হাফেজ হওয়া কি কঠিন?

হাফেজ হওয়া কি কঠিন?
=============
ফেসবুকের এক বন্ধুর কিছু কথায় আমার মাথায় হঠাৎ করে নতুন একটি ব্যাপার ঘুরাফেরা করছে! কুরআনে হাফেজ হওয়া কি কঠিন কিছু? তাঁরা কতই না সৌভাগ্যবান যারা পরাক্রমশালী প্রতিপালকের বাণী পবিত্র কুরআনকে নিজেদের সীনায় ধারণ করতে পেরেছেন। ছোটবেলায় হেফজ শুরু করা সহজ, মনে রাখাও সহজ। কিন্তু বয়স যতই বাড়তে থাকে, দিন-দুনিয়া, জগৎসংসার, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, চাকরি, ব্যবসা, ক্যারিয়ার, স্ত্রী-সন্তান সবকিছু আল্লাহ্‌কে পাবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ছোটবেলা এতসব ঝামেলা থাকে না। ফলে পবিত্র কুরআন মুখস্ত করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ এবং নির্ঝঞ্ঝাট! বয়সের সাথে সাথে অন্য সব ঝামেলাও বাড়তে থাকে।

ওই বন্ধুটির কথা মাথায় রেখে এ নিয়ে নেটে একটু ঘাটাঘাটি করলাম। আল্লাহু আকবার! কিছু কিছু মানুষ প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও মাত্র দু’মাসে পুরো কুরআন মুখস্ত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে তাঁরা তা করলেন বিস্তারিত জানতে গিয়ে অবাক হলাম তাদের ইচ্ছা শক্তি দেখে। কুরআনকে আল্লাহ্‌ পাক “নূর” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যা গোমরাহির অন্ধকার আর ঘন তমসা থেকে হেদায়েতের আলোর দিকে ধাবিত করে। মিনাজ্জুলুমাতি ইলান নূর! যিনি মাত্র দু’মাসে পুরো কুরআন হেফজ করেছেন, তাঁর উপদেশ হলোঃ এ কুরআন স্মৃতিতে ধারণ করতে হলে সব কিছুর পূর্বে নিজের মন, মগজ, দেহ – সবকিছুকে অন্যায় আর পাপ থেকে পবিত্র রাখতে হবে। ইখলাস অর্জন করতে হবে। না হলে এ নূর কারো ভেতরে প্রবেশ করে না। ছোট্ট মাসুম বাচ্চারা যখন এ কুরআন হেফজ শুরু করে, তাঁরা খুব সহজে তা হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। কেননা, পাপ এমনকি পাপবোধ তখনো তাদের কঁচি মন ও হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। ফলে তাঁরা যা পড়ে তাই সহজে মনে রাখতে পারে। আমরা যারা সেই বয়স পার করে এসেছি, দুনিয়ার লোভ এবং পাপ আমাদের মনে বাসা বাঁধতে থাকে। এ বয়সে কুরআন হেফজ করার সর্ব প্রথম শর্ত হলো সব ধরণের পাপ থেকে নিজেকে নিবৃত রাখা। আর মনে মনে একমাত্র আল্লাহ্‌ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করা।

কুরআন শেখার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন আকবা বিন আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা সুফ্‌ফাতে ছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বের হন, অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কার ইচ্ছে হয়, প্রতি দিন বাতহা বা আকিক নামক স্থানে গমন করা এবং কোন অপরাধ বা সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই বিনা পরিশ্রমে বড় ও লম্বা চুটি সম্পন্ন দুটি উট নিয়ে আসা? আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সকলে তা পছন্দ করি। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা কি সকাল বেলা মসজিদে গমন করতে পার না? সেখানে গিয়ে দুটি আয়াত শিক্ষা কর বা তিলাওয়াত কর। এটাই তোমাদের জন্যে দুটি উটের চেয়ে উত্তম। তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। তদ্রুপ অন্যান্য আয়াতের বিষয়টিও। (মুসলিম : ১:৫৫২, হা.৮,৩)

অন্য একটি হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, (হাশরের মাঠে) হাফেজে কুরআনকে বলা হবে, পড় এবং ওপড়ে উঠ। তারতিলসহ পড় অর্থাৎ ধীরে ধীরে আবৃতি কর, যেমন দুনিয়াতে করতে। কারণ, সর্বশেষ আয়াতের স্থানই হবে তোমার মর্যাদার স্থান। (আবু দাউদ ২:৫৩, হা.১৪৬৪)

আল্লাহ্‌ পাকের কাছে একজন হাফেজে কুরআনের মর্যাদা অনেক বেশি। কবরের কঠিন মুহূর্তে কুরআন নূর হিসেবে কবরবাসিকে আলোকিত করতে থাকবে। আবু উমামা বাহিলি রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে বলতে শোনেছি, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্যে সুপারিশ করবে। (মুসলিম : ১:৫৫৩, হা.৮,৪)

অন্যান্য পূর্বশর্তের মধ্যে রয়েছে সার্বক্ষণিক মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যাতে তিনি এ মহৎ কিন্তু কঠিন কাজকে সহজ করে দেন। কোথাও আটকে গেলে সেই রবের শরণাপন্ন হওয়া এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া। তিনি তা সহজ করে দেবেন এবং অন্যান্য ফেতনা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেবেন। এর জন্য নীরব পরিবেশ প্রয়োজন যাতে অযাচিত কিছু এবং চারপাশের শব্দ, হাঙ্গামা মনোযোগকে দূরে সরিয়ে দিতে না পারে। এ সময়ে সকল বন্ধুবান্ধবকে অনিচ্ছা সত্বেও দূরে সরিয়ে রাখতে হবে, কেবলমাত্র তাদের ব্যতীত যারা আপনার এই মহৎ কর্মে সহযোগী হিসেবে সাহায্য ও সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে। মুখস্তকৃত অংশটুকু আপনার বন্ধুদের শোনানম, নামাজে সেই আয়াতগুলো পড়ুন – এভাবে চলতে থাকলে ইন শা আল্লাহ্‌, এক সময় পুরো কুরআন আপনার হৃদয়ে স্থান করে নেবে।

মদীনা শরীফের বিখ্যাত হাফেজদের পরামর্শ হলোঃ প্রথম একটি আয়াত ২০ বার পড়তে হবে, এরপর অন্য আয়াত শুরু করে সেটিও ২০ বার পড়তে হবে। এরপর পূর্বের আয়াতের সাথে পরের আয়াতটির কানেকশন করতে হবে। এভাবে প্রতিদিন রুটিন করে যে অংশ মুখস্ত করবেন সে অংশ থেকে পরদিন শুরু করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে নিজস্ব একটি হাফেজ্জী কুরআন শরীফ বা মুসহাফ। সাধারণ কুরআনের সাথে হাফেজ্জী কুরআনের পার্থক্য হলো, হাফেজ্জী কুরআনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় আয়াত শেষ হয়। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ১৫টি করে লাইন থাকে আর প্রতিটি পারায় পাতা থাকে ১০ টি করে অর্থাৎ ২০ টি পৃষ্ঠা। একজন হাফেজ আসলে এই পৃষ্ঠাগুলো আল্লাহ্‌ পাকের কুদরতে স্মৃতিতে ধারণ করেন। যারা আগ্রহী তারা মুবাইলের একটি এপ নামিয়ে নিতে পারেন। নিচের লিঙ্ক থেকে এপটি পেতে পারেন। আমার জানামতে এই এপটি সবচে ভালো। এখানে বিখ্যাত সব কারীদের তেলাওয়াত নামাতে পারবেন যাতে অফলাইন তেলাওয়াত শুনতে পারেন। যখন যে আয়াতটি তেলাওয়াত হয়, তখন সে আয়াতটি হাইলাইট হয়ে যায়। একটি আয়াত ইচ্ছে মতো বারবার শুনতে পারবেন। সব মিলিয়ে খুবই চমৎকার একটি এপ। https://play.google.com/store/apps/details?id=com.quran.labs.androidquran

আল্লাহ্‌ পাক আমাদেরকে কুরআন শেখার এবং স্মৃতিতে ধারণ করার তৌফিক দান করুন। আর যারা এ কঠিন কাজটি করেছেন সেসব কুরআনে হাফেজদেরকে সশ্রদ্ধ সাধুবাদ জানিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। জাজাকাল্লাহু খাইরান!

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *