নবী-ওলিদের মাজার ধ্বংস করা আল্লাহর সাথে যুদ্ধের শামিল

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী (https://www.facebook.com/DrMiaji)
الحمدلله رب العالمين والصلاة والسلام على سيدنا محمد رسوله الكريم
ওহাবী নজদি সালাফী নামধারীরা একের পর এক নবী-ওলিদের মাজার ধ্বংস করে উৎসব করে যাচ্ছে। সম্প্রতি তারা ইরাকের মাসুল শহরে হযরত ইউনুস আঃ এর মাজার বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। আগে থেকে জানান দিয়ে তারা ওই অপকর্মটি করে এবং এর ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেয়। তা দেখে আমাদের দেশের কিছু মুর্খ মুখে “আলহামদুলিল্লাহ্‌!” বলে স্বস্তি প্রকাশ করে। আর মনে করে ইরাকের সালাফি সন্ত্রাসীরা অনেক ভাল কাজ করেছে। সময় ও সুযোগ পেলে তারাও বাংলাদেশে অবস্থিত আল্লাহর ওলিদের মাজারসমূহ এভাবে ধ্বংস করবে বলে আস্ফালন করে। তাদেরকে এই লিখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে চিন্তা করার অনুরোধ করবো। কেবল ওহাবী, সালাফী, আহলে হাদিস নামধারীদের অন্ধ অনুস্মরণ না করে প্রকৃত সত্য অনুধাবনের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। 

ওলিদের কবরের উপর মসজিদ
আল্লাহ তাঁর ওলিদের কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকে পবিত্র কুরআনে অতি সম্মানের সাথে উল্লেখ করেছেন। আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীদের ঘটনা আমরা সবাই জানি। তাঁরা কোন নবী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন ঈসা আঃ এর কয়েকজন (প্রায় ৭ জন যুবক) উম্মত। আল্লাহর উপর তাদের ছিল পরিপূর্ণ ঈমান ও তাকওয়া। ঈমান রক্ষার্থে তাঁরা একটি গুহায় আশ্রয় নেন। আর তাঁদের দেহাবশেষ ধারণ করে যে গুহাটি রয়েছে সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ। দেখুন আল্লাহ কীভাবে সে কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেনঃ
“এমনিভাবে আমি তাদের (আসহাবে কাহাফ=গুহাবাসীদের) খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বললঃ তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর। তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা (ঈমানদারগণ) বললঃ আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে মসজিদ নির্মান করব।” (১৮:২১)

নবীগণ কবরে জীবিত এবং রিযিকপ্রাপ্ত
ইউনুস আঃ ছিলেন পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ২৫ জন শ্রেষ্ঠ নবী (আঃ) দের একজন। তাঁর ঘটনা কুরআনে অতি গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। আর সহীহ হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, নবীদের দেহ মাটি ভক্ষন করে না। নবীগণ কবরে জীবিত এবং তাঁরা রিজিক প্রাপ্ত। তাঁরা সেখানে নামাজ পড়েন।
আউস বিন আউস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,

“তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম দিন শুক্রবার। এদিনেই আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, এদিনেই সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, এদিনেই কিয়ামত হবে। কাজেই এই দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে দরূদ পাঠ করবে, কারণ তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হবে”। সাহাবীগন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, “আপনি তো (কবরের মাটিতে) বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, কিভাবে তখন আমাদের সালাত আপনার নিকট পেশ করা হবে?” তিনি বললেনঃ “মহান আল্লাহ মাটির জন্য নিষিদ্ধ করেছেন নবীদের দেহ ভক্ষন করা”। (সুনানে নাসাঈ ৩/৯১, নং ১৩৭৪)

অন্য রেওয়াতে আছেঃ “আল্লাহ্‌ তায়ালা মাটির জন্য নবীদের শরীর ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন। নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) জীবিত। তাঁদের কাছে রিযিক পাঠানো হয়।”
(সুনানে নাসাঈ, জুমা অধ্যায়, ১:২০৪, সুনানে আবু দাউদ, সালাত অধ্যায়, ১:১৫৭, সুনানে ইবনে মাজাহ, জানাযা অধ্যায়, ১১৯)

কাজেই ইউনুস আলাইহিস সালামও তাঁর কবরে জীবিত এবং নামাজরত। আর সেই পবিত্র মাজার এবং মাজার সংলগ্ন মসজিদটি বোমা মেরে ধ্বংস করে সালাফী জংগীরা ইউনুস আঃ এর সাথে বেয়াদবি করেছে। আর আল্লাহ বলেছেন, যে তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাথে বেয়াদবি করে, আল্লাহ নিজে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আমরা সেই যুদ্ধের অপেক্ষায় আছি।

ধ্বংস নয়, অতীতের নিদর্শন সংরক্ষণ করা জরুরী
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বারবার উল্লেখ করেছেন যে তিনি অতীতের অনেক ঘটনা এবং নিদর্শন আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছেন যাতে আমরা তা দেখে অনুধাবন করতে পারি আল্লাহ অতীতের নাফরমানদের সাথে কেমন আচরণ করেছিলেন। আর যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা তাঁদের সাথেই বা কেমন আচরণ করেছিলেন। কিন্তু এখন সালাফী নামধারী ইসলাম ধ্বংসকারীরা তার উল্টোটা করে যাচ্ছে। তারা ইহুদী-খৃষ্টানদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের নিমিত্তে একের পর এক অতীতের মহামূল্যবান নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে যাচ্ছে।
অথচ দেখুন আল্লাহ পাক কালামে পাকে আমাদেরকে ভ্রমণ করে এসব স্থানগুলো দেখতে এবং এর থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন। দেখুন কিছু আয়াতঃ
“আপনার পূর্বে আমি যতজনকে রসূল করে পাঠিয়েছি, তারা সবাই পুরুষই ছিল জনপদবাসীদের মধ্য থেকে। আমি তাঁদের কাছে ওহী প্রেরণ করতাম। তারা কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে না, যাতে দেখে নিত কিরূপ পরিণতি হয়েছে তাদের যারা পূর্বে ছিল? সংযমকারীদের জন্যে পরকালের আবাসই উত্তম। তারা কি এখনও বোঝে না?” (১২:১০৯)
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যারোপকারীদের কিরূপ পরিণতি হয়েছে।” (১৬:৩৬)
“তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী।” (৩:১৩৭-২৮)
“বলে দিনঃ তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতপর দেখ, মিথ্যারোপ কারীদের পরিণাম কি হয়েছে?” (৬:১১)
“অতএব আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।” (১০:৯২)

এভাবে অনেক আয়াত রয়েছে পুরাতন নিদির্শনের ব্যাপারে (দেখুনঃ ২২:৪৫-৪৬, ২৭:২৯ ও ৬৯, ২৯:২০, ৩০:৯-১০, ৩৫:৪৪, ৪০:২১-২২ ও ৮২, ৪৭:১০-১১ এবং ৬৭:১৫)। সেসব যদি ধ্বংস করে ফেলা হয়, তাহলে আল্লাহর উদ্দেশ্যকে বিনষ্ট করা হয়, নাউজবিল্লাহ। হয়তো এরপরও কেউ কেউ যুক্তি দিবেন, আল্লাহ পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির নিদর্শন দেখতে বলেছেন। নবীদের কবরকে দেখতে বলেন নি। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলব, আল্লাহ কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির নিদর্শন অনুসন্ধান করে দেখে তার থেকে শিক্ষা নিতে বলেন নি। বরং নবী-রাসুল (আঃ) গণের অতীত স্মৃতি থেকেও আমাদের শিক্ষা নিতে বলেছেন। আর কোন কোন নবী রাসুলগনের স্মৃতি আমাদের জন্য ভ্রমণ করা ও জিয়ারত করা ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
“যখন আমি কা’বা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে (মাকামে ইব্রাহীম) নামাযের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।” (২:১২৫)
আর সাফা ও মারওয়ার সায়ীকে আল্লাহ হজ ও উমরাহ্‌ পালনকারীর জন্য বাধ্যতামূলক করে দেন। তিনি বলেনঃ “নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই।” (২:১৫৮)
আর হজের প্রধান অংশই তো হল হযরত আদম এবং মা হাওয়া আলাইহুমাসসালামের স্মৃতিধন্য আরাফার ময়দানে সমবেত হওয়া।

উল্লেখ্য যে হাদিসটির উপর আমল করতে গিয়ে ওহাবী, সালাফী, নজদিরা একের পর এক মাজার, ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংস করে যাচ্ছে সে হাদিসের উপর অন্য একটি পোস্টে আলোচনা করেছি। সে হাদিসটি অসম্পূর্ণ যার পূর্ণ হাদিসটি সহীহ মুসলিম এবং সহীহ বুখারিতে রয়েছে। আর মুশরিকদের কবর ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কোন মুমিন বান্দার কবর নয়। আর নবী-রাসুল বা ওলিদের কবর তো নয়ই। যদি তাই হতো তাহলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কবর একরকম হতো না। আর ওহাবী, সালাফী নামধারী নজদিদের ভাঙার জন্য কোন কবর অবশিষ্টও থাকতো না। লিংকটি নিচে দেখুনঃ
https://www.facebook.com/DrMiaji/photos/pb.1420687501498059.-2207520000.1406499721./1511343162432492/?type=3&theater

আসুন আমরা ইসলামকে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করি। ধ্বংস ইসলাম সমর্থন করে না। মহানবী (দঃ) ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে কিছু ধ্বংস করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। এমনকি খৃষ্টান-ইহুদীদের ধর্মীয় স্থাপনা এবং অতীতের নবীদের স্মৃতি। আজ যারা ইসলামকে পরিশুদ্ধির কথা বলে, শিরক আর বিদাত মুক্ত করার কথা বলে একে একে ইসলামের সব নিদর্শন, ঐতিহ্য, স্থাপনা ধ্বংস করে চলেছে তারা আসলে ইসলামের ভাল চায়না। তারা নবী-ওলিদের দুশমন। তারা ইসলামের দুশমন। এমন এক সময় আসবে যখন ইসলামকে সঠিকভাবে জানার সব নিদর্শন মুছে ফেলা হবে। মিথ্যা দিয়ে বই-পুস্তক ভরে ফেলা হবে। তখন কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা নির্ধারন করা কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে যেমন আহলে হাদিস, সালাফী, লা-মাজহাবীদের মিথ্যার কাছে সাধারণ মুসলমানগণ দিশেহারা, সামনে আরও কঠিন দিন অপেক্ষে করছে। কাজেই কারো অন্ধ অনুস্মরণ না করে আসুন কুরআন, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াসের আলোকে নিজের বিবেক দিয়ে সত্যকে জানি এবং সে অনুযায়ী আমল করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুণ। আমীন

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment