কর্দোবা জামে মসজিদ আমাদের

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

সাহরীর ঠিক পরপর কাফেলার দ্বিতীয় পর্ব দেখছিলাম। এবারের কাফেলা যেন কাফেলা নয়, চির বিষাদ আর দুঃখ মিশ্রিত স্পেনের মুসলমানদের করুন পরিণতি আর শোকগাথায় ভরা। আমাদের দীনি ভাই মাওলানা আহমাদ রেজা ফারুকী সেই কষ্ট এবং বিধুর-বিভোর পরিস্থিতির একটি বাস্তব চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। মাওলানা আহমাদ রেজা এবং আল্লামা বদরী রহঃ এর সুযোগ্য সাহেবজাদা ইমরান বিন বদরী ভাইজানকে ওই মসজিদে প্রবেশ করার সময় সিকিউরিটি গার্ড স্পষ্ট করেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যেন সেই মসজিদের ভেতরে নামাজ বা অন্য কোন ইসলামী রীতি পালনের চেষ্টা করা না হয়। কতো দুঃখের এবং অপমানের সে হুঁশিয়ারি!

এবারের রমজানে কাফেলা নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। এবার ইউরোপে মুসলমানদের শান ও শওকতের চিত্রের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। কাফেলার প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্ব দেখেই মনটা মুচড়ে উঠলো। যে স্পেন এক সময় মুসলমানেরা ৭ শ বছর ধরে শাসন করেছে, সে স্পেন এখন খৃষ্টানদের। কর্দোবার যে জামে মসজিদে ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত সব স্কলার, মুহাদ্দিস, মুফাসসীর, পণ্ডিত ও বোদ্ধা ব্যক্তিবর্গ কুরআন, সুন্নাহ আর ফিকহের দরস দিতেন, সে মসজিদ আজ অমুসলিমদের দখলে। শুধু তা-ই নয়, সে মসজিদকে তারা রুপান্তর করেছে গির্জায়। যে একত্ববাদের ধ্বনি তুলে সেখানে মাথা উঁচু করে মহান রবের শান ও শওকতের সাথে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হতো, সেখানে আজ শিরকের ধ্বজা যিশু খৃষ্টের মূর্তি শোভা পাচ্ছে। মুসলমানদের মসজিদে, মুসলমানরাই আজ টিকেট কেটে প্রবেশ করে। সেখানে নামাজ সহ যে সব ধরণের ইসলামী রীতি পালন করা সম্পূর্ণ নিষেধ। 

এ কথাগুলো শুনে কষ্টে মনটা ভরে গেল। তাই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্পেন তথা আন্দালুসিয়ার কর্দোবা মসজিদের উদ্দেশ্যে আজকের ফজরের নামাযে পূর্ণ সূরা ইয়াসীন পাঠ করলাম। কণ্ঠ বারবার আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। সূরা ইয়াসীনে আল্লাহ্‌ পাক দুনিয়ার তাগুত আর অত্যাচারিদের বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়ে চূড়ান্ত দিন তথা কিয়ামতের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। সেদিন কাফের সম্প্রদায় সহ অত্যাচারি লোকেরা দিশেহারা হয়ে লুটিয়ে পড়বে আর বলবে, রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) যে হুঁশিয়ার বাণী দিয়েছিলেন, তা সত্য। এ আয়াতে কিয়ামত সংঘটিত হবার পর স্তব্ধতার কথা বলা হয়েছে, তাই এই আয়াত পাঠের সময় স্বর রুদ্ধ রেখে কিছুক্ষণের জন্য থামতে হয় [আয়াত ৫২]। এটাকে “সাকতা” বলা হয়। তাছাড়া সূরা ইয়াসীনের শেষের আয়াতগুলো খবই গুরুত্ব বহন করে। আল্লাহ্‌ পাক ওই আয়াতে নিজের ক্ষমতা, শান এবং চিরস্থায়ী সমুন্নতের কথা জোর দিয়ে বলে দুনিয়ার তাগুত আর অত্যাচারিদের হুঁশিয়ার বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সুতরাং পবিত্রতা তাঁরই, যাঁর হাতে প্রত্যেক কিছুর ক্ষমতা রয়েছে এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।”

১৯৩০ কিংবা ৩১ সালের দিকে ইসলামী রেনেসাঁর মহাকবি আল্লামা ইকবাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিশেষ অনুমতি নিয়ে কর্দোবা জামে মসজিদের মিম্বরে আজান দিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করেছিলেন। সেখানে বসে তিনি যে প্রার্থনা করেছিলেন, সে প্রার্থনাই একেকটি কবিতা হয়ে আজো বেঁচে আছে। ২০১১ সালের দিকে অষ্ট্রিয়ার কিছু মুসলিম যুবক কর্দোবা জামে মসজিদ সফরে গিয়ে কাতারবদ্ধ হয়ে নামায আদায় করতে থাকলে সেখানে উপস্থিত সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে তাদের বাকবিতণ্ডা এবং হাতাহাতি হয়। এতে কিছু ছাত্র এবং গার্ড আহত হয়। এর পর থেকেই সেখানে প্রবেশরত কোন মুসলমান দেখলেই সিকিউরিটি গার্ড সতর্ক করে দেয় যাতে সেখানে নিয়ে কেউ নামাজ আদায় করার চেষ্টা না করে।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো সে মসজিদের ভেতরের দেয়ালে দেয়ালে একসময় কুরআনের আয়াত ক্যালিগ্রাফি আকারে আঁকা ছিল, তাগুত খৃষ্টান সম্প্রদায় সেগুলো মুছে দিয়ে কিছু মাত্র আয়াত রেখে দিয়েছে। আর ঠিক এর বরাবর তাগুত ফারদিন্যান্দের মমি করা নাপাক মৃতদেহের পাগুলো রেখে দিয়ে আল্লাহ্‌র কুরআনকে অপমান করা হয়েছে। আল্লাম ইকবাল রহঃ একবার শির উচ্চ করে ঘোষণা করেছিলান,

চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তান হ্যায় হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম, সারা জাহান ওয়াত্বান হ্যায় হামারা।

মানে, চীন আমাদের, আরব আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের। আমরা মুসলিম, সমগ্র বিশ্ব আমাদের মাতৃভূমি। আজ এই মহান কবি বেঁচে নেই। তাঁর কাব্য বেঁচে আছে। কিন্তু কাব্যের সে সুউচ্চ ঘোষণা নেই। বরং এখন উল্টো বলতে হয়, চীন আমাদের নেই, আরবও আমাদের নেই, সেখানে আছে তাগুতি কিছু দুনিয়ালোভী শেখ। যারা ক্ষমতার লোভে তাগুতি ইহুদী এবং খৃষ্টানদের আজ্ঞাবহ হয়ে যত্ত সব অনৈসলামিক কাজ করে যাচ্ছে। আর হিন্দুস্তানও আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই। এখন বাকি ভূমি হারানোর পথে। আল্লাহ্‌ পাক আমাদের মুসলমানিত্ব ফিরিয়ে দিক। আমরা আবার ইসলামী সেই রেনেসাঁয় জেগে উঠি এবং সগর্বে ঘোষণা করি, এ বিশ্ব এক আল্লাহ্‌র এবং এখানে আল্লাহ্‌ একত্ববাদই সমুজ্জ্বল থাকবে।

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *