সাহাবাগণ নক্ষত্রসম, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা [দুই] – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

[এবার দ্বিতীয় পর্ব। যারা প্রথম পর্ব পড়েন নি তাঁরা দয়া করে প্রথম পর্ব পড়ে নিন। তা না হলে অনেক কিছু না বুঝেই কেবল আংশিক জেনে মন্তব্য করতে থাকবেন। সাহাবাগণের সম্মান, মর্যাদা এবং তাঁদের কার কি অবস্থান তা পুরোপুরি না জানলে তা হবে অন্ধের হাতি দেখার মতো। ঈমানের সাথে যারাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তারাই সাহাবার মর্যাদা লাভ করেছেন। তাঁদের সবার মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, রাসুলের নৈকট্য এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুভবতা এক রকম ছিল না। এ কারণেই কেউ আশআরায় মুবাশশারা, কেউ সিদ্দীকে আকবর, কেউ আসাদুল্লাহ, মানে আল্লাহর সিংহ যাঁকে ভালোবাসা মুমিনের প্রমাণ আর ঘৃণা করা মুনাফিক হবার জন্যে যথেষ্ট।। ]

দশমঃ মক্কা বিজয়

মর্যাদা এবং সম্মানের দিকে দিয়ে দশম স্তরে আছেন মক্কা বিজয়ের পর ঈমান আনা সাহাবাগণ। এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী সাহাবাগণের মর্যাদা বাকি সাহাবাদের চেয়ে অনেক বেশি। মক্কা বিজয় একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা। যা স্বয়ং আল্লাহ পাক সূরা হাদীদের ১০ নং আয়াতে ঘোষণা দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। “তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে, সে সমান নয়; এরূপ লোকদের মর্যদা বড় তাদের অপেক্ষা যারা পরে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে।” কথা পরিষ্কার। না বোঝার কোনও অবকাশ নেই। কারণ হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ধীরে ধীরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হতে থাকে। আর মক্কা বিজয়ের পর লোকজন দলবেঁধে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। মক্কা বিজয় এবং গণহারে লোকজনের ঈমান আনার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ পাক সূরা নসর নাযিল করেন, “আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন”। এভাবে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করার লোকগুলো সাহাবা হবার গৌরব লাভ করেছেন। তবে সেই “নাযযালা”র সুযোগ পান নি। অর্থাৎ ধীরে ধীরে কুরআন নাযিল হবার ফলে পূর্বে ঈমান আনা সাহাবাগণ যেভাবে রাসুলের সাহচর্য লাভ ও চর্চার মাধ্যমে পুরোপুরি দীনে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছেন, মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে ইসলামের প্রবেশ করা সাহাবাগণ সে সুযোগ পান নি। এ কারণে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে নও-মুসলিমদের উদ্দেশ্যে আহবান জানান, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।’ (সূরা বাকারা:২০৮)।

আমরাই কেবল হুজুগে বাঙালী নই। বিশ্বের সব মানুষই কমবেশি হুজুগে চলে। সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ অস্থির, অকৃতজ্ঞ এবং হুজুগে চলা। সে কথা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রয়েছে। ইসলামের জয়জয়কার দেখে যেভাবে দলে দলে লোকজন ইসলামে প্রবেশ করেছিল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের পর ঠিক সেখানেই তাদের অনেকেই উল্টো পথে দৌড় দিয়েছিল। এসব লোকদের উদ্দেশ্য করেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাউযে কাউসারের একটি চিত্র বর্ণনা করেছেন যা ইমাম বুখারি রেওয়ায়েত করেছেন, “আমি তোমাদের আগে হাউয এর কাছে গিয়ে পৌছব। আর (ঐ সময়) তোমাদের কতিপয় লোককে নিঃসন্দেহে আমার সামনে উঠানো হবে। আবার আমার সামনে থেকে তাদেরকে পৃথক করে নেয়া হবে। তখন আমি আরয করব, প্রভু হে! এরা তো আমার উম্মাত। তখন বলা হবে, আপনার পরে এরা কি কীর্তি করেছে তা আপনি জানেন না [বুখারি: ২৭৩৪]।

তাদের একদল যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসলো, একদল নিজেদেরকে নবী দাবি করে বসলো। তাদের আবার হাজার হাজার অনুসারি জূটে গেল। একদল তাদের পূর্বের পাগান ধর্মে ফিরে যেতে লাগলো। মদিনার আশেপাশেরই কিছু কিছু গোত্র বিদ্রোহ শুরু করে দিল। মদিনার বাইরেও বিভিন্ন গোত্র দলে দলে ইসলাম ত্যাগ করতে শুরু করলো এবং বিদ্রোহ করতে লাগলো। প্রথম খলিফা আবু বকর রা খুব শক্ত হাতে এবং সফল ভাবে মিথ্যা নবুয়তের দাবিদারদের পরাহত করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল মুসায়লামা কাজ্জাব। যারা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তাদেরকেও কঠোর হস্তে দমন করেন। যাকাত যে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি তা এই হুজুগে ঈমান আনা সাহাবাগণ বুঝতে পারে নি। বুজাখা, নজদ, ইয়ামামা, ওমান, ইয়েমেন, মাহরা, বাহরাইন, হাদরামাওতসহ অনেক অঞ্চলে এভাবে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। খলিফা এসব খুব দক্ষতার সাথে দমন করে ইসলামী খেলাফতকে সুরক্ষা করেন। এসব যুদ্ধেই প্রচুর হাফেয শহীদ হন এবং এরফলে কুরআন সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়। এ কারণে ইতিহাসে আবু বকর রা ইসলামের দ্বিতীয় প্রাণদাতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। শিয়ারা না বুঝে উনাকে সহ অন্যান্য সাহাবাদের গালি দেয় এবং কাফের মনে করে।

মক্কা বিজয়ের সময় কি ঘটেছিল তা মুসলমান মাত্রই জানে, সচেতন অমুসলিমরাও জানে। রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান। এটি ছিল এক মহা বিপ্লব। আবু সুফিয়ান ও তার পরিবার রাতের আঁধারে গোপনে এসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলামে পদার্পণ করেন। সাথে যুবক মুয়াবিয়াও ছিলেন। আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা ইয়েমেনের দিকে দৌড়ে পালিয়েছিলেন। মারওয়ানের পিতা হাকামসহ মক্কার অন্যান্য কুরায়শরা সব জড়ো হয়ে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদেরকে দেখে নবীজী প্রশ্ন করলেন, তোমরা আমাকে মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আমাকে এবং আমার সাহাবাদের কষ্ট দিয়েছিলে, অনেককে হত্যা করেছিলে। আজ আমরা তোমাদের উপর বিজয় লাভ করেছি। তোমরা এখন আমার কাছ থেকে কিরকম আচরণ প্রত্যাশা করো? মক্কার লোকেরা একযোগে বলে উঠলো, আমরা আত্মীয়ের আচরণ কামনা করি। আচ্ছা এরা কি আত্মীয়ের আচরণ পাবার যোগ্য ছিল? নবীজী তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করলেন, তোমাদেরকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। তোমরা আজ থেকে মুক্ত। স্বাধীন। আজ কেউ তোমাদের উপর কোনও প্রতিশোধ নেবে না। এ ঘোষণা শুনে মক্কার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এ হল ইসলামের মানবতা। এ হল ইসলামের নবীর মহানুভবতা।

তুলাকা ও উতাকা সাহাবা

মক্কা বিজয়ের সময় ও এর ঠিক পরপর যাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল, তারা ইসলামে প্রবেশ করলেন। ফতেহ মক্কার দিন সাধারণ ক্ষমা পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করা সাহাবাদেরকে হাদিসের ভাষায় তুলাকা বলা হয়। তাদের অনেকেই নিজেদের সামাজিক অবস্থান, প্রতিপত্তি, মান-সম্মান এবং জীবন বাঁচাতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাও বাধ্য হয়ে। তারা বুঝতেই পারেন নি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতো সহজে মক্কা জয় করে ফেলবেন। তারা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই মক্কা বিজীত হয়ে যায়, ফলে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। কেউ কেউ মক্কা ছেড়ে অন্যত্র পালাতে শুরু করে, কেউ কা’বার গিলাফ ধরে আত্মরক্ষা করতে থাকেন, কেউ রাতের আঁধারে সম্ভ্রান্ত ও আত্মীয় সাহাবাদেরকে মাধ্যম ধরে পুরনো আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে নবীজীর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। দয়ার সাগর নবীজী তাদেরকে একে একে ক্ষমা করে দেন।

আর উতাকা হলেন সেসব সাহাবা যারা তায়েফে হুনাইনের যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধবোন সায়মা রা’র সম্মানে তাঁদেরকে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। এই তায়েফেরই যুদ্ধবাজ গোত্র হল সাকিফ গোত্র।

তুলাকা আর উতাকা সাহাবাগণ সাহাবার মর্যাদা পেলেও তাদের অনেকেই মন থেকে ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন নি। ফলে তাদের অনেকেই মুনাফিকে পরিণত হন। উপরে উপরে মুসলমানের বেশভূষা থাকলেও ভেতরে ভেতরে এরা সুযোগের সন্ধানে থাকতেন কখন স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ক্ষতি করবেন। শাস্তি ও প্রতিশোধ না নিয়ে নবীজি ছঃ তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেও মুহাজির ও আনছারদের কাতারে তাদেরকে স্থান দেননি। উল্লেখ্য, এই তুলাকা সাহাবাদের একজন হাকাম ইবনে আবুল আস ইবনে উমাইয়া প্রায়ই নবীজীর সাথে বেয়াদব করতো। ফলে নবীজী হাকামকে তার ছেলে মারওয়ানসহ মদিনা থেকে আয়েফে নিরবাসন দেন। মারওয়ানের বয়স তখন ৭ কি ৮ বছর। হিসেব মতে তার সাহাবী হবার কথা, কিন্তু ইবনে হাজার আস্কালানি এবং ইমাম সুয়ুতী রহঃ সহ অনেকেই তার সাহাবিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তুলাকা ও উতাকা সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করে নবীজী হযরত জরীর বিন আবদুল্লাহর সূত্রে বলেন, “কেয়ামত পর্যন্ত মুহাজির ও আনছারগণ একে অপরের বন্ধু হিসেবে থাকবে। অনুরুপ কোরায়শের (মক্কার) তুলাকা ও ছাকীফের (তায়েফের) উতাকারাও পরস্পরে বন্ধু হিসেবে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।” [মুসনদে আহমদ (১৯২৩৫, ১৯২৩৮)]  

হ্যাঁ! তায়েফের মুগীরা বিন শোবার মক্কার মুয়াবিয়া হযরতকে এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মক্কার আবদুল মালিক বিন মরওয়ানকে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের ঘটনা থেকে এ হাদীছের সত্যতা প্রমাণিত হয়। হাদীছ ও ইতিহাসের তথ্যমতে মুয়াবিয়া হযরতের পক্ষে কোনো মুহাজির ও আনছার ছাহাবা ছিলেন না। সবাই ছিলেন হযরত আলী রাদ্বিয়ালাহু আনহু’র পক্ষে। তবে অল্পকিছু মুহাজির ও আনছার ছাহাবী যুদ্ধ থেকেই দূরে থাকেন। আর হযরত যুবাইর ও তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনুহুমার কেউই মুয়াবিয়া হযরতের পক্ষে লড়াই করেননি। তাঁরা বনু উমাইয়ার দুষ্টদের তৎপরতা দেখে বিদ্রোহীকে না দমিয়ে খলীফা ও তার মাঝে মধ্যস্থতা করার মত ভুল করে শাহাদত বরণ করেছিলেন। আর হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাও ওই ভুলে (মধ্যস্থতাকে সমর্থনে) জড়িয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে খুবই আক্ষেপ করেছিলেন। [জাহাবীর সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (৩/ ৪৬২) ও জাইলাঈর নছবুর রায়াহ্ (৪/ ৬৯)] ।

এই তুলাকা ও উতাকা সাহাবারা কয়েকবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতে পর্যন্ত উদ্ধত হয়েছিল। তাদের মধ্যে কিছু যে মুনাফিকের ভূমিকা নিয়েছিল তা উন্মোচনে ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী, ইমাম আবু আবদুল্লাহ (হাকেম) নিশাপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম আজমাইনের সাথে আরো বেশী অগ্রসর ভূমিকা পালন করেছেন ইমাম বাইহাকী। এমন একটি ঘটনা ইমাম বায়হাকি রহঃ তাঁর দালায়েলুন নবুয়াতে (৫/২৫১) উল্লেখ করেছেন।

হুজায়ফা রা বলেন, (তাবুক থেকে ফেরার পথে) আমি নবীজি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উটনীর লাগাম ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম এবং আম্মার পিছন থেকে হাঁকিয়ে নিচ্ছিলেন। কখনো আম্মার লাগাম ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং আমি পিছন থেকে হাঁকিয়ে নিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা যখন আকাবায় (গিরিপথে) পৌঁছুলাম, তখন দেখলাম ১২ জন লোক তাঁকে (নবীজিকে) ঘিরে চললো। তখন আমি নবীজিকে সতর্ক করলাম। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে আওয়াজ দিলেন। এতে তারা পিছনে চলে গেল। পরে নবীজি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের (উভয়কে) বললেন, “তোমরা কি ওদেরকে চিনতে পেরেছো?” আমরা বললাম, না ইয়া রসূলল্লাহ! তারাতো মুখোশ পরিহিত ছিল। তবে আমরা বাহনগুলোকে চিনেছি। তিনি বললেন, “এরা কেয়ামত পযর্ন্ত মুনাফিক। তো ওরা কি চেয়েছে, তা কি জেনেছো?” আমরা বললাম, না। তিনি বললেন, “আকাবায় তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভিড় সৃষ্টি করে তাতে আল্লাহর রসূলের ক্ষতি করতে চেয়েছিল।” আমরা বললাম, আপনি কি তাদের গোত্রের কাছে এ মর্মে নির্দেশ পাঠাতে পারেন না যে, প্রত্যেক গোত্র তাদের এসব দুরাত্মাদের মাথা নিয়ে হাজির হবে? তিনি বললেন, “না। আমি এটা অপছন্দ করি না যে, আরবরা পরস্পরে এ কথা বলাবলি করবে, মুহাম্মদ একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন। অতঃপর আল্লাহ যখন তাঁকে তাদের উপর বিজয় দান করলেন, তখন তিনি তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করলেন।” এরপর তিনি বললেন, “ইয়া আল্লাহ, ওদেরকে দুবাইলা দ্বারা মারো।” আমরা বললাম, ইয়া রসূলল্লাহ! দুবাইলা কি? তিনি বললেন, “হৃদপিন্ড থেকে বের হওয়া একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ (ভয়াবহ ফোঁড়া), যাতে তারা মারা যাবে।” [বাইহাকীর দালায়েলুন নুবুওয়াহ্ (৫/২৬১)।

সাহাবা হলেই যে সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী হবেন না, এ ঘটনা তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। এই ১২ জন মুনাফিক কিন্তু সবার কাছে অজ্ঞাতই থেকেছেন। একমাত্র মুনাফিক বিশেষজ্ঞ সাহাবী হুজায়ফা এবং আম্মার বিন ইয়াসির রাঃ ব্যতীত আর কেউ এদেরকে মুনাফিক হিসেবে চিনতেন না। এই ১২ জন  মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সলুলের সাথের লোক ছিল না। এরা সাহাবা হিসেবেই সাধারণের মাঝে পরিচিত ছিল এবং আজো এদেরকে আমরা সাহাবা হিসেবেই গণ্য করে থাকি। তাদের ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ও ইমাম মুসলিম রহঃ একটি সহীহ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তা হল, তাবেয়ী কয়েস বিন আব্বাদ বলেন, আমি হযরত আম্মারকে বললাম, আপনারা হযরত আলীর পক্ষ নিয়ে যে কাজ (যুদ্ধ) করছেন, তা কি আপনাদের নিজস্ব চিন্তা থেকে করছেন নাকি তা রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর পথনির্দেশকৃত কোনো বিষয়? তিনি বললেন, সাধারণ মানুষ বাদ দিয়ে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিশেষ কোনো পথনির্দেশ দেননি। তবে আমাকে হুযাইফা (তিনি মুনাফিকদের নাম জানা বিখ্যাত মক্কী-মাদানী ছাহাবী) জানিয়েছেন যে, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমার ছাহাবীদের মাঝে ১২জন বিশিষ্ট মুনাফিক আছে। সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ না করা পর্যন্ত (অর্থাৎ, কস্মিণকালেও) তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাদের আটজন মরবে #দুবাইলায় (বুক ও গর্দান দুর্বলকারী এক ধরণের ফোঁড়া) আক্রান্ত হয়ে।” নীচের একজন বর্ণনাকারী বলেন, ‘বাকী চারজনের ব্যাপারে শু‘বা কি বলেছেন, তা আমার স্মরণ নেই।’ [ছহীহ মুসলিম (২৭৭৯)]।

উল্লেখ্য, এই হাদিসটি সিফফিনের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করার পেছনে একটি বিশেষ মাহাত্ম রয়েছে। সে রহস্য সবাই হজম করতে পারবেন না। যুদ্ধের ময়দানেও মওলা আলী রাঃ তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে কিছু হাদিস শোনাতেন। তিনি যে মুমিনদের মওলা তা লোকদের কাছে জানতে চাইতেন তারা রাসুল থেকে এমন বর্ণনা শুনেছে কিনা। মুনাফিক সংক্রান্ত হাদিসটি এরকম, তাবেয়ী জির বিন হুবাইশ বলেন, হযরত আলীرضي الله عنه-  বলেছেন, ‘সে মহান সত্ত্বার কসম, যিনি দানা উৎপন্ন করেছেন এবং সৃষ্টকূলকে সৃষ্টি করেছেন! আমার কাছে এটা অবশ্য রসূলুল্লাহ صلَّى الله عليه وسلَّم  এর অঙ্গীকার যে, আমাকে মুমিন ছাড়া কেউ ভালোবাসবে না (অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা) এবং মুনাফিক ছাড়া কেউ আমাকে ঘৃণা করবে না।’ [ছহীহ মুসলিম (৭৮), সুনানে তিরমিযী (৩৭৩৬) ও সুনানে নাসায়ী (৫০১৮)]। ইন শা আল্লাহ, পরের পর্বে মুনাফিকদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো। সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *