও কম বলা হবে। এরা যেমন নিরীহ, তেমনি দয়ালু, তেমনি আন্তরিক এবং পরোপকারী। ধরুন এই কিশোরগুলোকে আমি কপির নিমন্ত্রণ, করলাম। এরা লজ্জায় মরে যেতো আর কাচুমুচু করে খুব ভদ্রভাবে বলতো, ধন্যবাদ। তবে আমার বাবা-মা জানলে রাগ করবে। অপরিচিত কারো থেকেই এরা কিছু নেবে না। বাবা-মাকে না বলে কারো সাথে কোথাও যাবার কথা তো কল্পনাও করতে পারে না।

ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোথায় টয়লেট পাওয়া যাবে? একজন হাতে ইশারা দিয়ে দেখাল। ভাগ্যক্রমে একটা পাবলিক টয়লেট পেয়ে গেলাম, এই শহরের মতোই পরিষ্কার আর গোছানো। রিফ্রেশ হয়ে সেখান থেকেই অজু করে নিলাম। এই ফাঁকে গাড়িতে বসেই সবাই খেয়ে নিলাম। সাথে পর্যাপ্ত খাবার থাকায় বাড়তি কিছু কিনতে হল না। খেতে খেতেই লক্ষ্য করলাম শহরের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অতি মনোরম চোখ ধাঁধানো সুউচ্চ মিনার সম্বলিত একটি গির্জা। ছোট্ট পরিপাটি মনোরম শহরটি ছেড়ে আমরা আমাদের গন্তব্যে এগিয়ে চললাম। যেতে যেতে সে কিশোরদের আন্তরিক মুখগুলো কল্পনা করতে লাগলাম। পথে যার সাথেই দেখা হচ্ছিল, সেই মাঠে নিচু করে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল। দেশে দেশে এ ভালোবাসাই পারে মানুষকে কাছে টানতে। যুদ্ধবিগ্রহের এই পৃথিবীতে এখন ভালোবাসার বড়ই অভাব।
বি দ্র – গাড়ির ছবিগুলো গাড়ির মডেল বোঝানোর জন্য। এটা আমার গাড়ি নয়।

১ম পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment