মালমো টু স্টকহোম এ্যা জার্নি বাই কার [পঞ্চম পর্ব]- ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

একেক করে শহর ও বন্দর পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছি। বাচ্চারা কখনো ঘুমাচ্ছে, কখনো আবার জেগে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, এটা কি, ওটা কি? ইয়ংশপিং পেরিয়ে লিংশপিং-এর দিকে গাড়ি ছুটে চলেছে। ধারণা করা হয় যে, প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ব্যবসা বানিজ্যের কারণে সাগর বা লেকের তীরবর্তী শহরগুলোর নাম শপিং দিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো গড়ে উঠেছে সাগর ও নদীতীরবর্তী এলাকায়। পণ্য বহন এবং যোগাযোগের সুবিধার্থে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শহর তাই জলপথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।

লিংশপিং-এর কাছাকাছি আসতেই নজরে এল বিখ্যাত একটি খাল – ইয়তা কানল (Göta Kanal)। এই খালের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই খালের বিশেষ যে প্রযুক্তি রয়েছে সেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানামা খালের মাধ্যমে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পানামা খালের প্রযুক্তি ধার নেয়া হয়েছে সুইডেনের এই ইয়তা খালে ব্যবহৃত প্রযুক্তি থেকে। সুইডেনের ভেতর দিয়ে প্রায় ১৯০ কিমি দীর্ঘ এই খালটি দুটি সাগরকে একত্রিত করেছে। এর প্রায় ৮০ কিমি কৃত্রিম ভাবে খনন করা আর বাকিটা প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি। উত্তরে-দক্ষিণে লম্বা সুইডেনের পূর্বপাশে রয়েছে বাল্টিক সাগর আর পশ্চিমে ডেনমার্কের সাথে রয়েছে সাউন্ড সাগর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সাগরগুলোর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাছাড়া বাল্টিক সাগরের চারপাশের দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।ভূমিকা রাখছে। দেশগুলো হলো – সুইডেন, জার্মানি, পোল্যান্ড, এস্তনিয়া, লাতভিয়া, লিথুনিয়া এবং ফিনল্যান্ড।

খালগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি একটু খোলাসা করেই বলি। পানামা খালের দৈর্ঘ্য হল প্রায় ৮২ কিমি। এক সাগর থেকে অন্য সাগরে সরাসরি যাবার অন্য কোনও জলপথ নেই। ফলে কৃত্রিম উপায়ে খাল খনন করে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তবে এই খননের ফলে কোথাও কোথাও উঁচু বা পাহাড়ি স্থান দিয়ে খাল খনন করতে হয়েছে। ফলে সাগরের উপরিভাগের সাথে সমতা রাখা সম্ভব হয় নি। সুইডেনের দুপাশে দুটি সাগরের মাঝে জলপথ তৈরি করতে গিয়েও ঠিক একই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল সুইডিশদের। দীর্ঘ প্রায় ২০০ কিমি পথের মাঝে বিশাল বিশাল লেক রয়েছে। যে লেকগুলোর কথা পূর্বের পর্বে উল্লেখ করেছি। একদিকে এসব লেক থাকায় সুবিধা হয়েছে, কষ্ট করে খাল খনন করতে হয়নি। কিন্তু অপরদিকে এসব লেকের পানির উচ্চতা সমান নয়। ফলে দুটি সাগরের সাথে সংযোগ কৃত খালে পানির বহমানতা স্রোতের মতো উচ্চ স্থান থেকে নিচু স্থানে ধাবিত হতো। এই সমস্যার সমধান করা হয়েছে খালের বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিম কিছু ব্লক বসিয়ে।

ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে আমি দেখিয়েছি কীভাবে উঁচু থেকে নিচুতে নৌকা নামানো হচ্ছে। অর্থাৎ- একটি নৌকা একটি ব্লকে প্রবেশ করার পর ব্লকটির অপর পাশে বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ব্লকের ভেতরের পানিটুকু ছেড়ে দেয়া হয় যাতে তা পরবর্তী ব্লক বা খালের পরের অংশের পানির সমান হয়। এরপর ব্লকটির অপর পাশটি খুলে দিলে নৌকাটি স্বাভাবিক ভাবে নিচু অংশে প্রবেশ করে চলতে থাকে। ঠিক উল্টো উপায়ে নিচ থেকে উপরের দিকে নৌকা তোলা হয়। লিংশপিং-এর একই স্থানে পরপর সাতটি ব্লক রয়েছে। ব্লকের পানির সাহায্যে একবার নৌকাটিকে উপরে তোলা হয় এবং এরপর একই ভাবে আবার নিচে নামিয়ে আনা হয়।

ঠিক একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে পানামা খালে।

স্টকহোমে যাবার পথে আমাদের একটু তাড়া ছিল। জুমা পড়ে রওয়ানা দিয়েছিলাম। আর গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছুতে হবে সূর্য অস্ত যাবার পূর্বে। না হলে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই যাবার পথে দর্শনীয় অনেক স্থানের পাশ দিয়ে গেলেও কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি। ফেরার পথে সেসব স্থান দেখার আশা নিয়ে ছুটে চললাম গন্তব্যের দিকে।

পুরো সুইডেনব্যাপী রয়েছে প্রাচীন অনেক রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গ। সুইডিশ ভাষায় এগুলোকে বলা হয় স্লথ (Slott) আর ইংরেজিতে বলা হয় ক্যাসল (Castle)। প্রাচীনকালে সুইডিশ সাম্রাজ্য ছিল আজকের তিনটি দেশ ব্যাপী – সুইডেন, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ডের একাংশ। সেকারণে আজো নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেয়া হয় নরওয়ে থেকে। কারণ, তখন নরওয়ে ছিল সুইডেনের অংশ আর শান্তি পুরষ্কারটি তখন দেয়া হতো অসলো থেকে। সুইডেনে এখনো রাজতন্ত্র বিদ্যমান, যদিও রাজার ক্ষমতা কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কার্যত দেশ পরিচালনা করে সংসদীয় সরকার। অনেকটা ব্রিটেনের মতো সংসদীয় রাজতন্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে ব্রিটেনের রাণীর হাতে এখনো যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, যেমন ক্ষমতা রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি একটি অলঙ্কৃত পদ মাত্র। ক্ষমতা সব প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সুইডেনেও তাই।

এসব ক্যাসল বা রাজপ্রাসাদে তৎকালীন সামন্তপ্রথা অনুসারে রাজ পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বসবাস করতেন এবং উক্ত অঞ্চলের প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করতেন। ঠিক এখনো ব্রিটেনে এই প্রথা বিদ্যমান রয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের ৪টি অঞ্চল বা দেশকে একসাথে এক রাণীর অধীনে রাখা হয়েছে – ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। তবে একেকটি অঞ্চলের জন্য রাজপরিবারের একেকজন সদস্য রয়েছেন এর আনুষ্ঠানিকতার জন্য। যেমন প্রিন্সেস ডায়ানাকে বলা হতো প্রিন্সেস অব ওয়েলস (Princess of Wales)। ওয়েলস ব্রিটেনের ৪টি দেশ বা অঞ্চলের একটি। মধ্যযুগে ইউরোপে এই সামন্তপ্রথা ছিল। আজ আর এসব নেই। সুইডেন এখন এক রাজার অধীনে পুরো দেশ, আর রাজা কেবল আধুনিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ একটি পদ অলঙ্কৃত করে আছেন। ফলে প্রাচীন সামন্তপ্রথার সেসব রাজপ্রাসাদ আজ নিঃস্ব এবং দর্শনীয় স্থান হিসেবে টিকে আছে। দৃষ্টি নন্দন এসব রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গগুলো প্রাচীন সুইডেনের সামন্ত প্রথার প্রমাণ বহন করে চলেছে। বিশাল অঞ্চল নিয়ে রাজপ্রাসাদ, বাগানবাড়ি, দীঘি আজো বিদ্যমান। এসব রাজপ্রাসাদ বা দুর্গ নদী কিংবা লেকের পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় এর সৌন্দর্য পর্যটকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ফলে প্রতিদিন এসব স্থানে হাজার হাজার দর্শনার্থী চোখে পড়ে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment