মসজিদে নববীতে (ﷺ) ইফতারের প্রবর্তন

ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী

রমজান এবং রমজানের বাইরে পবিত্র মসজিদে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইফতারের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের ইচ্ছে মত সেখানে ইফতারি সাজিয়ে রাখেন আর রোজাদাররা নিজেদের দায়িত্বে বসে পড়েন ইফতার করার জন্য। ইফতারির আইটেমে খেজুর বা খুরমা অবশ্যই থাকবে। আর থাকবে জমজমের পানির ব্যবস্থা।কিন্তু জানেন কি এ ব্যবস্থা কে চালু করেছিলেন? কারবালার ভয়াবহ নৃশংসতায় নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবারের ৭২ সদস্য শহীদ হবার পর একমাত্র পুরুষ সদস্য যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি হলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি (৬৫৭-৭১৩ খৃঃ)। যার অপর নাম আলী বিনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইমাম হুসেনের আদরের সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদীন রহঃ। কারবালার প্রান্তর থেকে বেঁচে যাওয়া আহলে বায়েতের এই মহান ব্যক্তি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মদিনায় ফিরে আসেন। আল্লাহর রহমতে তিনি লাভ করেন সম্পদের অঢেল ভাণ্ডার। সে ধন-ঐশ্বর্য থেকে তিনি অকাতরে গরীব দুঃখীদের জন্যে দান করতেন। কিন্তু মদিনার কেউ তা জানতোনা। তাঁর ইন্তিকালের পর যখন দান-খয়রাত বন্ধ হয়ে গেল তখন মদিনার লোকজন বুঝতে পারল এ গোপনদানশীল আর কেউ নন তিনি ইমাম জয়নুল আবাদীন রহঃ।

তিনিই প্রথম রমজান মাসে মসজিদে নববী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে ইফতারের আয়োজন করেন। ইফতার সামনে নিয়ে তিনি অঝোর নয়নে কেঁদে কেঁদে দু’গাল ভাসিয়ে দাড়ি ভাসিয়ে দিতেন। এতো চমৎকার আর হরেক রকমের ফল-ফালদি খাবার দাবারের সমন্বয়ে ইফতার দেখে তাঁর মনে পড়ে যেতো রাসুলে করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ক্ষুধায় পেটে পাথর বাঁধার কথা। কত কষ্টই না করেছেন আমাদের প্রিয় নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে। ধনাঢ্য স্ত্রী মা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার অঢেল সম্পদ নিজের করতলে পেয়েও তিনি তা অকাতরে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

কুরাইশরা মুসলমান ও বনী হাশেমকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন ও একঘরে করে রাখার এক চুক্তিনামা লিখে কাবা শরিফের অভ্যন্তরে ঝুলিয়ে দেয়। চুক্তি অনুসারে তাদের সাথে বেচা- কেনা, বিয়ে শাদি, সাহায্য সহযোগিতা, ও লেন-দেন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। এ চুক্তির ফলে আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে বাধ্য হয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে শিয়াবে আবু তালিব নামক গিরি সংকটে আশ্রয় নেন। আবু লাহাব ছাড়া বানু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সকল সদস্যই মুহাম্মাদ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গী হন।

তাঁরা অবর্ণনীয় ক্লেশ ও দুঃখের শিকার হন সেখানে। ক্ষুধা ও অর্ধাহারের বিষাক্ত ছোবল থেকে কেউ রক্ষা পাননি। স্বচ্ছল ও সামর্থবান ব্যক্তিরা নিজেদের সমস্ত ধন-সম্পদ ব্যয় করে ফেলেন। খাদীজা তাঁর সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করেন। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের পাতা ও ছাল খেতে হয়েছে তাঁদের। শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করতে হয়েছে। পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হয়েছে। বিভিন্ন রোগ ছাড়িয়ে পড়েছে। অধিকাংশ লোকই মৃত্যূর প্রায়-দ্বার প্রান্তে এসে দাড়ালেও তাঁরা ধৈর্য ও অবিচলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনও পশ্চাদপদ হননি। অবরোধ একাধারে তিন বছর স্থায়ী ছিল। রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইলমে গায়েব প্রকাশ দিয়ে বললেন যে তাদের চুক্তিনামা ক্বাবা ঘরে উই পোকা খেয়ে ফেলেছে কেবল আল্লাহর নাম ছাড়া। বাস্তবে কুরাইশ নেতারা তা দেখতে পেয়ে আবরোধ তুলে নেয়। এসময়েই রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষুধায় পেটে পাথর বেধেছিলেন। আর সেকথা মনে করে ইমাম জয়নুল আবেদীন রহঃ ইফতার সামনে নিয়ে কাঁদতেন।

আহলে হাদিস, লা-মাজহাবী, সালাফী নামধারী ব্যক্তি বর্গ সব কিছুতেই বিদাত আর শিরক খুঁজতে খুঁজতে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই তাদের করা হয়ে উঠে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে এ প্রথা ছিল না, বলা যায় এটাও একটা বিদাত বা নব-আবিষ্কৃত। সব বিদাত যদি আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়, যেমনটি ওই লা-মাজহাবী ওহাবীরা আমাদেরকে সারাক্ষণ শুনিয়ে থাকে, তাহলে তো এই ইফতার আয়োজনকারীদের রক্ষা নেই। রোজাদারকে ইফতার করিয়ে ও তারা জাহান্নামী হবে। যেমন গতকালের মাসজিদুল হারামে সম্মিলিত মুনাজাতের ভিডিওতে অনেকেই ফতুয়া দিয়েছেন যে সম্মিলিত মুনাজাত বিদাত। আর তাদের মতে বিদাত মানেই যা জাহান্নামে নিয়ে যায়। আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেও জাহান্নামে যেতে হবে। হিন্দুদের মত অন্য ধর্মের কাউকে স্পর্শ করলেই জাত চলে যাবে। কাজেই সাবধান! আল্লাহ সকল মুসলমানকে এসব ফেতনার হাত থেকে রক্ষা করুণ, আমীন!

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *