খাদ্য গ্রহণের সাথে মানুষের পাশবিকতার সম্পর্ক থাকতে পারে!
ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী
===========
আমাদের চারপাশে আমরা কেবল পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিক আচরণ, নির্দয়তা লক্ষ্য করছি। একটি কচি শিশু যখন তার ছোট্ট নরোম হাত দিয়ে অত্যাচার ঠেকানোর নিষ্ফল চেষ্টা করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলে আত্ম চিৎকারে চারদিক ভারী করে তোলে, কিছু মানুষ তখন উল্লাস করে উঠে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। নির্মম অত্যাচারে একজন কিশোর যখন “পানি পানি” বলে অস্ফুট শক্তিহীন আকুতি জানায়, কিছু মানুষ তখন সেই মৃতপ্রায় কিশোরকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে আনন্দ লাভ করে। একজন অসহায় কিশোরকে যখন বিনা অপরাধে মলদ্বার দিয়ে গাড়ির চাকার পাম্পের নল প্রবেশ করিয়ে অতি শক্তিশালী পাম্প মেশিন চালু করে তার নাড়ীভুঁড়ি, ফুসফুস ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তখনো কোন মা তাতে সায় দিয়ে চুপ থাকে। একজন নারীকে যখন মিথ্যা ছেলেধরা অপবাদ দিয়ে কিছু লোক খোলা স্থানে পিটিয়ে উলংগ করে মেরে ফেলে, তখনো কিছু মানুষ তা দেখে আত্ম তৃপ্তি লাভ করে।
আমরা সবাই জানি, উপরের ঘটনাগুলো কোন কল্পকাহিনী নয়। এগুলো বাস্তব এবং অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। এসব আমাদের সমাজে এখন অহরহ ঘটে চলেছে। ঘটনা ঘটার পর আমরা সচেতন হয়ে উঠি, মিছিল করি, এর বিচার দাবি করি। তারপর একসময় তা ভুলেও যাই। কিন্তু ঘটনা থেমে থাকে না। তা চলতেই থাকে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি এসব নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতার পিছনে কি কি কারণ থাকতে পারে? অপরাধ বিজ্ঞান আমার বিষয় নয়। আমার বিষয় হলো ইসলাম, সমসাময়িক ধর্ম, ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান, দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বিধান অনুসারে নারীর অধিকার ও মর্যাদা।
অন্যান্য বিষয়গুলোও আমাকে ভাবিয়ে তোলে। অনেক কারণের মধ্যে অস্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণও একটি কারণ থাকতে পারে। ভেবে দেখলাম আমাদের খাদ্য গ্রহণের সাথে আমাদের আচরণ ও স্বভাবের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। কয়েক বছর আগে ইউরোপব্যাপি “পাগলা গরুর রোগ” (Mad Cow Disease) নামে একটি রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। তা এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল যে বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থাকে বিশেষ এলার্ট জারি করতে হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে আমরা লক্ষ্য করলাম “শুয়োর ভাইরাস” (Swine-flu) নামের একটি রোগ। তবে এটি কেবল শুয়োর ভক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটিও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিলো। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে আরেকটি রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছিলো আর তা ছিল “বার্ড ফ্লো” অর্থাৎ পাখির মাধ্যমে যে ভাইরাস ছড়ায়। উপরে বর্ণিত সবগুলো রোগের পিছনেই কারণ ছিল স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিবর্তে অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছু গবেষক গরু, হাঁসমুরগি এবং শুয়োরকে কৃত্রিম এবং অস্বাভাবিক কিছু খাবার খাইয়ে অতি সহজে মোটাতাজা করার উপায় বের করার ফল। আর সেই বিশেষ খাদ্য এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো যে তা মানব দেহের জন্য মারাত্মক জীবননাশা রোগ সৃষ্টি করেছিলো। এগুলো মানব সভ্যতার উন্নতির নামে মানব সভ্যতার বিশাল পরাজয় হিসেবে পরিগণিত হয়।
আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখি আমরা প্রতিনিয়ত, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষ স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের চেয়ে কৃত্রিম খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমাদের এসব কৃত্রিম খাদ্যে রয়েছে মারাত্মক সব উপাদান। ফরমালিনের ব্যবহারের পাশাপাশি আমরা আমাদের গবাদি পশু, পুকুরের মাছ, খামারের হাঁসমুরগি – এসবকে যে খাবার দিয়ে থাকি, তা কৃত্রিম এবং ভয়ংকর। যেমন মাছের খাবার হিসেবে দিয়ে থাকি গবাদি পশুর চামড়ার উচ্ছিষ্ট, হাড়, পশম ইত্যাদি। গরু ও ছাগলকে অতি অল্প সময়ে এবং সহজ উপায়ে মোটাতাজা করতে গিয়ে আমরা এদের দিয়ে থাকি মদ, হরমোন পরিবর্তনীয় কিছু মেডিসিন, অতি চর্বিযুক্ত খাবার যা তাদের উপযোগী নয়। খামারের হাঁসমুরগিকে দিয়ে থাকি আরো আরো ভয়ংকর সব খাবার যা তাদের তো উপযোগী নয়ই বরং মারাত্মক ক্ষতিকারক। আর এসবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় আমাদের আচরণ এবং স্বভাবে। কেননা আমরা যে ধরণের খাদ্য গ্রহণ করে থাকি, আমাদের মানসিক বহিঃপ্রকাশ ও সে ধরণের হতে বাধ্য।
আর এ কারণে ইসলামে হিংস্র প্রাণী ভক্ষণ হারাম করা হয়েছে। কেননা হিংস্র প্রাণী গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের আচরণ ও স্বভাবে সেই হিংস্র প্রাণীর স্বভাব বিস্তার লাভ করতে পারে। ইসলাম যা দিয়েছে তার প্রতিটি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভবের ফলে। কাজেই আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, আমরা কি কি খাবার গ্রহণ করবো এবং কি কি খাবার পরিহার করবো। পুষ্টিবিদ এবং রসায়নবিদদের এ নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের যেমন করণীয় রয়েছে, নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতিটি মানুষের সতেনতা এবং সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। ধন্যবাদ!