আ-তায়ে রাসূল [ﷺ] খাজা গরীবে নেওয়াজ [রহঃ]

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

খাজা গরীবে নেওয়াজ [রহঃ]-এঁর জন্য আনা সাগরের পানি বন্ধ করতে চেয়েছিল রাজা পৃথ্বীরাজ। নাম সাগর হলেও এটি আসলে বিশাল আকৃতির একটি লেক। কৃত্রিম লেক। মানুষের খনন করা। তবে সাগরের মতোই বিশাল এ লেক। তা খনন করেছিল পৃথ্বীরাজের বাবা। আচ্ছা, রাজা পৃথ্বীরাজ কি কারবালার ঘটনা জানতো? কিংবা তার লোকজন কি কারবালার ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিল? তাদের মাথায় কীভাবে এলো এমন অভিনব পদ্ধতি? বিশাল লেকের পানি কতো জনেই তো পান করে! সেখানে একজন মুসলমান দরবেশ এবং তাঁর মাত্র ৪০ জন সাথী পান করলে কি এমন কমতি হতো? তবে উদ্দেশ্য ছিল পানিতে কষ্ট দিয়ে দরবেশদের দমন করা। ঠিক সিফফিনের পথে মওলা আলীকে এবং কারবালায় আহলে বাইতকে কষ্ট দেবার মতো। তাঁদেরকেও পানির কষ্ট দিয়েছিল কিছু মানুষ। তবে কোনও কাফের নয়, আমাদের মতোই নামায-রোযা পালন করা কিছু মুসলমান। সে একই চিন্তা পৃথ্বীরাজ বা তার লোকদের মাথায় এলো কি করে? 

আহলে বাইতের জন্য এভাবে অবারিত পানি বন্ধ করা নতুন কোনও বিষয় নয়। সিফফিনে যাবার পথে হযরত মুয়াবিয়ার সৈন্যরা মওলা আলী কারামুল্লাহ ওয়াজহু এবং তাঁর সৈন্যদের জন্য ফোরাতের পানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই একই নদীর পানি বন্ধ করেছিল এজিদের বাহিনীও। ২৫ বছরের মধ্যে একই ঘটনা দুবার ঘটলো। তাও আহলে বাইত [রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম]-গণের জন্য। গরীবে নেওয়াজও আহলে বাইতের সন্তান। সহীহ হাদিস অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত এ আহলে বাইতের শান এবং মর্যাদা থাকবে। তাঁদেরকে অনুসরণের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। সেই হাউজে কাউসারে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত। মানে কিয়ামত পর্যন্ত। গরীবে নেওয়াজের জন্য আনা সাগরের পানি বন্ধ করার পেছনে কি কারবালার ঘটনার অনুপ্রেরণা ছিল? রাজার লোকেরা খাজা গরীবে নেওয়াজের জন্য আনা সাগরের পানি বন্ধ করে দেয়ায় তিনি এর সাথে কারবালার ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পান। তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠেনঃ

“তোরা কি কারবালা পেয়েছিস? বোকারা বুঝতে পারেনি যে ইমাম হুসাইন [রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু] পানির পিপাসায় এবং অসহায়ের মতো শহীদ হননি বরং তিনি আসল ও নকলের ভাগটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেছেন। ইমাম হুসাইন [রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু]-এঁর জুলজীনের (ঘোড়ার) পদধূলি বলতেও নিজেকে আমি লজ্জাবোধ করি, অথচ আমি “হাসান” যদি সেদিন কারবালার মাঠে উপস্থিত থাকতাম আর একটি অঙ্গুলি দিয়েও খোঁচা দিতাম, তাহলে আল্লাহর কসম, সঙ্গে সঙ্গে পানির নহর বয়ে যেতো।” সোবহান আল্লাহ্‌!

পানি বন্ধের নোটিশের পর তিনি কেবল এক ঘটি পানি দাবী করলেন। পৃথ্বীরাজের বাহিনীর কাছে। এরা ভাবলো, এক ঘটি পানিই তো, এ আর তেমন কি! এক ঘটি নিতে চায় নিক। যেই ভাবা তা করা। গরীবে নেওয়াজের কাছে এক ঘটি পানি উপস্থিত করার পর দেখা গেল পুরো আনা সাগরের পানি শুকিয়ে গেছে। এ যেন রাসূল [ﷺ]-এঁর একটি ঘটনার ঠিক উল্টো। তাবুকের পথে সাহাবাগণ পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। পানির কষ্টে তাঁরা তাঁদের জরুরী বাহন উট জবাই করে তৃষ্ণা নিবারণ করতে লাগলেন। রাসূলের কাছে এ খবর পৌঁছলে তিনি এক ঘটি পানি আনতে বলেন। ঘটির পানির উপর তাঁর পবিত্র হাত মুবারক রাখতেই হাতের আঙুল বেয়ে ঝর্ণা ছুটেছিল সেদিন। আর তাঁরই বংশের একজন প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর পরে এক পুরো লেকের পানিকে একটি ঘটিতে নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় চারিদিকে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। এক মুসলিম দরবেশকে এক ঘটি পানি দেবার পর পুরো আনা সাগরের পানি শুকিয়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে পানির জন্য চারিদিকে হাহাকার দেখা গেল। পানির অভাবে আনা সাগরের চারপাশের মানুষের সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল। রাজার কানে এ ঘটনার খবর পৌঁছলে সে তার লোকজনকে মুসলিম দরবেশের কাছে ক্ষমা চাইতে আদেশ দিল। এ যাত্রায় রক্ষা পেল রাজা ও তার দল।

তবে সেই মুসলিম দরবেশের এটাই প্রথম কারামত ছিল না। এর পূর্বের কারামত ছিল আরো কঠিন এবং জটিল। তিনি ছিলেন আ-তায়ে রাসূল [ﷺ]। দুভাবেই তিনি রাসূল [ﷺ]-এঁর দান। ভারতবাসীর জন্য তিনি আ-তায়ে রাসূল [ﷺ]। আবার তাঁর জন্য হিন্দুস্তান আ-তায়ে রাসূল [ﷺ]। রাসূল [ﷺ] কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তিনি বিভিন্ন পথপরিক্রমায় আজমীর এসে হাযির হন। ৪০ জন সাথী নিয়ে তিনি আস্তানা গাড়েন রাজা পৃথ্বীরাজের উট-বাঁধার জায়গায়। রাজার লোকজন মুসলিম দরবেশদের দেখে ক্ষেপে উঠে। তারা গরীবে নেওয়াজ এবং তাঁর সাথীদের সেখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। তিনি উঠে চলে যান, তবে বলে যান, আমরা এখান থেকে চলে গেলাম। তবে তোমাদের উট এখানে বসেই থাকবে। দিন শেষে রাজার উটের বহর সেখানে নিয়ে রাখা হলো। পরদিন সকালে রাজার লোকেরা গিয়ে দেখল, সবগুলো উট সেখানেই বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও কোনও উটকে তারা তুলতে পারলো না। এ ঘটনা রাজাকে জানালে রাজা তার লোকদের মুসলিম দরবেশদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। ভালোবাসার ফেরিওয়ালা গরীবে নেওয়াজ তাদের ক্ষমা করে দেন এবং রাজার উট যথারীতি চলাফেরা শুরু করলো।

এরপরের কারামতই ছিল পানিতে বাধা দেয়ার পরিণামে আনা সাগরের সমস্ত পানিকে ছোট্ট ঘটিতে নিয়ে নেয়া। রাজা উপায়ন্তর না দেখে তার রাজ দরবারের সাধু রামকে ডেকে পাঠাল। সাধু রাম ছিল বড় সাধক, যোগী এবং যাদুকর। গরীবে নেওয়াজের সামনে গিয়ে সাধু রাম তার সব মন্ত্র ভুলে গেল। রাম রাম বলতে গিয়ে সে মুখ দিয়ে রাহিম রাহিম বলা শুরু করলো। খাজা গরীবে নেওয়াজের সোহবতে তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল এবং গরীবে নেওয়াজ তার অন্তর আলোকিত করে দিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে গরীবে নেওয়াজের কাছে মুরিদ হয়ে গেলেন। এ অবস্থা দেখে রাজা অসহায়ত্বে পড়ে গেল। সে তার রাজ্যের সবচেয়ে বড় যাদুকর অজয় পালকে ডেকে পাঠাল এ মুসলিম দরবেশকে নিঃশেষ করার মানসে। অজয় পালের আসার সংবাদ শুনে গরীবে নেওয়াজ তার সাথীদের চারপাশে একটি কুণ্ডলী এঁকে দিলেন। তাঁদেরকে এর ভেতরেই থাকার নির্দেশ দিলেন। যাদুকর অজয় পাল পাহাড়ের উপর থেকে একের পর এক যাদুর অস্ত্র ছুড়তে লাগলো। কুণ্ডলীর চারপাশে এসে সেগুলো বাধাপ্রাপ্ত হতে লাগলো। তা দেখে সে যাদুর সাহায্যে পাহাড় থেকে বড় বড় পাথর ছুড়ে মারতে লাগলো। তাতেও কাজ হচ্ছিল না দেখে সে রশি এবং লতাপাতা দিয়ে যাদুর সাহায্যে সাপ বানিয়ে পাঠাতে লাগলো। আবারো সেই পুরাতন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মূসা [আ.] কেও যাদুকরেরা সাপ দিয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল। আল্লাহ্‌র কুদরতে তাঁর হাতের লাঠি সাপে রুপান্তরিত হয়ে যাদুকরদের সব সাপ গিলে ফেলল। গরীবে নেওয়াজের বেলায় যাদুকরের ছোড়া সব কিছুই কুণ্ডলীর বাইরে এসে অকেজো হতে লাগলো।

অজয় পালের মাথায় শয়তানী বুদ্ধি এল। সে ভাবল এ কুণ্ডলী ভেদ করতে হলে আকাশ থেকে এসব ফেলতে হবে। যাদুর সাহায্যে সে উঁচুতে উড়ে কুণ্ডলী ভেদ করার চেষ্টা করলো। গরীবে নেওয়াজ এবার তাঁর জুতাজোড়া খুলে আকাশে ছুড়ে মারলেন। জুতাগুলো আকাশে উড়ে যাদুকর অজয়পালকে দুগালে আঘাত করতে লাগলো। সে কী সাঙ্ঘাতিক আঘাত! এ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে অজয়পাল নিচে নেমে এসে গরীবে নেওয়াজের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। আল্লাহ্‌র অলির সত্যিকারের কারামত এবং জজবা অনুধাবন করতে পেরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং খাজা গরীবে নেওয়াজের কাছে মুরিদ হন। আজমীর শরীফে গরীবে নেওয়াজের মাজারের সামনেই হাতের বামদিকে এই মহান অলির মাজার অবস্থিত।

তাঁর ভালোবাসা, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে আল্লাহ্‌র সৃষ্টি হিসেবে যথাযথ মর্যাদা এবং আপন করে নেয়ার মাধ্যমে তিনি একাই প্রায় ৯০ লক্ষ অমুসলিমকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আনতে সমর্থ হন। তিনি ছিলেন সূফী সাধক। ভালোবাসার ফেরিওয়ালা। ভালোবাসা বিলানোই তাঁর কাজ। আজো সেখানে মুসলিম-অমুসলিম সবাই তাঁর দরবারে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। তিনি গরীবে নেওয়াজ। তাঁর কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফিরে না। ৫৩৬ হিজরীর ১৪ রজব তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার ৬৩৩ হিজরীতে এই রজব মাসের ৬ তারিখে মওলার দীদারে গমন করেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর তাঁর কপালে নূরের লেখা ভেসে উঠে, হাযা হাবীবুল্লাহ, মা-তা বি-হুব্বিল্লাহ! তিনি আল্লাহ্‌র প্রিয় হাবীব এবং তাঁর হাবীবের প্রেমের মাধ্যমেই অনন্তকালে গমন করেন। আল্লাহ্‌ পাক তাঁর এই প্রিয় হাবীবকে জান্নাতে উচ্চ মাকামে আসীন করুন। আর উনার উছীলায় আমাদের সমস্ত গোনাহ মাফ করে পূর্ণ মু’মিন এবং আহলে বাইতের একচ্ছত্র অনুসারী এবং আশেক হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে নিজ নিজ টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মতামত জানাবেন।]

**************************

হাসান সাঞ্জারী যেভাবে মঈন উদ্দীন চিশতী [রহঃ] হলেন

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

[লেখাটি বড়, ধৈর্য্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো। ভালো লাগলে কপি করে নিজ নিজ টাইমলাইনে পোষ্ট করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন। জাযাকাল্লাহ!]

আনা সাগর
আজমীর শরীফে আনা সাগর লেক, যে লেকের পুরো পানি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহঃ এর কারামতে একটি লোটায় নিয়ে এসেছিলেন।

এক গ্লাস আঙ্গুরের রস। হ্যাঁ এক গ্লাস আঙ্গুরের রস দুজন অলি-আল্লাহ্‌কে পরস্পরে পরিচয় করিয়ে দিল। একজন ১৫ বছরের কিশোর হাসান রহঃ আর অন্যজন ইব্রাহীম কান্দুজী রহঃ। ১৪ বছর বয়সে পিতাকে হারান হাসান। আরো ৬ মাস পর মাতাকেও। পিতার রেখে যাওয়া আঙ্গুরের বাগানটি একমাত্র সম্বল। ৯ বছর বয়সে কুরআন মুখস্ত করেন তিনি। এরপর পিতার কাছেই ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাঠ নিচ্ছিলেন। কিন্তু পিতা ও মাতার ইন্তিকালের পর কিশোর বয়সেই পুরো সংসারের কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর উপর। ফলে লেখাপড়া ছেড়ে আঙ্গুরের বাগান দেখাশুনা করতে লাগলেন তিনি। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুরে আঙ্গুরের বাগানের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় এক দরবেশ এসে উপস্থিত সেখানে। তিনি ইব্রাহীম কান্দুজী রহঃ। তাঁকে দেখেই কিশোর হাসান বুঝতে পারলেন, রৌদ্রের উজ্জ্বল শিখা এবং উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় তৃষ্ণার্ত সেই বৃদ্ধ। নিজের হাতে আঙ্গুরের বাগান থেকে পাকা কিছু আঙ্গুর নিয়ে রস বানিয়ে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দিলেন। কিশোরের এমন আপ্যায়নে অবাক হলেন আগত বৃদ্ধ। তিনি ছিলেন তৃষ্ণার্ত, তাই খুব তৃপ্তি সহকারে সে রস পান করলেন। মন থেকে তৃপ্তির শব্দ বের হয়ে এলো,
– আলহামদুলিল্লাহ্‌! কি নাম তোমার বাবা?
– হাসান। উত্তর দিলেন কিশোর।
– তোমার নাম যেমন হাসান, তোমার ভেতরটাও হাসান। মানে সুন্দর। বললেন, সেই বুজুর্গ। দরবেশি থলে থেকে এক টুকরো রুটি বের করে চিবালেন। এরপর কিশোর হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, এমন উত্তপ্ত দুপুরে তুমি আমাকে আঙ্গুরের রস দিয়ে আমার তৃষ্ণা নিবারণ করেছো, তোমাকে এর বিনিময়ে কিছু না দিলে কীভাবে হয়? এই বলে নিজের চিবানো শুকনো রুটির টুকরো হাসানকে দিলেন। হাসান কোনও দ্বিধা না করে তা মুখে দিয়ে চিবাতে লাগলেন। রুটি খাদ্যনালি দিয়ে নিচে নামছে আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দরোজা খুলছে। কিশোর হাসান অনুভব করলেন, তিনি অন্য মানুষে রুপান্তরিত হচ্ছেন। যে কুরআন তিনি বক্ষে ধারণ করে আছেন ৯ বছর বয়স থেকে, সে কুরআন এখন অন্য এক রূপে তাঁর কাছে ধরা দিচ্ছে। যে ইসলামী জ্ঞান তিনি পিতার কাছ থেকে আহরণ করেছিলেন, সে জ্ঞান এখন পূর্ণ শাখা-প্রশাখায় বিকশিত হচ্ছে।

এর পর থেকেই তিনি সংসারের প্রতি অনিহা অনুভব করতে লাগলেন। ঠিক সে সময়েই তাতারীরা আফগানিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য স্থানে আক্রমণ চালাচ্ছিল। কিশোর হাসান ভাবলেন, মানুষ যেখানে না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আঙ্গুরের বাগান রেখে নিজে বাঁচলে কাল হাশরের দিনে কামলিওয়ালা নবীজী [ﷺ]-এঁর কাছে কি জবাব দেবো? ফলে পিতার রেখে যাওয়া একমাত্র সম্বল আঙ্গুরের বাগানটি বিক্রি করে এর অর্থ গরীব এবং নিঃস্বদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। কিছু পেতে হলে আগে নিজেকে নিঃস্ব করতে হয়। এটাই সূফীদের দর্শন। তিনি আল্লাহ্‌র পথে বের হয়ে গেলেন।

তিনি আলে রাসূল [ﷺ], হাসাইনি এবং হুসাইনী। ঠিক গাউসে পাক [রহঃ]-এঁর মতো। গাউসে পাক তাঁর দূর সম্পর্কের মামা। হাসান [রহঃ]-এঁর মাতা এবং গাউসে পাক চাচাতো ভাইবোন। তাঁর জন্ম সাঞ্জার নামক একটি গ্রামে যা বর্তমানে ইরানের সিস্তান প্রদেশে অবস্থিত। গজনির সুলতান মাহমুদের শাসনামলে এ অঞ্চল আফগানিস্তানের অধীনে ছিল। তাঁর অন্তরে নূরের যে আলো জ্বালিয়েছিলেন ইব্রাহীম কান্দুজী রহঃ, সে নূর তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। তিনি মারেফতের জ্ঞানের সন্ধানে মুরশিদের খোঁজে বের হয়ে গেলেন। অবশেষে খুঁজে পান তাঁর মুরশিদ। তিনি উসমান হারওয়ানী রহঃ। উসমান হারুনী নামে যিনি সর্বাধিক পরিচিত। কোনও এক সময়ে যুবক হাসান গাউসে পাক [রহঃ]-এঁর সাথেও সাক্ষাৎ করেন। আপন মুরশিদ তাঁকে নিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে যান। মক্কায় বায়তুল্লাহর মিজাবে রহমতের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর মুরশিদ তাঁর হাত তুলে ধরে মহান আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন, হে আল্লাহ্‌! আমার মঈনুদ্দীনকে আপনি কবুল করুন। সেখানেই গায়েবী আওয়াজ আসে, আমি মঈনুদ্দীনকে কবুল করলাম। তিনি মঈনুদ্দীন। মানে ধর্মের সাহায্যকারী।

মদিনায় গিয়ে তাঁর মুরশিদ তাঁকে বললেন, হাসান, আঁকা [আলাইহিস সালাম] কে সালাম দাও। হাসান সালাম দিলেন। রওযা মুবারক থেকে জবাব এলো, ওয়া আলাইকাস সালাম ইয়া কুতবাল বাশার। অর্থাৎ রাসূল [ﷺ] তাঁকে কুতবুল বাশার হিসেবে কবুল করেছেন। কুতুব হলো আল্লাহ্‌র অলিগণের একটি সম্মানিত দরজা এবং কুতবুল বাশার হলো অলিগণের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান। যিনি অন্যদের অলি বানান। এ কারণে পরবর্তীতে এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে যে তাঁর কাছে শত্রু হিসেবে যারা এসেছে, তাঁদের অনেককেই তিনি অলি বানিয়ে দিয়েছেন। হজ থেকে ফিরে তিনি তাঁর মুরশিদের কাছে ২২ বছর ধরে শরীয়ত, তরিকত, হাক্বীকত এবং মা’রেফতের পাঠ নেন। ২২ বছর পর তিনি আবার একা হজে যাবার জন্যে তাঁর মুরশিদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তাঁর ইচ্ছে মদিনায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা।

এবার মদিনায় গিয়ে মদিনাওয়ালার [ﷺ] সাথে তিনি একান্তে মনের ভাব প্রকাশ করার ইচ্ছে করলেন। কোনও কোনও বর্ণনায় পাওয়া যায় যে তিনি রওযা মুবারক জিয়ারতের সময় তন্দ্রামুগ্ধ হয়ে পড়লে দয়াল নবীজী [ﷺ] তাঁকে সাক্ষাৎ দেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে রওযা থেকে তাঁর ডাক আসে। এবং রওযা মুবারকের খাদেমগণ এ ডাক শুনতে পেয়ে মঈনুদ্দীনকে খুঁজতে বের হন। দেখা গেল অনেক মঈনুদ্দীন সাড়া দিলেন। এরপর রওযা থেকে আবার ডাক এলো, মঈনুদ্দীন চিশতী কে আমার কাছে নিয়ে এস। এবার হাসান [রহঃ] সেখানে গেলে তাঁকে রওযা মুবারকের একেবারে ভেতরের চেম্বারে যাবার জন্য আদেশ করা হয়। তিনি সেখানে গেলে তাঁকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তিনি আকুতিভরে মদিনায় থেকে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মুনিব, আমি বাকি জীবন আপনার পদপ্রান্তে কাটিয়ে দেবো বলে এখানে এসেছি’। মদিনা-মুনিবের [ﷺ] পক্ষ থেকে উত্তর আসে, ‘আমি তোমাকে হিন্দুস্তান দান করলাম। যখন প্রয়োজন হবে, আমি নিজেই তোমার কাছে চলে যাবো’। উত্তরে হাসান বলেন, আমি তো কখনো হিন্দুস্তানে যাইনি। এরপর রাসূলে আরাবীর [ﷺ] কাছ থেকে একটি আপেল দেয়া হয় যাতে হিন্দুস্তানে যাবার পুরো মানচিত্র আঁকা ছিল।

মদিনা থেকে ফেরার পথে তিনি অন্য আরেক মঈনুদ্দীন। মঈনুদ্দীন চিশতী, আ-তায়ে রাসূল [ﷺ]। আজমীরের পথে রওয়ানা দিলেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহঃ। যাত্রা শুরু করলেন একা। পথে পথে অলি-আল্লাহ্‌গণের কাছ থেকে ফায়েজ নিতে লাগলেন আর তার বেলায়াতের আকর্ষণে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন তাঁর সাথে যোগ দিতে লাগলেন। আজমীর পৌঁছানোর সময় তাঁর সাথীদের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪০ এ।

মদিনা থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে দেখা হলো শেখ নাজিমুদ্দীন কুবরা রহঃ এর সাথে। যিনি শেখ ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি রহঃ-এঁরও শায়খ। এরপর এলেন হামাদান। সেখানে তাঁর মুরশিদ উসমান হারওয়ানী রহঃ এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। বাগদাদ এলে দেখতে পান একদল লোক আগুনের উপাসনা করছে। কেন আগুনের উপাসনা করছে জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় এ আগুন যাতে কিয়ামতের দিন না জ্বালায়, তাই এর উপাসনা করছে। নাউজুবিল্লাহ! তিনি নিজের জুতাজোড়া আগুনে নিক্ষেপ করেন এবং চার ঘণ্টা পর অক্ষত জুতাজোড়া এনে তাদেরকে দেখান। তারা জানতে চাইলো তা কীভাবে সম্ভব? তিনি উত্তরে জানালেন, আমি আগুনের মালিকের উপাসনা করি, তাই আগুন আমার জুতার হেফাজত করেছে। একথা শুনে অগ্নি উপাসক দলের সবাই তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

এরপর তাবরিজ এলে শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহঃ এর পীর শায়খ তাবরিজী রহঃ এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। ইস্ফাহানে এলে শায়খ মুহাম্মদ আস্পাহানির সাথে সাক্ষাৎ হয়। সেখান থেকে খারকানে শায়খ আবুল আহসান খেরকানী রহঃ থেকে ফায়েজ নেন। শায়খ খেরকানী রহঃ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রহঃ এর পীর। এরপর চলে আসেন হেরাত। এরপর বলখ। এখানে সাক্ষাৎ পান জিয়াউদ্দীন বলখী রহঃ এর। গজনী পৌঁছলে দাতা গঞ্জেবকশ রহঃ এর সংবাদ লাভ করেন এবং লাহোরে দাতা গঞ্জেবকশ রহঃ এর মাজারে ৪০ দিন চিল্লা দেন। এ পর্যন্ত আসতে আসতে তাঁর সাথে ৪০ জন দরবেশ একত্রিত হন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন অঞ্চলের বাদশাহ এবং কোনও কোনও রাজ্যের যুবরাজও রয়েছেন। লাহোর থেকে দিল্লী, দিল্লী থেকে আজমীরে এসে উপস্থিত হন। এ পথে তিনি প্রায় ৭০০ পরিবারকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।

আজমীর পৌঁছলে রাজা পৃথ্বীরাজের সাথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যা আমি অন্য এক পোষ্টে উল্লেখ করেছি। রাজা পৃথ্বীরাজ মুসলিম দরবেশদের প্রতি অত্যাচারের কথা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহঃ এর কানে আসার মুহূর্তে তিনি জালালি অবস্থায় ছিলেন। ওইসময় তিনি বলে উঠেন, ‘পৃথ্বীরাজ, আমি তোমাকে জীবিত গ্রেফতার করলাম এবং ইসলামী ফৌজের কাছে সোপর্দ করে দিলাম’। এরপর তিনি স্বপ্নে তৎকালীন আফগানিস্তানের শাসক শিহাবুদ্দীন গোরীকে আজমীর আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। যিনি ইতিহাসে মুহাম্মদ গোরী হিসেবে অধিক পরিচিত। পুরো নাম মুঈজুদ্দীন মুহাম্মাদ গোরী। ১২০৬ সালে আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হবার মুহূর্তে তাঁর গোলাম কুতুব উদ্দীন আইবেকের কাছে দিল্লীর সালতানাত হস্তান্তর করে যান। যার নামে দিল্লীর কুতুব মিনার ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। অনেকেই মনে করেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহঃ-ই মূলত কুতুবুদ্দীন আইবেকেকে সুলতান বানান। ১২৩৬ সালে (৬৩৩ হিজরী, রজবের ৬ তারিখ) ৯৪ বছর বয়সে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহঃ নিজ প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। এসময় তাঁর কপালে নূরের লেখা ভেসে উঠে, হাযা হাবীবুল্লাহ, মা-তা বি-হুব্বিল্লাহ! তিনি আল্লাহ্‌র প্রিয় হাবীব এবং তাঁর হাবীবের প্রেমের মাধ্যমেই অনন্তকালে গমন করেন। উল্লেখ্য, হাসান তাঁর প্রকৃত নাম। মঈনুদ্দীন তাঁর উপাধি। যার অর্থ দাঁড়ায় ধর্মের সাহায্যকারী।

তিনি ছিলেন ভালোবাসার ফেরিওয়ালা। রাজ্য জয় করেছেন। সাথে জয় করেছেন মানুষের হৃদয়ও। নিজে সূফী দরবেশ। যাদের মূল কথাই হলো ঘৃণা নয়, ভালোবাসা। ঘৃণায় ঘৃণা ছড়ায়, ভালোবাসায় শান্তি আনে। রাজ্যের জন্য তিনি লালায়িত ছিলেন না। তাই রাজ্য রাজাদের দিয়ে নিজে নিঃস্ব ছিলেন। তিনি সুলতানুল হিন্দ। তবে সুলতান বানিয়েছেন। নিজে হিন্দের সুলতান ছিলেন, আছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তই থাকবেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি তিনি দেখেন নি, তিনি দেখেছেন মানুষ। সবাইকে আপন করে নিয়েছেন বলেই আজো তাঁর দরবারে সব ধর্ম ও সব জাতির মানুষের ঢল নামে। তাঁর কাছে সবাই ছুটে আসতেন। তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন বলেই একাই প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের অন্তরে ইসলামের নূর প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর অসংখ্য উপাধির কয়েকটিঃ কুতুবুল মাশায়েখ, হাবীবুল্লাহ, আ-তায়ে রাসূল [ﷺ], খাজা-এ আজমীর, খাজা-এ বুজুর্গ, হিন্দুল অলি, গরীবে নেওয়াজ, সুলতানুল হিন্দ, নায়েবে রাসূল [ﷺ] ফিল হিন্দ, আফতাবে জাহান, পাঠান-এ-বেকাছান, দালীলুল আরেফীন ইত্যাদি।

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে নিজ নিজ টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মতামত জানাবেন।]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment