ইহুদী-খৃষ্টানদের বলির পাঁঠা কারা?

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

বলির পাঁঠা প্রয়োজন। স্রষ্টাকে খুশি করতে সনাতনধর্মীরা পাঁঠা বলি দেয়। আদিকালে অসভ্য সমাজে তাদের কথিত দেবতাকে খুশি করতে মানুষও বলি দিতো। এখনো দেয় কিছু মানুষ, তবে অন্য মোড়কে। কে হবে বলির পাঁঠা? কাউকে না কাউকে তো বলির পাঁঠা হতেই হয়। সনাতন পন্থীদের পূজায়ই যে কেবল বলির পাঁঠার প্রয়োজন হয়, তা নয়। অসংখ্য কাজে বলির পাঁঠা প্রয়োজন হয়। না-জায়েজ কাজ জায়েজ করতে বলির পাঁঠা প্রয়োজন হয়। সরাসরি যখন কাউকে ঘায়েল করা কঠিন হয় তখন প্রতিপক্ষকে বলির পাঁঠা সাজাতে পারলে সহজে স্বার্থ সিদ্ধি হয়। সমগ্র বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ইহুদী এবং খৃষ্টানদের বলির পাঁঠার প্রয়োজন। কে হবে বলির পাঁঠা? জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ, ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে থাকা দিশেহারা মুসলমানেরাই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত বলির পাঁঠা। যে ভাবা সেই কাজ।

আধুনিক বলির পাঁঠার নতুন নতুন নাম ও রূপ রয়েছে। তার একটি হলো “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”। কথা সুন্দর, তবে এর উদ্দেশ্য সুন্দর নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে আগে সন্ত্রাস খুঁজে পেতে হবে। সন্ত্রাস না থাকলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে। সন্ত্রাস না থাকলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে কীভাবে? আল্লাহ্‌ নিজেও আদম [আ.] কে সৃষ্টির সাথে সাথে ফেরেশতাদের শিক্ষক আজাজিলকে শয়তান ও অভিশপ্ত ঘোষণা দেন। যাতে ভালোর পাশাপাশি খারাপের অবস্থান থাকে। যুদ্ধ যাতে জমে উঠে। নতুন এই ইনসান জাতি যদি কেবল ভালো কাজই করবে তাহলে স্রষ্টার উদ্দেশ্যই বৃথা। তাই তিনি শক্তিশালী এক শত্রু তৈরি করলেন। যে বিশেষ শক্তিধর শয়তান মানুষের প্রতিটি লোমকূপে প্রবেশ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সাথে সাথে আল্লাহ্‌ পাক তাকে আদম সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় ও প্রকাশ্য শত্রু বলেও ঘোষণা করে দিলেন। ঠিক দুনিয়ার শক্তিধর জাতি – ইহুদী ও নাসারারা কল্পিত শত্রু তৈরি করে এর বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার খেলায় নামে। সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ভাঙার পর এদের তেমন কোনও প্রকাশ্য শত্রু ছিল না।

শত্রুর অভাবে এদের অনেক প্রোজেক্ট ব্যর্থ হতে শুরু করলো। তাই এরা অনেক গবেষণা করে মুসলমানদেরকে প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে আবিষ্কার করলো। মাথামোটা আরব জাতিকে এদের সাথে পেয়েও গেল। এদেরকে দিয়ে নাটকের সুন্দর স্ক্রিপ্ট তৈরি করে ইহুদী-খৃষ্টান চক্র। তা হলো শত্রু শত্রু খেলা। সন্ত্রাস তৈরি করা, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং নিজেরাই মূর্খ কিছু মুসলমানের মগজধোলাই দিয়ে কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা। এরা খুব কৌশলে ট্রেনিং দিলো আল-কায়েদাকে। আফগানিস্তানে তৈরি করলো তালিবান গোষ্ঠী (রাশিয়াকে ট্যাকল দেবার জন্য)। আফ্রিকায় নামিয়ে দিল বুকো হারাম। সিরিয়ার আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বানালো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সম্পদশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস। এদেরকে আবার সিরিয়াতে দায়েশ হিসেবেও মানুষ জানে। এদের সবার আক্বীদা এবং ধর্মীয় আদর্শ একই জায়গায় গিয়ে মিলেছে। তা হলো সৌদি ওহাবীবাদ। যা আবার পশ্চিমাদেরই আবিষ্কার এবং তাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যাপী প্রসার ও প্রতিষ্ঠা। আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব আইএসের বিরুদ্ধে “টম এ্যন্ড জেরি” খেলা খেলতে লাগলো। টম জেরিকে হাতের কাছে পেয়েও শেষ করে না। শেষ করলেই খেলা খতম। তাই কৌশলে জিইয়ে রাখছিল। এখন সে মিশন খতম, তাই খেলও খতম। অনেক শহর ও জনপদ ধ্বংসের বিনিময়ে আইএস এখন ইতিহাস।  

তবে কিছু মুসলমানের এ সত্যটা বুঝতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। এখন মুসলমানদের সব দল ও গোষ্ঠী, ওহাবী-সালাফী এবং গোঁড়া দলগুলো একবাক্যে আইএস ও দায়েশকে সন্ত্রাসী মনে করে। যা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম। বরং উল্টো এসব দলকে আমাদের দেশেরও কিছু দল ও গোষ্ঠী সত্যিকারের মুজাহিদ হিসেবে বছরের পর বছর প্রমোট করে আসছিল। আমাদেরকেই বরং উল্টো এরা মুশরিক বলে ফতোয়া দিয়ে আসছিল। সে সত্য এখন খোদ সৌদি রাজের মুখ থেকে বের হলো। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে আইএস তাদের সৃষ্টি। আফসোস, মাথামোটা মুসলমানেরা তা অনেক কষ্টে মেনে নিয়েছে।

সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীই। তার না আছে কোনো রঙ, না আছে জাত আর না আছে ধর্ম। সে যে ভাষায় কথা বলে তা ঘৃণিত। ঘৃণ্য এ কর্মের জন্য মানুষ তার ধর্মকে দোষারোপ করে। তাকে জাত তুলে গালি দেয়। তার গায়ের রঙ দেখে। অথচ ইসলাম আজ থেকে ১৪শ বছর পূর্বেই মানুষের গায়ের রঙ, ধর্ম কিংবা জাত দেখে তাকে পরিমাপ করতে নিষেধ করেছে। মানুষ তার কর্ম দ্বারাই পরিচিতি পায়। বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলে আরাবী [ﷺ] ঘোষণা করেন, ‘যদি কোনো কালো দাসও তোমাদের নেতা হয় তাকে মান্য করো’। কিন্তু দুখের বিষয়, আজ কোনো মুসলমান কোনও অঘটন ঘটালে তার ধর্মকে মানুষ দোষারোপ করে। তার জাত তুলে গালি দেয়। তার গায়ে লেবেল লাগানো হয়, সে হয় ইসলামী সন্ত্রাসী, ইসলামী মৌলবাদী কিংবা মুসলিম জংগী।

অপরদিকে কোনও অমুসলিম এর চেয়েও শতগুণ জঘন্য কিছু ঘটালে নিউজের হেডলাইন হয়, বন্দুকধারী, উন্মাদ, মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা মানসিক রোগী। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে জুমায় অংশ নেয়া নিরীহ-নিরস্ত্র মুসুল্লিদের উপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং কয়েক বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া নরওয়ে ৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনা এর প্রমাণ। এ দুটো হত্যার পেছনে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ এবং মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা কাজ করলেও, কেউ ওইসব খৃষ্টান সন্ত্রাসীদের ধর্ম বা জাত নিয়ে কোনও কথা বলে না। তাদের পরিচয় হয় কেবল মানুষ হিসেবে। তাদেরকে উন্মাদ কিংবা বন্দুকধারী হিসেবে দেখা হয়। এই কৌশলটি ইহুদী আর খৃষ্টানদের আবিষ্কার।

ইহুদী এবং খৃষ্টান কুচক্রীমহল বেশ কয়েক দশক ধরে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে মুসলমানদের সন্ত্রাসী বানানোর বিভিন্ন কলা-কৌশল উদ্ভাবন করতে থাকে। তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারে ব্যস্ত। জিহাদের নামে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তৈরি এবং ইসলামের নাম নিয়ে বিভিন্ন অমুসলিম দেশে হামলা। যার বেশির ভাগ ভিকটিম আবার মুসলমান। মুসলমানদের মধ্য থেকে একদল লোক তারা পেয়েও যায়। যারা গোঁড়া। আগেপিছে কিছুই ভাবার প্রয়োজন মনে করে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাও তারা জানে না। স্থান-কাল-পাত্র বলতে তাদের কোনও জ্ঞান নেই। যা করবে বলে ভাবে তা করেই ছাড়ে। তারা আবার চরম মূর্খও। নিজেদের মুসলমান দাবী করলেও তারা আসলে ইসলাম সম্পর্কে বেখবর। এ দলটি চিন্তাশক্তিহীন। কিছু একটা করার পূর্বে কিছুই ভাবে না। প্রোপাগান্ডা এবং উড়ো কথায় কান দেয়া মানুষ তারা। ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদী যতোগুলো দল আছে, এর সবগুলোই ইহুদী এবং খৃষ্টানদের আবিষ্কার। হয় তারা এর পেছনে অর্থ ঢেলেছে, না হয় এদেরকে ট্রেনিং দিয়েছে। আর না হয় কিছু ব্রেইনওয়াশড নেতাকে এরা কাজে লাগিয়েছে। আল-কায়েদা, তালেবান, বুকো হারাম, আইএস এসবই তাদের ফসল। যার মূল ওহাবীবাদ। সৌদি প্রোডাক্ট কিন্তু পশ্চিমাদের আবিষ্কার।

কাজেই মুসলমানদের আগে নিজেদের কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। তাদেরকে সব ধরণের গোঁড়ামি পরিহার করতে হবে। জ্ঞান ও বিজ্ঞানে মনোযোগ দিতে হবে। উদারপন্থী সূফীবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্মান্ধতা পরিহার করতে হবে। ঘৃণার পরিবর্তে ঘৃণা না ছড়িয়ে ধৈর্য্য আর সহনশীলতা দিয়ে কৌশলে এগুতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন মধ্যপ্রাচ্যের ঘুমিয়ে থাকা আরব ক্ষমতালোভী নেতাদের ঘুম থেকে জেগে উঠা। ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা পশ্চিমাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। তাদের স্বার্থে তারা ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের লেবেলে আবদ্ধ করতেও দ্বিধা করেনি। এসবই ইসলামে পরিত্যাজ্য। মুসলমানদের জেগে উঠা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। হে আল্লাহ্‌! আমাদেরকে জেগে উঠার জন্য এ যুগে একজন সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী প্রেরণ করুন। আমীন ইয়া রাব্ব!

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *