“আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা” – ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

সহজ একটি বাক্য, কিন্তু যুগ যুগ ধরে এর ব্যাখ্যা হয়ে আসছে অনেক জটিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম একটি বিশেষ মুহূর্তে মুমিনদের মওলা আলী আলাইহিস সালামের হাত ধরে উপরে তুলে ঘোষণা করেন, “আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা”। এই ঘোষণা দেবার জন্য তিনি আল্লাহ পাক কর্তৃক আদিষ্ট হলেন, “হে রাসূল! আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন; আর যদি আপনি তা না করেন, তা হলে আপনি তাঁর রিসালতই (যেন) প্রচার করেননি। আর মহান আল্লাহ্ আপনাকে জনগণের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়েদা-৬৭)  “আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা”, এই একটিমাত্র বাক্যের মাধ্যমে মুমিন থেকে মুনাফিক আলাদা হয়ে গেল, সত্যিকারের আহলে বাইতের আশেক থেকে মিথ্যা আহলে বাইত-দরদী শিয়া-রাফেজীরা চিহ্নিত হয়ে গেল। এই বাক্যটি মুনাফিকের অন্তর ভেদ করে গেল। এতদিন যারা মনে মনে মওলা আলীর প্রতি হিংসা পোষণ করে আসছিল, তারা যেন দিশেহারা হয়ে গেল। এই বাক্যটি তাদের অন্তরে অশান্তি সৃষ্টি করে দিল। ছোট একটি বাক্য, কিন্তু এর মর্ম অত্যন্ত গভীর। “আর মহান আল্লাহ্ আপনাকে জনগণের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন” বলার পেছনেও রহস্য লুকিয়ে আছে। কাদের পক্ষ থেকে অনিষ্টতা হবার আশংকা ছিল? তারা ঠিকই আহলে বাইতের অনিষ্ট করেই ছেড়েছে।

যুগের পর যুগ পার হল। উমাইয়্যা-আব্বাসীয় দুনিয়া-লোভী রাজা-বাদশাহগণ এলেন ও গেলেন। এরা নিজেদের গৃহপালিত মুহাদ্দিস ও মুফাসসির দিয়ে ইচ্ছে মতো এর ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। চেষ্টা করলেন আহলে বাইতের শানে হাদিসগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে, অনেকটাই সফল হলেন। তবে পুরো সম্ভব হল না। একদল মুহাদ্দিস ওই কঠিন সময়েও জঙ্গলে লুকিয়ে সত্য তুলে ধরতে লাগলেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করেও কেউ কেউ সত্য প্রচার করে গেলেন। হাসান বসরী রহঃ এর মতো তাবেঈ মুহাদ্দিস মওলা আলীর নাম উচ্চারণ করতে সাহস করলেন না। মওলার নাম না নিয়ে তিনি সরাসরি মুরসাল হাদিস বর্ণনা শুরু করলেন। কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামকে দেখেন নি, তাহলে আপনি কিভাবে বলেন, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম) একথা বলেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, যখনই আমি বলি রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম) একথা বলেছেন, তোমরা ধরে নিও এর মাঝখানে মওলা আলী আছেন। অর্থাৎ ওই সময়ে উমাইয়্যা রাজাদের ভয়ে কেউ সত্য বলতে পারতেন না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম ওই বিশেষ মুহূর্তে যে ভাষণ দেন তার সারমর্ম হলো, “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিষ রেখে যাচ্ছি তন্মধ্যে একটা অপরটা অপেক্ষা মহান। সে দুটি হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব মানে কুরআন আর আমার আহলে বাইত (পরিবার-পরিজন)। আমি দেখবো তোমরা এ দু’টির সাথে কিরূপ আচরণ করো? এ দু’টির একটা অপরটা থেকে ‘হাওয-ই-কাওসার’-এর কিনারায় আমার সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত পৃথক হবে না।” [রেফারেন্সঃ তিরমিজি, হাদিস নং-৩৭১৩,৩৭৮৮, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১২১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪০৮, আলবানি- সিলসিলাতু আহাদিসি সাহিহাতে। হাদিস নং ১৭৫০ ] অথচ হতভাগা উম্মত এ দুটোই সবার আগে ছুড়ে ফেলে দিল। কুরআনকে নামেমাত্র ধরে রাখল, আর আহলে বাইতকে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিত্যাগ করলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের বিদায়ের মাত্র ৩০ বছর পরই আহলে বাইতকে নিঃশেষ করার চেষ্টা করা হলো। আলে মুহাম্মাদকে পশুর মতো জবাই করা হলো। হারাম আর হালালের বাছ বিচার কেবল নিজেদের সুবিধামত বজায় রাখা হলো।

“আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা” মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হল। সফলও হলেন তারা। কারা করলেন এসব? উমাইয়্যারা। উমাইয়্যাদের পর আব্বাসীয়রাও এ ধারা অব্যাহত রাখলেন। আর যুগে যুগে তা চলমান রাখল এজিদী এবং নাসেবী বান্ধবেরা। তাও আহলে সুন্নাহর নামে। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ দুটোকে আঁকড়ে থাকলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। এগুলোকে ছেড়ে দিলে তোমরা ধ্বংস হবে।

১১০ জন রাবির মাধ্যমে এই হাদিসটি বর্ণিত হয়ে মুতাওয়াতীর পর্যায়ে পৌঁছে অর্থাৎ যা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে না। এই হাদিসটি সহীহ মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তার প্রায় সবগুলো কিতাবে স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে আরেকটি হাদিস সিহাহ সিত্তার কিতাবে স্থান পায়নি, তবে তা ইমাম মালিক বিন আনাস রহঃ মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের কাছে দুটো বস্তু রেখে যাচ্ছি, একটি আল্লাহর কিতাব এবং অন্যটি আমার সুন্নাহ।

প্রথম এবং মুতাওয়াতির হাদিসটিকে ধামাচাপা দেয়া হল। আর মুরসাল হাদিসটিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হল। আল্লাহর কিতাব এবং আহলে বাইতের কথাগুলো মানুষের মন থেকে এমন ভাবে মুছে দেয়া হল যে, বর্তমান জামানায় কোনও আলেমও ওই হাদিসটি শুনলে চোখ কুঁচকান। আর কেউ সাহস করে ওই হাদিসটি বর্ণনা করলে তাকে শিয়া মনে করা হয়। কেউ কেউ সরাসরি বলেই ফেলেন যে, এটা শিয়াদের বানানো হাদিস। যদিও দুটো হাদিসের মূল একই। আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাহ ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। তবে আহলে বাইতের মাধ্যমে আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাহ জানা সবচেয়ে নিরাপদ এবং সঠিক। তা থেকে মুসলমান সমাজ দূরে সরে আসার কারণেই সমাজে ফেতনা দেখা দেয় এবং যুগে যুগে এতো এতো ফেরকার সৃষ্টি হয়। আর বর্তমান কালে দিকে দিকে মুসলমানদের মার খাওয়ার পেছনেও এই সত্যকে ছেড়ে দেবার কারণই বিদ্যমান। 

মাওলা শব্দের অনেক অর্থ হতে পারে। সোজা কথায় এবং সহজে মাওলা মানে অভিভাবক, প্রভু, রক্ষক, বন্ধু, সাহায্যকারী। এমনিতেই এক আরবি শব্দের ডজন ডজন অর্থ হয়। কেউ চাইলে তা টেনে শ’য়েও নিতে পারেন। আরবি মাওলাহু শব্দের [مَوْلاَهُ] শব্দের বিভিন্ন অর্থ হলেও, এই কন্টেক্সট-এ খুব বেশি অর্থ নেবার সুযোগ নেই। কেননা, এর সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম নিজেকে যুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ “আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা”। এখন লক্ষ্য করুন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম আমাদের কি? তিনি কি আমাদের প্রভু? প্রভু হতে পারেন, তবে তা সৃষ্টিকর্তা অর্থে নয়। অভিভাবক এবং রক্ষক অর্থে। যেমন একজন দাসের প্রভু তার মালিক। রাসুল কি আমাদের বন্ধু? কক্ষনোই না। রাসুল আমাদের বন্ধু না হলে মওলা আলী আমাদের বন্ধু এই অর্থও নেয়া যাবে না। রাসুল কি আমাদের খলিফা? না তিনি খলিফাও নন। রাসুল যেহেতু আমাদের অভিভাবক, মওলা আলীও আমাদের অভিভাবক। না তিনি বন্ধু, না তিনি খলিফা। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম এ দুটোর কোনটাই নন। বাক্যের প্রথম অংশের শর্তটুকু যার জন্য প্রযোজ্য, শেষের অংশের শর্তও তার জন্য প্রযোজ্য হবে। আরবি গ্রামারের এটি একটি সূত্র। ইচ্ছে করে একে বন্ধুও বানানো যাবে না, খলিফাও বানানো যাবে না। নাসেবী বান্ধব সুন্নিরা এখানে মাওলা শব্দের অর্থ নেয় “বন্ধু” আর আহলে বাইতের মিথ্যা আশেকের দাবীদার শিয়ারা এর অর্থ নেয় “খলিফা”। ফলে এরা উভয় দলই ভ্রান্ত এবং পথহারা।

যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, তোমরা আমার পর আমার আহলে বাইতের সাথে কেমন আচরণ করো আমি দেখবো, সেখানে আহলে বাইতকে মানুষের মন থেকে মুছে দিয়ে সিরিয়ার লোকদের কাছে প্রচার করা হয়েছিল এজিদ হল আহলে বাইত। নাউজুবিল্লাহ। সৌদি পেট্রো-ডলারের সাহায্যে বিশ্বব্যাপী মতবাদ প্রচার করা হয়েছে যে, আহলে বাইতের আলোচনা করা যাবে না। কারণ এটা শিয়ারা করে। কারবালার আলোচনাকে সৌদি ঘোমটা মৌলবিরা হারাম ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাদের দেখাদেখি সুন্নি আলেমগণও এজিদীবাদে নিমজ্জিত হচ্ছেন। আশুরা কিংবা অন্য কোনও সময় আহলে বাইতের আলোচনা করলে এরাও গণহারে শিয়াদের কাজ বলে থামিয়ে দিতে তৎপর। এখন আর সৌদিপন্থী নব্য সালাফী ঘোমটাওয়ালার প্রয়োজন নেই, আমাদের আলেমগণই গাদিরে খুমের আলোচনা, এ দিনটি পালন এবং এ দিনের ঘোষণা, “আমি যার মাওলা, এই আলী তার মাওলা” কে শিয়াদের কর্ম বলে সুন্নিদের বিভ্রান্ত করছেন।

মনে রাখবেন, যুগে যুগে আহলে বাইত অবহেলিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, নির্যাতিত এবং হত্যার শিকার হয়েছেন আলেমরূপী, পাগড়ী-টুপিওয়ালা, নামাযী মানুষগুলো দ্বারাই। তরিকতের অনুসারী কারো পক্ষে এই বিশেষ দিনটিকে অস্বীকার করা বা এই হাদিসকে শিয়াদের দিয়ে দেবার কোনও উপায় নেই। কেননা, এই ঘোষণা দিয়ে মওলা আলী কারামুল্লাহ ওয়াজহুহুকে বেলায়েতের সম্রাট বানানো হয়েছে। রাসুল যেমন মুমিনদের সবচেয়ে নিকটে, গাদিরে খুমের ঘোষণা দ্বারা মওলা আলীও মুমিনদের অতি নিকটে, বেলায়েতের সম্রাট হিসেবে। তা বলবৎ থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। আপনি মানেন আর না মানেন। এ ঘোষণার পর সবার আগে শায়খাইন [হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)] মুসাফাহা করে হযরত আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন ও শুভেচ্ছা জানান এবং তাঁকে তাঁদের ‘মাওলা’ বলে অভিহিত করে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেন। পর্যায়ক্রমে হযরত উসমান (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত যুবাইর (রা.) সহ সকল সাহাবীই অভিনন্দন জানান। আসুন এ দিনটিকে স্মরণ করে আমরাও মওলাকে মওলা বলে মেনে নেই।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *