নৃত্যরত মৌমাছি

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

মৌমাছির নৃত্য দেখেছেন কখনো? এক ফুল থেকে আরেক ফুলে নেচে নেচে যাওয়া? কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মৌমাছির নৃত্য নিয়ে লিখেছেন, “মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।’ “ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে দাঁড়াবার সময় তো নাই।'” ঠিকই ধরেছেন, মৌমাছির মতো ছোট্ট প্রাণীটির অলসভাবে দাঁড়াবার একেবারেই সময় নেই। মৌমাছির নৃত্য এবং এই ছোট্ট প্রাণীটি সম্পর্কে আপনাদের আজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবো। শুনলে অবাক না হয়ে পারবেন না। এই ছোট্ট প্রাণীটি নিয়ে গবেষণা করে ১৯৭৩ সালে অস্ট্রিয়ার এক বিজ্ঞানি চিকিৎসায় নোবেল পেয়েছেন। শুনলে আরো অবাক হবেন যে আজ থেকে ১৪শ বছর পূর্বেই আল্লাহ পাক কুরআন এবং তাঁর প্রিয় হাবীব (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াছাল্লামা) এর মাধ্যমে আমাদের যেসব তথ্য জানিয়েছেন, সেসব তথ্যের অতি সামান্য একটি তথ্য মৌমাছির জীবন এবং মধুর উপর গবেষণা করেছেন এ বিজ্ঞানি। নাম তার কার্ল ভন ফ্রিচ। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম “নৃত্যরত মৌমাছি”, Dancing bees. মৌমাছি কীভাবে জীবন যাপন করে, কীভাবে এরা সংঘবদ্ধ থাকে, কীভাবে মধু সংগ্রহ করে আর এই মধু আমাদের জীবনে কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করে আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে তা তিনি খুঁজে বের করেছেন। তবে এসব তথ্য আমাদের মুসলমানদের জন্য অনেক পুরনো। মুসলমান মাত্রই এসব তথ্য কুরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে বহু আগে থেকেই জানে। আর মুসলিম অনেক বিজ্ঞানি এবং কবি মৌমাছির জীবন ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে অনেক আগেই অনেক বই লিখেছেন। কিন্তু হায়, আমরা মুসলমানেরা আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ এবং জ্ঞানের আধার খুঁজি অমুসলিমদের কাছে। অথচ নিজেদের ভাণ্ডারে যে বিশাল জ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে সেদিকে লক্ষ্যও করি না।

ছোট্ট এই প্রাণীটিকে আমরা ভয় পাই। ভয় পাই তার বিষাক্ত হুলের কারণে। ছোটবেলা তিল ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাবার সময় শখ করে এই মৌমাছির হুল নিয়ে খেলতাম। মধু সংগ্রহ করতে এই প্রাণীটি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়ায়। তিলের ফুলে ঢুকে মধু সংগ্রহ করার মূহুর্তে মৌমাছি সহ তিলের ফুলটি চেপে ধরলে মৌমাছি যেতেও পারে না, ফুলও ফোটাতে পারে না। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে পশ্চাতদেশ ঘুরিয়ে হুল ফোটানোর। কিন্তু পারে না। তিল গাছের নরম ডগায় চেপে ধরলে অনায়াসেই নিজের হুল ফুটিয়ে দেয়। এতে করে সে তার অতি প্রয়োজনীয় হুলটি হারায়। আমরাও তা দেখে মজা পেতাম। ছোটবেলা এমন অসংখ্য অমানবিক কাজ করতাম যা এখন ভাবলে লজ্জা হয়। আফসোসও হয় অনেক। অকারণে কতো প্র্রাণীকে কষ্ট দিতাম। আল্লাহ তুমি ক্ষমা করে দিও।

মৌমাছি আমাদের তত প্রিয় না হলেও মৌমাছির সংগৃহীত মধু আমাদের অনেকেরই প্রিয়। এর সংগ্রহ করা মধু অনেক রোগের মহৌষধ। মহৌষধ আসলে দুটি। কুরআন এবং মধু। যেসব রোগের নিরাময় বিজ্ঞান এখনো আবিষ্কার করতে পারে নি, সেসব রোগের জন্য মধু অলৌকিক কাজে দেয়। এমন কি ক্যান্সার কিংবা এইডস-এর মতো রোগে মধুর ব্যবহারে পেতে পারেন অকল্পনীয় ফলাফল। আর সে ফলাফলের কথা আল্লাহ পাক কীভাবে বলেছেন তা একটু দেখুনঃ “তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার।” [সূরা নাহলঃ ১৬:৬৯]। মধু বিভিন্ন রঙের হবার কারণ হলো মৌমাছি বিভিন্ন ধরণের ফুলের নির্যাস থেকে সংগ্রহ করে থাকে। আপনি জেনে আরো অবাক হবেন যে আল্লাহ পাক সেই ১৪শ বছর পূর্বেই আমাদের জন্য এক গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন যে মৌমাছির ঝাঁকের নেতৃত্বে থাকে একটি রাণী মৌমাছি। আল্লাহ পাক একই সূরার ৬৮ এবং ৬৯ নং আয়াতে উল্লেখ করেন, “আপনার পালনকর্তা মধু মক্ষিকাকে আদেশ দিলেনঃ পর্বতগাত্রে, বৃক্ষ এবং উঁচু চালে গৃহ নির্মাণ কর। এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও।”

মাওলানা রুমি রহঃ মসনবী শরীফে লিখেছেন, মৌমাছি ফুলের নির্যাস নিয়ে ফিরে যাবার সময় রাসূল (দরূদ) এর উপর দরূদ পাঠ করতে থাকে। আর এই দরূদের বরকতে বিভিন্ন ফুলের নির্যাস থেকে সংগ্রহ করা মধু এতো সুমিষ্ট হয়। সম্ভবত মাওলানা রুমি কিংবা উমর খৈয়াম মৌমাছির উপর বিস্তারিত কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন, কীভাবে এরা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। মৌমাছি মূলতঃ তিনটি দলে বিভক্ত থাকে। এদের নেতৃত্বে থাকে একটি মেয়ে মৌমাছি যাকে রাণী হিসেবে আমরা চিনি। একদল পুরুষ থাকে যারা প্রজননে সাহায্য করে এবং শেষ দলটি থাকে যারা শ্রমিক হিসেবে সারাক্ষণ কাজে লেগে থাকে। ছোটবেলায় সে প্রবন্ধে পড়েছিলাম মধুকে পবিত্র এবং ত্রুটিমুক্ত রাখতে সেসব শ্রমিকেদের একদল থাকে মধু নিয়ে ফেরার পর সেসব মধুর মান নির্ণয়ে। বিজ্ঞান আজ মধুর রহস্য খুঁজে পেয়েছে। মৌমাছির থাকে দুটো করে পাকস্থলী। একটিতে নিজে বাঁচার জন্য খাদ্য গ্রহণ করে আর অন্যটিতে মধু আরোহণ করে রাখে। এসময় ফুলের নির্যাসে মৌমাছির পেটে থাকা এক ধরণের এনজাইম মিশে তাকে মধুতে রূপান্তরিত করে। মাছিগুলো মৌচাকে ফিরে বিশেষ একটি নল দিয়ে সে মধু মোমের তৈরি বাসায় জমা করে। সে মধুই আমরা সংগ্রহ করে থাকি।   

মধু হচ্ছে  ওষুধ এবং খাদ্য উভয়ই। মধুকে বলা হয়- বিররে এলাহি ও তিব্বে নাবী। অর্থাৎ খোদায়ী চিকিৎসা ও নবী করীম (দরূদ)- এর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। সূরা মুহাম্মদ- এর ১৫ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে- “জান্নাতে স্বচ্ছ মধুর নহর প্রবাহিত হবে।” রাসূলুল্লাহ (দরূদ)- এর কাছে কোন এক সাহাবি তার ভাইয়ের অসুখের বিবরণ দিলে তিনি তাকে মধু পান করানোর পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় দিনে এসেও আবার সাহাবি বললেন- অসুখ পূর্ববৎ বহাল রয়েছে। তিনি আবারো একই পরামর্শ দিলেন। তৃতীয় দিনেও যখন সংবাদ এল যে, অসুখের কোন পার্থক্য হয়নি, তখন রাসূলুল্লাহ (দরূদ) বললেন- আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। উদ্দেশ্য এই যে, ওষুধের কোনো দোষ নেই। রোগীর বিশেষ মেজাজের কারণে ওষুধ দ্রুত কাজ করেনি। এর পর রোগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে।

মধুর নিরাময় শক্তি বিরাট ও স্বতন্ত্র ধরণের। হজরত ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার শরীরে ফোঁড়া বের হলেও তিনি তাতে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন- আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কি বলেননি যে, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। -(কুরতুবী, তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন)। হাদিস শরিফে মধু সম্পর্কে প্রচুর রেওয়ায়েত আছে। রাসূলে কারীম (দরূদ)- এর মতে সকল পানীয় উপাদানের মধ্যে মধু সর্বোৎকৃষ্ঠ। তিনি বলেন- মধু এবং কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের চিকিৎসা নেয়া উচিত। -[সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৪৫২, হাকেম]

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন যে, “রাসূলুল্লাহ (দরূদ) বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রত্যেক মাসে তিন দিন ভোরে মধু চেটে খায় তার কোন বড় বিপদ হতে পারে না।” -[ইবনে মাজাহঃ ৩৪৫০, বায়হাকী]

রাসূলুল্লাহ (দরূদ) স্বয়ং সকাল বেলা খালি পেটে মধুর শরবত পান করতেন। যারা নিয়মিতভাবে মধুর শরবত পান করতে না পারবে তাদের জন্য তিনি বলেন- “যে ব্যক্তি মাসে তিন দিন সকাল বেলা মধু চেটে সেবন করবে, ওই মাসে তার কোন কঠিন রোগব্যাধি হবে না”। রাসূলুল্লাহ (দরূদ) বলেছেন- “যে কেহ আরোগ্য কামনা করে, তার ভোরের নাশতা হিসাবে পানি মিশ্রিত মধু পান করা উচিত”।

রাসূলুল্লাহ (দরূদ) আরো বলেছেন- আল্লাহর শপথ যে ঘরে মধু আছে অবশ্যই ফেরেস্তারা সে ঘরের অধিবাসীদের মাগফেরাত কামনা করেন। কোন ব্যক্তি যদি মধুপান করে তবে যেন তার পেটে লক্ষ ওষুধ স্থির হলো এবং পেট হতে লক্ষ রোগ বের হয়ে গেল। আর যদি সে পেটে মধু ধারণ অবস্থায় মারা যায় তবে তাকে দোজখের আগুন স্পর্শ করে না। -(নেয়ামুল কোরআন)

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে হুজুর পাক (দরূদ) বলেছেন, তোমরা দুটি সেফা দানকারী বস্তুকে নিজেদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে নাও। একটি মধু অপরটি কুরআন। -(মিশকাত)

মধু জানা ও অজানা অসংখ্য রোগের প্রতিষেধক। কারণ, মধু রোগব্যাধি শেফা দানে এক অব্যর্থ মহৌষধ। আর  কোরআন দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার গ্যারান্টি। এ দুটির দ্বারা বহু শতাব্দী ধরে মানুষ অশেষ উপকৃত হয়ে আসছে। আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পাক (দরূদ) মধু খেতে বড়ই ভালো বাসতেন। মধুতে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ নামক দুই ধরনের সুগার থাকে। অবশ্য সুক্রোজ ও মালটোজও খুব অল্প পরিমাণে আছে। মধু নির্ভেজাল খাদ্য। এর শর্করার ঘনত্ব এত বেশি যে, এর মধ্যে কোনো জীবাণু ১ ঘণ্টার বেশি সময় বাঁচতে পারে না। এতে ভিটামিন এ, বি, সি প্রচুর পরিমাণ বিদ্যমান। অনেক প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানও আছে। যেমন- এনজাইম বা উৎসেচক, খনিজ পদার্থ (যথা পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ), এছাড়াও প্রোটিন আছে। মধুতে কোনো কোলস্টেরল নেই। সুস্থ অসুস্থ যে কেউ মধু খেতে পারেন। সুস্থ মানুষ দিনে দু’চা-চামচ মধু অনায়াসে খেতে পারেন। বেশি খেতে চাইলে শর্করা জাতীয় খাদ্য ভাত, রুটি, আলু কমিয়ে খেতে হবে। অন্যথা মোটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে পরিমিত পরিমাণ খেলে মোটা হওয়ার ভয় নেই। হজমের গোলমাল, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস প্রভৃতিরোগে আধা চা-চামচ এর বেশি মধু না খাওয়াই ভালো। পোড়া, ক্ষত ও সংক্রমণের জায়গায় মধু লাগালে দ্রুত সেরে যায়। আল্লাহতায়ালা মধুর ভিতরে প্রচুর কর্মশক্তি রেখেছেন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment