সাহাবাগণ নক্ষত্রসম, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা [তিন] – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
সাহাবাগণ নক্ষত্র সমতুল্য। নক্ষত্র দিশারি হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে নক্ষত্রেরও পতন হয়। নক্ষত্রের পতন হলে উল্কা কিংবা ধূমকেতু নয়, একেবারে ব্ল্যাকহোলে রুপান্তরিত হয়। তখন সেই নক্ষত্র রূপ নেয় ভয়ংকর কিছুতে। সবকিছুকে নিজের দিকে টেনে নেয়। অজানা লক্ষ্যে। সেখান থেকে ফিরে আসার আর পথ থাকে না। সাহাবাগণের মধ্যে মুনাফিকেরা হলো সেই পতিত নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোল। এ কারণে আল্লাহ পাক কুরআনে এতো বেশি বেশি করে মুনাফিকদের ভয়ংকর শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন।
কাফের আর মুসলমানের অবস্থান পরিষ্কার। কিন্তু মুসলমানরূপী মুনাফিকদের অবস্থান কখনোই পরিষ্কার নয়। এরাই ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। এরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামায আদায় করেছে, বাইরে সবার কাছে সাহাবা হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু এদের অন্তরের খবর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিকই জানতেন। আল্লাহ পাক বলেন,
“আর আপনার আশ-পাশের আরবে কিছু মুনাফেক রয়েছে এবং মদীনাবাসীদের ভেতর থেকে কিছু লোক কঠোর মুনাফেকীতে নিমগ্ন। আপনি তাদের [মনের অবস্থা] জানেন না; আমি জানি। আমি তাদেরকে আযাব দান করব দু’বার, তারপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে কঠিন আযাবের দিকে।” [সূরা আত-তওবা: ১০১]
কুরআনে সূরা মুমিন যেমন আছে, তেমনি সূরা মুনাফিকুনও আছে। তবে সূরা কাফেরুন একেবারেই ছোট। মাত্র ৬ট আয়াত। কারণ, কাফেরগুলো চিহ্নিত। সূরা মুনাফিকুনে ১১টি আয়াত। সূরা মুমিনুন-এ ১১৮টি আয়াত। অপরদিকে সূরা মুমিনে ৮৫ আয়াত। তবে পুরো কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মুনাফিকদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনা এসেছে। এই মুনাফিকদের কিছু ছিল চিহ্নিত মুনাফিক আর কিছু ছিল গুপ্ত মুনাফিক। আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সলুলের দলবল ছিল চিহ্নিত মুনাফিক। সামাজিক কারণে এদের সম্পর্কে জানার পরও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেন নি। উহুদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধে এই আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার অনুগত ৩০০ সৈন্য নিয়ে পিছু হটেছিল।
কুরআন এবং হাদিসের ভাষা থেকে বোঝা যায় চিহ্নিত মুনাফিকের চেয়ে গুপ্ত মুনাফিক কোনও অবস্থাতেই কম ছিল না। সাহাবাগণের মর্যাদা ও সম্মান পুরোপুরি বুঝতে হলে তাঁদের প্রকৃত অবস্থান বুঝতে হবে। পূর্বের দুটো পর্বে আমি সেদিকে আলোকপাত করেছি। সর্বস্ব ত্যাগ করা সাহাবাদের সাথে যেন সাধারণ ক্ষমা পাওয়া তুলাকা এবং শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া উতাকাদের মিশিয়ে না দেই। এই গুপ্ত মুনাফিকদের রুখতে হযরত উমর রাঃ ও একটি বিশেষ মুহূর্তে খেলাফতের দায়িত্ব যেন এমন সাহাবাদের কাছে না যায় সেজন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেনঃ
“إن هذا الأمر لا يصلح للطلقاء ولا لأبناء الطلقاء”. [كنز العمال للهندي: ج5، ص735، الطبقات الكبرى: ج3، ص248، أسد الغابة: ج4، ص387]
অর্থাৎ:- খেলাফত তুলাকা বা তাদের সন্তানদের জন্য বৈধ হবে না। [কানজুল উম্মাল ৫ম খণ্ড ৭৩৫ পৃষ্ঠা, তাবাকাতুল কুবরা ৩য় খণ্ড ২৪৮ পৃষ্ঠা।]
হযরত আয়েশা রাঃ এবং তাবেয়ী আসওয়াদ বিন ইয়াজীদও একই মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি বলেন, আমি আয়েশা রাঃ কে বললাম, তুলাকাদের এক লোক রসূলুল্লাহ ছঃ এর ছাহাবীদের সাথে খিলাফত নিয়ে যে ঝগড়া শুরু করছে, তাতে আপনি বিস্মিত হচ্ছেন না? তিনি (হযরত আয়েশা) বললেন, ‘এতে তোমার বিস্মিত হবার কি আছে? এতো আল্লাহর রাজত্ব/ক্ষমতা। তা তিনি ভালো ও খারাপ সবাইকে দান করেন। ফেরআউন তো মিসরবাসীর উপর চারশত বছর রাজত্ব করেছে। অনুরূপ অন্যান্য কাফিররাও।’ [সূত্রঃ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড- ০৮, পৃষ্টা- ১৩১]।
সহীহ মুসলিম এবং আবু দাউদ শরীফে উল্লেখিত ১২ জন সহ অন্যান মুনাফিকের পরিচয় কেবল দুজন সাহাবার মধ্যেই গোপন ছিল, হযরত হুজায়ফা রা এবং হযরত আম্মার রা। অন্য যেসব মুনাফিক সাহাবাগণের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রাখতো কারো কারো পরিচিয় বিশেষ ঘটনা পরিক্রমায় প্রকাশ হলেও এদের প্রায় সবার পরিচয়ই গোপন থেকে যায়। প্রকাশ পাওয়াদের মধ্যে আছে মক্কা বিজয়ের সময় ও এর পরে ঈমান আনা মারওয়ান বিন হাকাম আর তার পিতা হাকাম ইবনুল আস বিন উমাইয়্যা। দুজনই ঈমানের সাথে নবীজীকে দেখেছিল। তবে বেয়াদবির কারণে তাদের সাহাবিয়ত নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হাকাম বিভিন্ন সময়ে মদিনার বিভিন্ন গোপন বৈঠকে যোগ দিতো আর মুসলমানদের গোপন কথা শত্রুদের কাছে প্রকাশ করে দিতো। মাঝে মাঝে সে নিজেই নবীজীর কথা ও কণ্ঠস্বর নকল করতো। ধরা পড়ার পর তাকে পরিবারের সবার সাথে তায়েফে নির্বাসন দেয়া হয়। আর এই মারওয়ানের দুষ্টামির কারণেই খলিফা উসমান রা কে শহীদ হতে হয়। মুয়াবিয়া হযরতের রাজত্বকালে মদিনার গভর্নর হয় মারওয়ান এবং নবীজীর মিম্বরে বসে বসে মওলা আলী রা এবং আহলে বাইতের অন্যান্যদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো। দামেস্কে গালির প্রচলন চালু করেছিলেন রাজা মুয়াবিয়া আর মদিনায় তা বাস্তবায়ন করেছিল মারওয়ান [লাঃ নিচের লিঙ্ক থেকে দেখে নিন কীভাবে মওলা আলীর প্রতি গালিকে এরা সুন্নত বানিয়ে নিয়েছিল। সহীহ বুখারির বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারিতে ইমাম ইবনে হাযার আস্কালানী রহঃ সহ আহলে সুন্নাহর অন্যান্য ইমামগণের কিতাবের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন আল্লামা আইনুল হুদা সাহেব। https://www.facebook.com/Muhammad.Ainul.Huda.65/videos/1356592001133893/]।
গুপ্ত মুনাফিকদের আসল রূপ উন্মোচনের জন্যে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাইডলাইন দিয়ে গেছেন। তা হল মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তিনি পরিষ্কার ঘোষণা করেন, আলীর দুশমন (তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও তাঁকে গালিদাতা) হলো মুনাফিক। হাদীছটি হলোঃ
عَنْ زِرٍّ ، قَالَ: قَالَ عَلِيٌّ رضي الله عنه: “وَالَّذِي فَلَقَ الْحَبَّةَ وَبَرَأَ النَّسَمَةَ إِنَّهُ لَعَهْدُ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيَّ أَنْ لَا يُحِبَّنِي إِلَّا مُؤْمِنٌ وَلَا يُبْغِضَنِي إِلَّا مُنَافِقٌ”. أخرجه مسلم (1/86 ، رقم 78) ، والترمذى (5/643 ، رقم 3736) ، وقال: حسن صحيح. والنسائى (8/115 ، رقم 5018).
অর্থঃ তাবেয়ী জির বিন হুবাইশ বলেন, হযরত আলী -رضي الله عنه- বলেছেন, ‘সে মহান সত্ত্বার কসম, যিনি দানা উৎপন্ন করেছেন এবং সৃষ্টকূলকে সৃষ্টি করেছেন! আমার কাছে এটা অবশ্য রসূলুল্লাহ صلَّى الله عليه وسلَّم এর অঙ্গীকার যে, আমাকে মুমিন ছাড়া কেউ ভালোবাসবে না এবং মুনাফিক ছাড়া কেউ বুগজ/ঘৃণা করবে না।’ [ছহীহ মুসলিম (৭৮), সুনানে তিরমিযী (৩৭৩৬) ও সুনানে নাসায়ী (৫০১৮)]।
এরকম অগণিত হাদিস রয়েছে, গুপ্ত মুনাফিকদের স্বরূপ উন্মোচনে। নিচের হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মদিনাবাসী সাহাবাগণ কীভাবে মুনাফিক চিনতেন?
عن أبي سعيد الخدري -رضي الله عنه- ، قال: “إنَّا كنا لنعرف المنافقين نحن معشر الأنصار ببغضهم علي بن أبي طالب”. أخرجه الترمذي (رقم 3717).
অর্থঃ হযরত আবু সাঈদ -رضي الله عنه- থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা আনছারগণ মুনাফিক চিনতাম আলী বিন আবী তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি তাদের বুগজ/বিদ্বেষ দেখে।” [সুনানে তিরমিযী (৩৭১৭)]।
যে কথা দিয়ে এই দীর্ঘ লেখাটি শুরু করেছিলাম, তা হল সাহাবাগণ নক্ষত্রসম। একটি সত্য প্রকাশ করি, এই সত্যের মাধ্যমে যারা মুয়াবিয়া হযরতকে নক্ষত্র মনে করে অনুসরণ করাকে ওয়াজিব মনে করছেন তাদের মাথায় একটি ফাটা বাঁশ আছড়ে পড়বে। এই বহুল প্রচলিত হাদিসটি দুর্বল সনদে বর্ণিত। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ তাঁর জামি আস-সাগিরে [৪৬০৩] এই হাদিসটি উল্লেখ করে একে দুর্বল সনদের বর্ণিত বলে রায় দিয়েছেন। এই হাদিসের একজন রাবি জা’ফর বিন আব্দুল ওয়াহিদ আল-হাশিমীকে ইমাম ইবনে হাজার আস্কালানী রহঃ মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আস্কালানী রহঃ এই হাদিসকে মুনকার বা নিন্দনীয় এবং খুবই দুর্বল বলে রায় দিয়েছেন। [ইবনে হাজার আস্কালানী: তালখিস আল-হাবির – ২০৯৮]।
এবার বাস্তবতায় আসুন। আপনি চাইলে এই লেখার শুরুতে বর্ণিত মশহুর, জীবন, সম্পদ, সব ত্যাগ করা সাহাবাগণের অনুসরণ করতে পারেন। আবার চাইলে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ভেসে বেড়ানো, গণিমতের সম্পদ ইচ্ছে মতো ব্যয় করা, হারাম বস্তু (যেমন সিল্ক, সোনা, হিংস্র পশুর চামড়া) ব্যবহারকারী, অন্যায় ভাবে হত্যা ও অন্যায় ভাবে অন্যের সম্পদ দখলকারীদের অনুসরণ করতে পারেন। [সহীহ মুসলিম ৪৬৭০-(৪৬/১৮৪৪), ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৬২৪, ইসলামিক সেন্টার ৪৬২৫]। আবার চাইলে আহলে বাইতের অনুসরণ করতে পারেন। কুরআন ও হাদিসের আলোকে আহলে বাইতকে অনুসরণ করলে আপনি নিরাপদ। তুলাকা বা উতাকাদের অনুসরণ করলে সব সময় যে সত্যের উপর স্থির থাকতে পারবেন এর গ্যারান্টি নেই। কেননা, মিথ্যা হাদিস বর্ণনায় উনাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মওলা আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন আলাইহিমুস সালাম ওয়া রাদ্বিয়ালাহু আনহুম গণের বর্ণিত হাদিস পাবেন হাতেগোনা কয়েকটি। মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই আহলে বাইতকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে এরা কষ্ট দিয়েছে। তাতেই থেমে না থেকে এরা আহলে বাইতের বর্ণিত সকল হাদিস গায়েব করে দেবার প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছিল। অল্প কিছু মুহাদ্দিস নিজেদের জীবন বাজি রেখে সেখান থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ হাদিস হেফাজত করতে পেরেছেন। অথচ উনাদের বর্ণিত হাদিস থাকার কথা লক্ষাধিক। জামানার মুজাদ্দিদ প্রোফেসর ডঃ তাহিরুল কাদরী (মাজিআ) মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রায় ৪০ হাজার হাদিস সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো তাহকিক সহ খুব শিগ্রই প্রকাশ হবে ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সত্য জানার ও সত্যের সাথে থাকার তৌফিক দান করুন। ইসলাম ঠুনকো কোনও ধর্ম নয় যে সত্য জানলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। শিয়া জুজুর ভয় দেখিয়া আমাদেরকে সত্য থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তবে সত্য কখনো চাপা থাকে না। “সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত। নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভূত হবারই [বনী ইসরাঈল: ১৭:৮১]।