হারাধনেরা কি হারিয়ে যাচ্ছে?

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

হারাধন বাবু ছিলেন আমাদের আমিয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। একজন পরিপাটি মানুষ। সুন্দর পোশাক আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের কারণে কয়েক কিমি দূর থেকেও তাকে দেখে চেনা যেতো। সুন্দর চেহারার সাথে সুন্দর ও মার্জিত কথা ছিল তার ভূষণ। তিনি ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানে সহজ বাংলায় যাকে আমরা হিন্দু বলি।

আমাদের অঞ্চলে তখন অনেক হিন্দু পরিবার বাস করতো। দেশ ভাগের সময় অনেক হিন্দু পরিবার এদেশ ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। ৪৭-এ দেশ ভাঙার সময় গান্ধী ও জিন্নাহ মিলে একটা অপশন দিয়েছিলেন। সেটা ছিল, ভারতের মুসলমান চাইলে ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে যেতে পারবে আর পাকিস্তানের হিন্দু চাইলে পাকিস্তান ছেড়ে ভারত চলে যেতে পারবেন। তবে এ দেশ ত্যাগ খুব সহজ ছিল না। পথে অনেকেই জান ও মাল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। ভারতের বিখ্যাত লেখক কিষাণ চন্দর তার “গাদ্দার” উপন্যাসে দেশ ভাগের মুহূর্তের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথা খুব বাস্তবরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন।

সে দাঙ্গার মুহূর্তে আমাদের মতলবের উত্তরের বিশাল অঞ্চল নিয়ে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আর বর্তমানের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন আমার দাদা (প্রকৃতপক্ষে আমার দাদার বড় ভাই) আশ্রাব আলী সরকার। আমাদের মতলত উত্তরের হিন্দুরা তাকে সম্মান করে “বাবা” বলে ডাকতো। সেসব হিন্দুরা যেমন তেমন হিন্দু ছিল না। ধোপা মুচি কিংবা নাপিত টাইপের হিন্দু ছিল না তারা। তারা ছিল বনেদি জমিদারি টাইপের বেনিয়া হিন্দু। বেলতলি বাজার, কালিপুর, কালির বাজার, ধনাগোদা, দুর্গাপুর – এসব অঞ্চলে কার্গো দিয়ে বানিজ্য পরিচালনা করতো ওইসব হিন্দু বেনিয়ারা। তখনকার দিনেই এদের ছিল কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ও বানিজ্য। মজার ব্যাপার হল এসব হিন্দুদের কেউই দেশ ভাগের সময় নিজ অঞ্চল ছেড়ে ভারতে যায় নি। তারা এখানেই থেকে গিয়েছিল।

আমার দাদা ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। জনশ্রুতি রয়েছে, তার ভয়ে বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেত। সেদিন এ অঞ্চলের কোনও হিন্দু কোনও মুসলমান কর্তৃক কোনও অত্যাচার কিংবা বৈমাত্রেয় আচরণের শিকার হয় নি। মরহুম ভাইস প্রেসিডেন্ট আশ্রাব আলী সরকার সাহেব খুবই কঠোর হস্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন তখনকার দিনেই নদীপথে ৩ বার হজ করা পাক্কা ঈমানদার মুসলমান।

তারই প্রতিষ্ঠিত আমিয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হারাধন বাবু ছিলেন প্রধান শিক্ষক। ছোটো-ওয়ানে থাকার সময় একবার তিনি আমার হাতের লেখা দেখে ফেলেন। বলা বাহুল্য, আমার হাতের লেখা সেই ছোটবেলা থেকেই খুব সুন্দর ছিল। সিলেটের উপর সাদা চকে আঁকা লেখা দেখে তিনি জানতে চাইলেন কে লিখে দিয়েছে। আমি যখন উত্তরে জানালাম ওগুলো আমার নিজের হাতেরই লেখা। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাসই করতে পারলেন না। উপরন্তু তার হাতে থাকা কালো রুলারটি আমার মাথার উপর তুলে আঘাত করার ভান করলেন। আমি ছিলাম নির্ভয়। কারণ ওই লেখা ছিল আমার নিজের। আর আমি মিথ্যা কথাও বলিনি। কাজেই ভয় কিসের। আমি আবারো জোর দিয়ে বললাম, স্যার, এ লেখা আমারই। তিনি আবারো মুখে এমন ভান করলেন যেন আমার মাথায় সেই কালো মোটা রুলার পড়েই যাচ্ছে। আমার দৃঢ় অবস্থান দেখে তিনি বললেন, তাহলে এগুলো মুছে আবার লিখে দেখাও দেখি। না হলে এই রুলার তোমার মাথায় পড়বে। আমি উনার সামনেই টপাটপ করে চক হাতে নিয়ে লিখে দেখালাম। তিনি আমাকে অনেক আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

মায়ের কাছে শুনেছিলাম, তিনি একবার আমাদের ঘরে গিয়ে খাবারও খেয়েছিলেন। ভাত নয়, মুড়ি। উনি লজিং থাকতেন মুক্তির কান্দি হিন্দু পাড়ায়। প্রায় এক কিমি পথ পায়ে হেঁটে আমাদের গ্রামে এসে স্কুল নিতেন। অত্যন্ত ধার্মিক টাইপের মানুষ ছিলেন তিনি। মাঝে মধ্যে আমাদের ইসলাম ধর্মের স্যার না থাকলে তিনিই আমাদের ইসলাম-ধর্ম ক্লাস নিতেন। আমরা জোহরের নামায স্কুলেই পড়তাম। মুসলমান ছেলেরা তার ভয়ে আগে আগে অজু করে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতাম। আর মেয়েরা তাদের কমনরুমে নামায পড়তো। কোনও মুসলমান ছেলেমেয়ে নামায ফাঁকি দিলে হারাধন বাবুর শাস্তি থেকে সে রেহাই পেতো না। তিনি যখন আমাদেরকে কালেমা পড়াতেন, তখন আমরা ভাবতাম তিনি মনে হয় মুসলমান হয়ে গেছেন। কালেমা পড়লে তো মানুষ মুসলমান হয়।

একদিন হঠাৎ করেই শুনলাম হারাধন বাবুকে বদলি করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং অভিবাবকদের সেকি কান্না। একজন হিন্দুর জন্য মুসলমানের কান্না। একজন মানুষের জন্য অন্য মানুষের কান্না। এ কান্না বিদায়ের করুণ মুহূর্তের, আর কেউ কাউকে দেখতে না পাওয়ার কান্না। এ কান্না ভালোবাসায় পূর্ণ মানুষের জন্য ভালোবাসার কান্না।

এরপর আর কোনোদিন হারাধন বাবুর সাথে দেখা হয় নি। মনে মনে অনেক খুঁজেছি তাকে। এখনো কোথাও দেখা হলে পা ছুয়ে সালাম করতাম। জানি না আজ তিনি বেঁচে আছেন, না পরপারে চলে গেছেন। ৪০ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। হারাধন বাবু আমাদের কারো মন থেকেই হারিয়ে যান নি। কিন্তু অন্যান্য হারাধনেরা একে একে হারিয়ে গেছে। আমাদের অঞ্চলে প্রচুর হিন্দু পরিবার ও ব্যবসায়ী ছিল। তারা একে একে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে লাগলো। প্রিয়া সাহা যাদেরকে গুম বলে অভিহিত করেছেন। তারা রাতের আঁধারে গোপনে একই সম্পত্তি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে গেছেন। হঠাত করে একদিন সকাল বেলা শুনতে পেতাম অমানিশা বাবু নেই। কোথায় তিনি? পরে জানা যেতো তিনি ওপারে মানে তীর্থভূমি ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। যাবার আগে তারা গোপনে যে সম্পত্তি একাধিক ব্যক্তির কাছে বেচে গেছে, পরদিন সকাল থেকে শুরু হতো লাঠালাঠি। এখনো অনেক জমির মালিকানা নিয়ে মামলা আছে আমাদের অঞ্চলে।

এভাবেই কালাই আর হরিদাসেরা একে একে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। মুসলমানদের অত্যাচারে নয়। ভারতের মায়ায়। আমাদের দেশের অনেক হিন্দুরই দেহ থাকে এপারে, আর মন ও আত্মা পড়ে থাকে ওপারে, মানে ভারতে। যে হিন্দুদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছোটবেলা খেলেছি, সে হিন্দুরা রাতের আঁধারে চুপি চুপি এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। একসাথে খাওয়া এবং একসাথে খেলার সাথিকেও কিছু জানায়নি। পশুপক্ষীও টের পায়নি কবে কখন কিভাবে তারা এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। বিভিন্ন কারণে যারা কলকাতা যায় তাদের সাথে সেসব মানুষগুলো মাঝে মধ্যে দেখাও হয়। কলকাতার কালি মন্দির দেখতে গিয়ে এমনই একজনের সাথে দেখা হয়েছিল। গর্ব করে তিনি জানালেন তিনি বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাসিন্দা ছিলেন। কেন দেশ ছাড়লেন জানতে চাইলে, তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হুজুগে। সবাই ভারতে চলে আসছে, তাই আমিও চলে এলাম। তাছাড়া আত্মীয়রা সবাই চলে গেছে, একা থেকে কি করবেন?

বাংলাদেশের প্রায় সব হিন্দুর বাংলাদেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তাদের অনেকেই থাকে বাংলাদেশে কিন্তু তাদের আত্মীয়রা ভারতে তাদের নামে রেশন উত্তোলন করে তাদের কার্ড সচল রাখে। এ তথ্য আমাকে দিয়েছে হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া এক মেয়ে। প্রিয়া সাহা যাদেরকে মিসিং বা ডিজএপেয়ার্ড বলছেন তারা আসলে এদেশে ভালো থাকার পরও স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তাছাড়া মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের প্রজনন ক্ষমতা কম। যেমন রোহিঙ্গা নারীদের প্রজনন ক্ষমতা অন্য বৌদ্ধ বা বাঙালী নারীর তুলনায় বেশি। ৪৭-এ দেশ ভাগের সময় এদেশে ২৯ ভাগের উপর হিন্দু থাকলেও এখন তা ৯ এ নেমে আসার এটিই মূল কারণ। তারা হারিয়ে যায় নি। স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ করেছে। আমি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাইনি। আমি এবং আমার স্ত্রী স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ করে সুইডেনে আছি। কেউ পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারে আমরা মিসিং। কেননা, আমাদের আপডেটেড ডাটা সরকার বা অন্য কারও খাতায় নেই।

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *