ঊর্ধ্ব শ্বাসে ছুটে চলা ঘোড়া দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আমার বাচ্চাদেরও খুব শখ ঘোড়ায় চড়ার। বড়জন ৫ মাসের একটি কোর্স করেছে ঘোড়ায় চড়ার উপর। মেঝজনও আবদার করছে, সেও ঘোড়ায় চড়া শিখতে চায়। আমি উত্তর দেই, হবে ইন শা আল্লাহ! ঘোড়ার পীঠে সওয়ারী যদি সত্যের সৈনিক হয় তখন সে পথচলা হয়ে উঠে আরো রোমাঞ্চকর। দ্রিলিস আরতুগ্রুল সিরিজে অশ্বারোহী এমন অনেক সৈনিকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে। নিজ শহর থেকে রাজধানী অভিমুখে ছুটে চলেছি ঊর্ধ্ব গতিতে। তবে ঘোড়ায় চড়ে নয়, গাড়ি ড্রাইভ করে। ঘোড়ায় চড়ায় এক ধরণের বন্য আনন্দ আছে। চারপাশ উন্মুক্ত-খোলা, বাতাস ভেদ করে ছুটে চলতে হয়। গাড়িতে চড়ায় ভিন্ন আনন্দ। দরোজা-জানালা বন্ধ। গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়, তবে খোলা বাতাস গায়ে এসে লাগে না। ১৩০-১৩৫ গতিতে চলা গাড়ির জানালা খুলে চললে প্রচণ্ড বাতাসের সাথে বিকট শব্দও চলে আসে। এমনিতেই গাড়ির জানালা বন্ধ করে প্রচণ্ড গতিতে চলতে গিয়ে টের পাওয়া যায়, বাইরে যেন বিশ্বযুদ্ধ বলছে। জানালা খোলা রেখে চললে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ধরে আসার কথা।
উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে ঘোড়ায় চড়ে এক ধরণের চমৎকার অনুভূতি পাওয়া যায়। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়েও তেমন এক ধরণের অনুভূতি টের পাওয়া যায়। বিশাল বিস্তৃত প্রান্তর ভেদ করে চলার সময় পাহাড় এবং বিভিন্ন প্রান্তর পার হবার সময় গাড়ি এক সময় উপরে উঠছে, কখনো আবার রাস্তা অনুসরণ করে নিচে নামছে। বাংলাদেশে পাহাড়ি অঞ্চল বাদে বাকি সবটুকুই পুরো সমতল। কিন্তু এখানে উঁচু আর নিচু ল্যান্ডস্কেপ। মাইলের পর মাইল উপরের দিকে চলার পর আবার মাইলের পর মাইল নিচের দিকে নেমে আসতে হয়। নিচু থেকে উপরে উঠতে গেলে যেমন এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভূত হয়, উপর থেকে নিচে নামতে গেলেও মনে হয় যেন বাতাসে উড়ে পাখা মেলে নিচে নামছি। তার সাথে যদি যোগ হয় বাঁক নেয়া বিস্তর পথ আর খোলা প্রান্তর, তাহলে এর অনুভূতি ভিন্ন এক উচ্চতায় পৌঁছে। মুখ থেকে তখন স্বাভাবিক ভাবেই বের হয়, সুবহানাল্লাহ! মহান প্রতিপালকের অপূর্ব সৃষ্টি আর মানুষের যত্ন মিলে প্রকৃতি যেন হয়ে উঠেছে অসাধারণ অকল্পনীয় কাব্যিক। এভাবে যতবার উপর থেকে নিচে নামি ততবার নিজের অজান্তেই মুখে উচ্চারিত হয় সুবহানাল্লাহ। আর উপরে উঠতে গেলে আল্লাহ পাকের মহিমা এবং বিশালত্ব দেখে মুখ দিয়ে বের হয় আল্লাহু আকবর।
এর মাঝেই আবার বৃষ্টি নেমে এলো। এ বৃষ্টি সাধারণ বৃষ্টি নয়। রহমতের ধারা এবং মুষলধারে বৃষ্টি। এসব দেশে সাধারণত হালকা বৃষ্টিপাত হয়। আমাদের দেশের মতো কুকুরবিড়ালের (cats and dogs) বৃষ্টি এদেশে খুব একটা হয় না। যেসব দেশে অর্ধেকের বেশি বনাঞ্চল থাকে, সেসব দেশে সারা বছর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। অতি বৃষ্টিও হবে না, অনাবৃষ্টিও হবে না। এটা মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য উপহার। আমরা যখনই প্রকৃতি কেটে সাবার করি, প্রকৃতিকে বিভিন্ন ভাবে বাঁধাগ্রস্ত করি, তখনই নেমে আসে অনাবৃষ্টি, খরা কিংবা অতি বৃষ্টি। তখন প্রকৃতি প্রতিশোধ হিসেবে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় দুর্যোগ। ফলে যা কিছুই ঘটে এর সবই আমাদের অর্জন। যে কথা আল্লাহ পাক বারবার পবিত্র কুরআনেও উল্লেখ করেছেন। ইউরোপ এবং পশ্চিমা বিশ্ব নাস্তিক আর বিধর্মীদের দেশ। সাজানোগুছানো। এরা বিধর্মী হতে পারে, তবে প্রকৃতির উপর অত্যাচার করে না। প্রকৃতিকে নিজস্ব গতিতে চলতে সাহায্য করে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে যেদিন থেকে প্রকৃতিকে বাঁধা দিয়েছে, সেদিন থেকেই ভারত ও বাংলাদেশে নেমে এসেছে দুর্যোগ, প্লাবন এবং অস্বাভাবিক বন্যা। বাংলাদেশের নদীনালা পানির অভাবে যেমন শুকিয়ে গেছে, তেমনি বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি ধারণ করতে না পেরে বন্যার আকারে পুরো দেশকে প্লাবিত করে। এসব দেশে এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই বললেই চলে।
বৃষ্টির সময় গাড়ির গতি কমিয়ে আনতে হয়। নাহলে জরুরি প্রয়োজনে ব্রেক করলে গাড়ি না থেমে বরং ঘুরে যেতে পারে। পানির উপর ব্রেক ঠিক মতো কাজ করে না। ১৩৫ থেকে কমিয়ে মাত্র ৯০ এ নামিয়ে আনলাম। বৃষ্টি আরো তীব্র হচ্চিল। ফলে গতি কমিয়ে একেবারে ৫০ এ নামিয়ে আনলাম। অকস্মাৎ আমার গাড়ি টিক টিক করে সিগন্যাল দিচ্ছিল। কোনও কিছু বুঝে উঠার আগেই ব্রেকে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি আরো কমিয়ে আনলাম। এরপর লক্ষ্য করলাম, ডানপাশ থেকে একটি গাড়ি ইন্ডিকেটর না দিয়েই অকস্মাৎ নিজের লেন পরিবর্তন করে আমার সামনে চলে এসেছে। বৃষ্টির কারণে গাড়ির সেন্সর ঠিক মতো কাজ করেনি, ফলে গাড়ি নিজ থেকে ব্রেকও করেনি। তবে অন্য আরেকটি সেন্সর কাজ করায় সাথে সাথে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে খুব কাছে অন্য একটি অস্তিত্ব বিদ্যমান। যাক, আলহামদুলিল্লাহ্, সময় মতো ব্রেক করতে পারায় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম। এসবই প্রতিপালকের অনুগ্রহ। বৃষ্টির কারণে বাচ্চারা জেগে উঠেছে। পেছনে বসে স্ত্রীও বাইরে বৃষ্টি দেখছে। তবে এদের কেউই ঠিক লক্ষ্য করতে পারে নি যে, মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে একটি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম।