শোকাহত আগস্টঃ আব্দুর রহমানের মতো দেশপ্রেম চাই

ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

আব্দুর রহমানের কথা মনে আছে? আফগানিস্তানের আব্দুর রহমান। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখিত “ওয়াতানাম” গল্পের আব্দুর রহমান। ওয়াতানাম মানে হলো দেশপ্রেম, মাতৃভূমি, নিজের ভূমি। আমাদের মাছেভাতে বাঙালীর দেশপ্রেম নয়। জোয়ারভাটার দেশপ্রেম আমাদের। এই আছে, এই নেই। ঢাকা শহরের সিগন্যালের মতো, এই আছে, এই নেই। তাও আবার সে সিগন্যাল কেউ মানে না। আমাদের দেশপ্রেমও সেরকম। কাগজেকলমে আছে, বাস্তবে নেই। আর আমাদের দেশপ্রেম নির্দিষ্ট কিছু দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি।

সৈয়দ মুজতবা আলী সবেমাত্র আফগানিস্তান গিয়েছেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল তিনি ওখানে অবস্থান করেছেন। এই দুবছর তিনি ওই দেশের শিক্ষা দফতরে অধ্যাপনা করেছেন। আফগানিস্তান তখন অন্যরকম ছিল। এখনকার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ ছিল না। আফগানিস্তান ছিল একটি সুখী সমৃদ্ধ শান্তির দেশ। সে সময়ে লেখকের দেখাশোনার জন্য আব্দুর রহমান নামে এক আফগানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই আব্দুর রহমান সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিজ দেশের গল্প শোনাচ্ছিলেন। বরফে নিচে ঢাকা সব। চারিদিকে সাদা শুভ্র তুষার। অনতিদূরে পাহাড়। বলা যায় উঁচুনিচু পাহাড়ের সমাহারে যেন আফগানিস্তান বেষ্টিত। আমাদের মতো চির সবুজ সেখানে অকল্পনীয়। আব্দুর রহমান কোনও দিন আমাদের সবুজ দেখেন নি। তিনি জন্মের পর থেকেই কাবুলের পাহাড় আর শীতে তুষারপাত দেখেছেন। তুষারে যখন সব ঢাকা পড়ে যায়, তখন নাকি আব্দুর রহমানেরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন। বুকের ছাতি তখন ছ’ইঞ্চি ফুলে উঠে। নির্মল পরিষ্কার বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার যে আনন্দ তা আব্দুর রহমানদের আছে। আমাদের নেই। নিঃশ্বাস ছাড়ার সাথে সাথে নাকি তাদের ভেতর থেকে সব রোগজীবাণু বের হয়ে যায়।

লেখক অবাক হয়েছেন এমন খটখটে মরুর দেশের প্রশংসা শুনে। গাছাপালা যেখানে কমই নজরে পড়ে, শীতে আবার যা তুষারে ঢেকে থাকে। এমন একটি দেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আব্দুর রহমানের চোখেমুখে সুখ এবং গর্বের অভিব্যক্তি লেখককেও সংক্রমিত করেছিল।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি অতীব সুন্দর একটি ভূমি। এতো নদীনালা পৃথিবীর কোথাও নেই। ঋতুর এমন বৈচিত্রও কোনও দেশে নেই। বলা যায় আমাদের দেশ হলো নাতিশীতোষ্ণ, মানে যেখানে না খুব শীত, না খুব গরম। তবে এখন এ চিত্র অনেক পাল্টে গেছে। এখন শীতও পড়ে সেরকম আর গরমেও মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এটা হল প্রকৃতি নিয়ে আমাদের অবহেলার শাস্তি।

যেমন বলছিলাম মাছেভাতে বাঙালির দেশপ্রেম জোয়ারভাটার মতো বাড়ে আবার কমে। যিনি দেশের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, একটি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বজ্রকন্ঠে যিনি পাকিস্তানী হায়েনাদের সমগ্র অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে চিৎকার দিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সে জাতির জনককে সপরিবারে আমরা দিনের আলো ফোটার পূর্বেই শেষ করে দিলাম। বঙ্গবন্ধু যার উপাধি। যার কথায় কোটি বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যার কথায় জীবন দিতে রাজাকার ছাড়া সবাই প্রস্তুত ছিলেন, জাতির সেই জনক এবং শ্রেষ্ঠ সন্তানকেই আমরা নির্দয়ভাবে বুলেটের আঘাতে জর্জরিত করি। কি অন্যায় ছিল ছোট ছোট শিশু এবং ঘরের মহিলাদের? ভুল করলে বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। দেশকে ভালোবেসে হয়তো এর শাসনভার নিজের কাছে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবে এক দলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। দুষ্টু লোকদের শায়েস্তা করতে না হয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। নানা মুনির নানা মত, তাই চারটি মাত্র পত্রিকা রেখে বাকিগুলোকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। যদিও সেই রক্ষীবাহিনীর লাগাম আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তবুও সে যুগ বর্তমান যুগের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। যার জন্য প্রাণ দিতে এ জাতি কুণ্ঠাবোধ করেনি, তাকেই আবার নৃশংসভাবে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার জাতি আমরা।

আমরা সবকিছুইতেই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি। কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই গলা টিপে ধরি। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর মত করে চেনার চেষ্টা করিনি। যারা চারপাশে তাঁকে ঘিরে ছিল, তারা উনাকে ভুল তথ্য দিয়ে, ভুল পরামর্শ দিয়ে এবং ভুল গল্প শুনিয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিল। হত্যার পর তারাই আবার তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল। তবে এই শোক দিবসে জাতির জনকের কন্যার প্রতিজ্ঞা হোক, আমরা মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেবো না। আমরা কথার জবার ষ্টীমরুলার দিয়ে দেবো না। যুক্তির জবাব বুলেট, জেলজুলুম, গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার, হাতুড়ি, হেলমেট নিয়ে পিটিয়ে সোজা করে দেবো না। আমরা কথার জবাব দেবো কথা দিয়ে, যুক্তির জবাব যুক্তি দিয়ে। আইনের অধিকার দিয়ে যে আইনের শাসনে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে।

একমাত্র তখনোই আমাদের দেশপ্রেম আব্দুর রহমানের মতো পিউর আর খাঁটি হবে। আর তা না হলে আমাদের দেশপ্রেম ভেজাল আর দুর্গন্ধময়ই হবে। জাতীয় শোক দিবসে সে আশাই ব্যক্তি করছি। আর যাতে এরকম শোক দিবসের সৃষ্টি না হয় সে পথ আমাদেরই খুঁজতে হবে। বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়পরিজন হারানোর কষ্ট আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে কেউ বেশি অনুধাবন করেন না। তাই উনার কাছে আকুতি থাকবে স্বজন হারানোর কষ্টে যেন পুরো দেশের মানুষকে আর শোকাভিভূত না করে। একটি ১৫ই আগস্ট পুরো জাতির কান্না। ঘরে ঘরে ১৫ই আগস্ট চাই না। যারা তাদের আপনজন হারাচ্ছেন তাদের জন্য সেটাই সবচেয়ে বড় ১৫ই আগস্ট। এ কথা যেন আমরা অনুভব করি। জাতির জনক এবং তাঁর সাথে নিহত সবার রূহের মাগফেরাত কামনা করি জাতীয় এ শোক দিবসে। 

আমাদের প্রয়োজন আব্দুর রহমানের মতো দেশপ্রেম।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *