সাহাবাগণ নক্ষত্রসম, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা [এক] – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

“আমার সাহাবাগণ নক্ষত্রসম, তাদের কারো অনুসরণ করলে তোমরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।”

সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন হলেন আকাশের নক্ষত্রের মতো। নক্ষত্র যেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলে রাতের আঁধারে সমুদ্রে ভেসে চলা নাবিককে পথে দেখায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের একেকজন সাহাবা ঠিক তেমনি। ফেতনার ডুবে যাওয়া উম্মতকে পথ দেখান তাঁরা। তাঁদের অনুসরণ ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। তাঁরা সত্যের মাপকাঠি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে তাঁদের যে কোনও উক্তি, কথা, মন্তব্য শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণীয়। সাহাবাগণ নিজেরাও তাঁদের তুলনায় মর্যাদা এবং জ্ঞানের দিক থেকে উচ্চতর সাহাবাগণের অনুসরণ করতেন। কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। এরপরও কুরআনের কোনও আয়াত বা কথা ভালোমতো হৃদয়ঙ্গম না হলে তাঁরা অন্য সাহাবাগণকে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। কুরআনের জ্ঞান সবার সমান ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ অপেক্ষাকৃত নতুন ঈমান আনা সাহাবাগণ পুরনো সাহাবাদের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। এ কারণে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মুফাসসির গণের রঈস বা প্রধান হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন। তবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের কথা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক প্রচার করার জন্য তিনি নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমরা আমার কথাগুলো অন্যের কাছে পৌঁছে দাও, হয়তো কেউ তোমাদের চেয়ে এর মর্যাদা বেশি অনুভব করবে এবং বুঝবে। ফলে হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবাদের মধ্যে সবার উপরে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। অথচ হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে অন্যান্য সাহাবাগণ ভালো বুঝতেন। আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সাহাবাগণের মধ্যে অন্যতম ফকীহ ছিলেন।

কুরআনে অবতীর্ণের জন্য আরবিতে দুটো শব্দ এসেছে। “আনযালনা” এবং “নাযযালা”। প্রথম শব্দটি “আনযালনা” দ্বারা লওহে মাহফুজ থেকে একসাথে কুরআন নাযিলের কথা বোঝানো হয়েছে। এবং পরের “নাযযালা” দিয়ে ধীরে ধীরে প্রয়োজন মতো নাযিলকে বোঝানো হয়েছে। ফলে যেসব সাহাবা ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের  সোহবত পেয়েছেন, তাঁরা রেসালাতের গভীর জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি রাসুলের দীদারের কারণে ইসলাম, কুরআন এবং সুন্নাহকে অধিক ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পেয়েছেন। তবে যিনি ঈমানের সাথে রাসুলকে একনযর দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনিই সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেছেন।

সাহাবাগণের ঈমান আনয়ন, ত্যাগ, জান ও মাল উৎসর্গ, রাসুলের প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর সাথে রক্ত সম্পর্কের কারণে সাহাবাগণের স্তর কুরআন এবং সুন্নাহ মতে প্রায় ১০টি ধাপে বিভক্ত। ধাপগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।

প্রথমঃ আহলে বাইত

আহলে বাইত আম হলেন হাশেমী বংশের লোকজন, আব্দুল মুত্তালিব গোত্রের ঈমান আনা লোকজন বিশেষ করে হযরত আব্বাস এবং হযরত আবু তালিবের সন্তানগণ এবং তাঁদের বংশধর। আহলে বাইত খাস হলেন একমাত্র মওলা আলী, ফাতেমা জাহরা, হাসান ও হুসাইন আলাইহিমুস সালাম ওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন। তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বেশ কিছু আয়াত নাযিল করেছেন। এর একটি হল তাঁদেরকে পবিত্র রাখার ওয়াদা। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ পাক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামকে রেসালাতের দায়িত্ব পালনের বিনিমিয়ে অন্য কিছু দাবি না করে আহলে বাইত ও নিকটাত্মীয়ের প্রতি উম্মতের ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা দাবি করতে বলেছেন।

আহলে বাইতের দুজন, হাসান ও হুসাইন, জান্নাতে যুবকদের সরদার। আর জান্নাতে সবাই যুবক হিসেবেই থাকবেন। এর মানে উনারা সমস্ত জান্নাতবাসির সরদার বা নেতা হবেন। তাঁদেরকে এবং তাঁদের দুজনের বাবা-মাকে ভালোবাসা মানে আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসা এবং তাঁদের এবং তাঁদের বাবা-মায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা জান্নাত লাভের গ্যারান্টি এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ জাহান্নামের ঠিকানা বলেও বেশ কিছু হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।

বিদায় হজ্বের এবং গাদিরে খুমের ভাষণে নবীজী দুটো জিনিস রেখে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন। একটি আল্লাহর কিতাব বা কুরআন আর অন্যটি আহলে বাইত। অন্য একটি মুরসাল বর্ণনায় আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর কথা বলা হলেও, আল্লাহর কিতাব ও আহলে বাইতের হাদিসটি মুতাওয়াতির হাদিস। মানে এ হাদিসটি এতো বেশি রাবি কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। সুন্নাহ বাদ দিয়ে আহলে বাইত বলার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহকে সঠিক ভাবে বুঝতে হলে আহলে বাইতের মাধ্যমেই বুঝতে হবে। তাঁদেরকে নুহ আলাইহিস সালামের কিস্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে। যে এতে আরোহণ করলো সে মুক্তি পেল, আর যে এতে আরোহণ করলো না সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। ফলে উম্মাহর একটি বড় অংশ আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ রাখা এবং তাঁদেরকে ছেড়ে দেবার কারণে দুনিয়াতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং আখেরাতেও এদেরকে হাউসে কাউসারের কিনার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। দিকে দিকে মুসলমানদের মার খাওয়ার এটিও একটি বড় কারণ।

আহলে বাইতের হাত থেকে মুসলিম খেলাফত হাতছাড়া হবার পর উমাইয়্যা এবং আব্বাসীয়রা নিজ নিজ প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস রচনা করেছে। ফলে সত্য থেকে সাধারণ মানুষ বিচ্যুত হয়ে দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছে। যা আজো বিদ্যমান। রাফেজী, খারেজী, শিয়া, নাসেবী মতবাদ অসংখ্য বাতিল ফেরকার কয়েকটি মাত্র।

দ্বিতীয়ঃ খোলাফায়ে রাশেদীন

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন তাঁর পর খেলাফত ত্রিশ বছর স্থায়ী হবে। আর এ ত্রিশ বছর ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ৬ মাস সহ পূর্ণ হয়ে যায়। এই পাঁচজন রাশেদ খলিফা কুরআন এবং সুন্নাহ অনুসারে খেলাফত পরিচালনা করেছেন। তাঁদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়নতা, পরহেজগারিতা প্রশ্নাতীত। তাঁদের ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের শান, মান ও মর্যাদা অন্য সাহাবাগণের তুলনায় আলাদা। তাঁরা হলেনঃ আবু বকর, উমর, উসমান, আলী মুর্তজা এবং হাসান মুর্তজা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম আজমাঈন।

তৃতীয়ঃ আশআরায় মুবাশশারা

দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবা। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই তাঁরা নিজেদের জান, মাল ও সম্পদ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জন্যে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ব্যতীত তাঁদের সবাই শাহাদাৎ লাভ করেন। তাঁরা হলেনঃ আবু বকর, উমর বিন খাত্তাব, উসমান বিন আফফান, আলী মুর্তজা ইবনে আবি তালিব, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, সাঈদ ইবনে যায়িদ, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম আজমাইন।

 চতুর্থঃ বদরী সাহাবা

বদর ছিল ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন সাহাবা যেভাবে জীবন বাজি রেখে ইসলামকে রক্ষা করেছেন সেজন্য আল্লাহ পাক তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের পূর্বের এবং পরের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। এ কারণে ইসলামে তাঁদের বিশেষ মর্যাদা। মক্কা বিজয়ের ঠিক পূর্বকালে এমন এক বদরী সাহাবী মক্কা অভিযানের আগাম খবর জানাতে এক মহিলার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের এক গোপন চিঠি দিয়েছিলেন। জিবরাঈল আ সে খবর রাসুলকে দিলে তিনি মওলা আলী রা কে পাঠিয়ে সে মহিলাকে ধরে নিয়ে আসেন। সে সাহাবার নাম জানার পর হযরত উমর রা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসুল তাকে ক্ষমা করে দেন এবং উমর রা কে বলেন, তুমি কি করে জানবে আল্লাহ তাঁদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছে কর, তোমাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত করে দিয়েছি [বুখারি: ৬৯৩৯]।

পঞ্চম ও ষষ্ঠঃ মুহাজির ও আনসার

যারা ইসলামের জন্য নিজেদের জান ও মাল বাজি রেখে মক্কা থেকে হিজরত করেছেন তাঁরা অন্য সাহাবাগণ থেকে উত্তম। আবার যারা মুহাজির সাহাবাগণকে নিজের ভাই মনে করে আশ্রয় দিয়েছেন, এমন কি যাদের একাধিক স্ত্রী ছিল, তাঁরা তাঁদের একজন স্ত্রী রেখে বাকিদের তালাক দিয়ে মুহাজির ভাইদের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরাও উত্তম অন্যদের চেয়ে। তাঁদেরকে আল্লাহ পাক বিশেষ মর্যাদা দিয়ে কুরআনে ঘোষণা করেন, “নিশয়ই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তওবা কবুল করেছেন [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৭]।

সপ্তমঃ হুদায়বিয়া

হুদায়বিয়ায় বাইআতে রিদওয়ানের সাহাবাগণের মর্যাদা অন্যান্য সাহাবাগণের মর্যাদার চেয়ে ভিন্ন। তাঁরা ছিলেন এক হাজার ৪ শতেরও বেশি। তাঁদের উদ্দেশ্য আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তাঁরা গাছের নিচে আপনার হাতে বাইআত গ্রহণ করেছিল [সূরা আল-ফাতহ: ১৮]।

অষ্টমঃ আকাবার শপথ

হিজরতের পটভূমিকা তৈরিতে মদিনা থেকে একদল লোক মক্কায় হজ করতে গেলে মিনার কাছে আকাবা নামক স্থানে তাঁরা নবীজীর হাতে ঈমান এনে যে শপথ করেন তা ইসলামে আকাবার শপথ হিসেবে পরিচিত। তাঁরা পরের বছর আরো কিছু লোক সহকারে আবারো আকাবা নামক স্থানে নবীজীর হাতে হাত রেখে মদিনা হিজরত করলে সাহাবাদের সব ধরণের সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ফলে সাহাবা হিসেবে এর পরে ঈমান আনা অন্যান্য সাহাবাদের চেয়ে তাঁদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

নবমঃ উহুদ ও খন্দকে অংশগ্রহণকারী সাহাবা

উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এতে যারা অংশ নিয়েছেন তাঁদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

বিঃ দ্রঃ পরের পর্বে মক্কা বিজয়ের সময় ও পরে ঈমান আনা সাহাবাদের নিয়ে আলোচনা হবে। যাদেরকে হাদিসে তুলাকা ও উতাকা সাহাবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাহাবাদের মধ্যে কার কি মর্যাদা না জানলে পুরো ইসলামকে বুঝতে জটিল মনে হবে। সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *