মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আমাদের মত মানুষ ছিলেন?

================


ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী
——–
بسم الله الرحمن الرحيم
اللهم صلى على سيدنا محمد وعلى آل سيدنا محمد وبارك وسلم
কিছু নাদান মুর্খ সূরা কাহফ ও সূরা হা-মীম সেজদাহর (আয়াত ৬) একটি আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই মানুষ, নাউজুবিল্লাহ! দুই সুরার দুইটি আয়াত প্রায় একই রকম, অল্প কিছু শব্দের ব্যবধান মান্ত্র।

‘হে আমার হাবিব, আপনি (বিনয় ও নম্রতার সাথে) ঘোষণা করে দিন, “আমি (আকৃতিতে) তোমাদের মতই মানুষ, কিন্তু আমার কাছে ওহী আসে যে তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ”‘ (সূরা কাহফ ১১০)।

শানে নুজুলঃ
উক্ত আয়াতের শানে নুজুলের দিকে খেয়াল করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে কেন আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনটি বলতে বলেছিলেন। আরবের কাফের মুশরিকরা নবী (সা) এবং কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্য করত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সে কথার উল্লেখ করে বলেনঃ

“আর এ অত্যাচারী ও কাফির লোকসকল গোপনে পরামর্শ করে, সে তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। এমতাবস্থায় দেখে শুনে তোমরা তার যাদুর কবলে কেন পড়?” (২১:৩)।

উপরন্তু তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করত। আরবের কাফের-মুশরিকগণ এভাবে আগের দিনের অনেক ঘটনা কিংবা অন্যান্য নবী-রাসুলদের কাহিনী জানতে চাইতো। তারা মনে করত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। তখন আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপরোক্ত আয়াত নাজিল করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা যদি আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করে থাক তবে এই কুরআনের মত আরেকটি কুরআন এনে দেখাও। তোমরা জুলকারনাইন ও গুহাবাসীদের ঘটনা জানতে চেয়েছ আমি তা বর্ণনা করেছি (বেদায়া নেহায়া)।

অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত মানুষ ছিলেন না বোঝাতেই উপরোক্ত আয়াত নাজিল হয়েছে। ‘হে আমার হাবিব, আপনি (বিনয় ও নম্রতার সাথে) ঘোষণা করে দিন, “আমি (আকৃতিতে) তোমাদের মতই মানুষ, কিন্তু আমার কাছে ওহী আসে যে তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ”‘। অর্থাৎ আরবের কাফের-মুশরিকগণ যে বলাবলি করছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মতই মানুষ। আসলে তিনি দেখতে তাদের মতই মানুষ ছিলেন। কিন্তু তারা যেন ভুলে না যায় যে তাঁর কাছে ওহী আসে। আয়াতের শেষ অংশই প্রমাণ করে তিনি আমাদের মত মানুষ ছিলেন না। আল্লাহ তাঁকে মানব আকৃতি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মাত্র।

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই মানুষ” এ ধরণের কথা কেবল বর্তমানে কিছু নবী-দুশমন কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ের কাফের-মুশরিকগণই বলত না। পূর্ববর্তী নবীদের আমলে তাঁদের দুশমনরাও একই ভাবে পূর্ববর্তী নবীদেরকে (আঃ) তাদের মতই মানুষ মনে করতো। কিছু উদাহরণ দেখুনঃ

হজরত নুহ (আঃ) সম্পর্কে “অতঃপর তার জাতির যারা কাফির সর্দার ছিল, তারা বলল, আমরা আপনাকে তো আমাদের মতোই একজন মানুষ দেখছি।” (১১:২৭)
সালিহ (আ) সম্পর্কেঃ “আর তুমিতো আমাদের মতো একজন মানুষ।” (২৬:১৫৪)
শু’আইব (আ) সম্পর্কেঃ “আপনিতো আমাদের মতোই একজন মানুষ।” (২৬:১৮৬)

হুদ (আঃ) সম্পর্কেঃ “তাঁর সম্প্রদায়ের প্রধানরা যারা কাফের ছিল, পরকালের সাক্ষাতকে মিথ্যা বলত এবং যাদেরকে আমি পার্থিব জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিলাম, তারা বললঃ এতো আমাদের মতই একজন মানুষ বৈ নয়। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায় এবং তোমরা যা পান কর, সেও তাই পান করে।” (২৩:৩৩)

বর্তমান কালে হুদ (আঃ) সেই পথভ্রষ্ট জালিম লোকদের মত আমাদের সমাজে ওহাবী, দেওবান্দি, সালফী, জামাতী, আহলে হাদেস, লা-মাজহাবী পন্থীরা বলে বেড়ায় যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই মানুষ। তাদের যুক্তি হল ঠিক উপরোক্ত আয়াতের মতই, আমরা খাই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খেতেন। আমরা ঘুমাই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ঘুমাতেন। জাহেলরা ভুলে যায় যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমালেও তাঁর অজু নষ্ট হতো না। দেখুন পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, “যদি তোমরা তোমাদের মতই একজন মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা নিশ্চিতরূপেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (২৩:৩৪) অর্থাৎ নবীগণ (আঃ) দেখতে আমাদের মত হলেও তাঁরা মোটেই আমাদের মত ছিলেন না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘাম থেকে মেশক আম্বরের ঘ্রাণ আসত। আর আমাদের? আমি আপনি কি শাফিউল মুজনেবিন? ইমামুল মুরসালিন? রাহমাতুল্লিল আলামিন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেঁটে গেলে এক খণ্ড মেঘ তাঁকে ছায়া দিয়ে রাখত যা খৃস্টান পাদ্রী বাহিরা দেখতে পেয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের পাশ দিয়ে গেলে কবরে আজাব হচ্ছে কিনা দেখতে পেতেন। আপনি আমি কি দেখতে পাই? তিনি জিব্রাইল (আ) কে দেখতেন, অন্য কেউ দেখত না। রাসুলের হাতের বরকতে বকরি দুগ্ধবতী হয়। তাঁর হাতের আঙ্গুল দিয়ে পানির ফোয়ারা বের হয়। আমাদের আঙ্গুল দিয়ে বের হবে? গর্ভকালীন সময়ে মা আমেনা কোন ওজন অনুভব করতেন না। তিনি তন্দ্রাবস্থায় দেখতে পেলেন একটি নূর তাঁর পেট থেকে বের হয়ে সিরিয়া আর পারস্যের প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করে ফেলেছে। তিনি ছিলেন নূর। তাঁর ওজনও ছিল না, ছায়া ও ছিল না। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র) তাঁর তাফসীরে লিখেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত ‘সুরতে’ মানুষ ছিলেন। তার নূরানী দেহে মানবের আবরণ ছিল মাত্র। কুরআন এখানে মেসাল অর্থাৎ উপমা দিয়েছে। অনেক কবি বলে থাকেন, ‘নদীও নারীর মত’। নারী আর নদী এক বস্তু একথা কেউ বিশ্বাস করবে কোন মুর্খ ছাড়া? সালাফিদের মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত ছিলেন না এই ব্যাপারটা বুঝাতে আল্লাহ দেখুন কেমন কড়া ভাষায় মানুষদেরকে সতর্ক করেছেনঃ

“মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।” (49:2)

যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের মত মানুষ মনে করে তাদের বেয়াদবীর কারণে তাদের আমল বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারা টেরও পায়নি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক ঈমান ও আক্বীদা উপর রাখুন। আমীন!

সৌজন্যেঃ ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *