চেংঙ্গিস খানের বংশধরদের ইসলাম গ্রহণ

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের হাতে বাগদাদ ধ্বংস হয়েছিল ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে। বিভিন্ন সূত্রমতে প্রায় ৮ লক্ষ লোককে তখন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, এই ধ্বংসযজ্ঞ ছিল আব্বাসীয়দের নিজেদের কর্মের ফল এবং তা তাদের পাওনাই ছিল। একে একে বিভিন্ন দেশ ও ভুমি মুসলমানদের হাতছাড়া হলেও মুসলিম কোন খলীফা এর প্রতিশোধ নিতে পারেন নি। তবে অবাক করার ব্যাপার হলো যিনি বাগদাদ ধ্বংসের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং এর প্রতিশোধ স্বরূপ হালাকু খানকে চরম শাস্তি দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি একজন মঙ্গোলীয় এবং হালাকু খানের আপন চাচাতো ভাই বারকে খান (Berke Khan: ১২০৯-১২৬৬)। প্রতিজ্ঞামত তিনি হালাকু খানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন যেগুলোতে হালাকু খান পরাজয় বরণ করেন। ফলে হালাকু খান মিশরের মামলুক রাজবংশ আক্রমণে অগ্রসর হতে পারেন নি। মুসলিম ঐতিহাসিক রাশিদ উদ্দিন হামাদানী বারকে খানের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, “হালাকু খান মুসলমানদের সব শহর ধ্বংস করেছে এবং খলিফাকে হত্যা করেছে, আল্লাহর সাহায্য নিয়ে আমি তার কাছ থেকে এসব নিরীহ মানুষের রক্তের হিসেবে নেব।” তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন।

সমসাময়িক মুসলিম বিশ্ব

মিশরে মামলুক বা দাস সুলতানদের স্বাধীন রাজত্ব চলছিল। স্পেনে উমাইয়াদের নিভু নিভু অবস্থা। ইরান, সিরিয়া, বাগদাদ এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিম এলাকাগুলো তখন মঙ্গোলদের অধীনে ছিল। 

বারকে খানের ইসলাম গ্রহণ

কাজাখস্তানের বুখারা ছিল মুসলমানদের প্রথম শহর যা মঙ্গোলদের অধীনে আসে। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান নিজেই এ শহরটি দখল করেন। সিল্ক রোড দিয়ে চলমান একটি মঙ্গোলীয় বানিজ্য কাফেলায় আক্রমণের সূত্র ধরে চেঙ্গিস খান মুসলমানদের ভুমি দখল শুরু করেন। তার নাতি বারকে খান একবার এই বুখারার ভেতর দিয়ে ইউরোপ থেকে রাজধানী খারখোরিন যাচ্ছিলেন মঙ্গোলীয়দের উচ্চ পর্যায়ের রাজসভায় যোগ দেবার জন্য। তিনি মুসলমানদের একটি মরুযাত্রী দলের সাক্ষাৎ পেলেন। সে দলে ছিলেন একজন সুফী দরবেশ, হযরত সাইফ উদ্দিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁর কাছে মুসলমানদের বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আল্লাহর অলিগণের একটি মাত্র সুদৃষ্টিতে মানুষের ভাগ্য বদলে যায় তার প্রমাণ এই ঘটনাটি। বারকে খানের মা ছিলেন একজন খৃষ্টান এবং তিনি নিজেও খৃষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তার এতদিনের ধর্ম বিশ্বাস হযরত সাইফ উদ্দিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহির একটি মাত্র দৃষ্টিতে পাল্টে যায়। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। শুধু তিনি নিজেই ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং অন্যান্য মঙ্গোল খানদেরও ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাদের অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন।

বারকে খান ছিলেন মঙ্গোল খানদের ৪টি প্রদেশ বা হরদের একটি গোল্ডেন হরদের (Golden Horde) অধিপতি। তার প্রচেষ্টায় বাকি আরো দুটি হরদের খানেরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সৈন্যদের অনেকেই ইসলামে দীক্ষিত হন। পাশের ম্যাপে যেমন দেখতে পাচ্ছেনঃ

১। ইল-খানাতঃ পারস্য, তুরুস্কের কিছু অংশ, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরাক, জর্জিয়া, সিরিয়া, রাশিয়ার কিছু অংশ।

২। গোল্ডেন হরদঃ পূর্ব ইউরোপ, সাইবেরিয়া, ককেশাস অঞ্চল এবং কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জর্জিয়া, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান্‌ রাশিয়ার কিছু অংশ, মলদোভা, ইউক্রেইন।

৩। চাগাতাই খানাতঃ কিরগিস্থান, চিীনের কিছু অংশ, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের কিছু অংশ, তুর্কমেনিস্তান, মঙ্গোলিয়া এবং ভারতের কিছু অংশ।

৪। যুয়ান রাজতন্ত্রঃ বর্তমান চীন। একমাত্র এই যুয়ান রাজতন্ত্র ছাড়া বাকি তিনটি খানাতের শাসকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসে খ্যাত কুবলাই খান ছিলেন এই রাজতন্ত্রের খান এবং অন্যান্য খানদের দ্বারা নির্বাচিত গ্রেট খান। চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্য ৪ ছেলের মাঝে বিভক্ত হলেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সহযোগিতা বিদ্যমান ছিল।

হালাকু খানের ছেলের ইসলাম গ্রহণ

১২৬৫ সালে হালাকু খানের মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র আবাকা খান ক্ষমতায় আসীন হন। ১২৮২ সালে আবাকার মৃত্যুর পর তার ভাই এবং হালাকু খানের আরেক পুত্র তাকুদার ক্ষমতায় আসীন হন। জন্মের পর তিনি নিকোলাই হিসেবে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে আহমেদ তাকুদার নাম ধারণ করেন। ইল-খানাত বা ইল-খানতন্ত্রের পরিবর্তে তিনি এর নামকরণ করেন সালতানাত। তার শাসন ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য, ১২৮২ থেকে ১২৮৪। পূর্ববর্তী খান আবাকার পুত্র আরগুন সফল একটি ক্যু-এর মাধ্যমে তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। 

যাদের হাতে মুসলমানদের একটির পর একটি শহর ধ্বংস হয়েছিল সেই মঙ্গোলদের হাতেই আবার ইসলামের বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে। উল্লেখ্য, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর (১৪৮৩-১৫৩০) ছিলেন চেঙ্গিস খান এবং তিমুরলেনের বংশধর।

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *