চাঁদ ও চাঁদ
ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজীরাত সারে এগারোটার দিকে এশার নামাজ পড়ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, বাইরে ঝকঝকে জ্যোৎস্না। উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর আকাশ সচরাচর এমন পরিষ্কার থাকেনা আর থাকলেও এমন ঝকঝকে জ্যোৎস্না দেখার সৌভাগ্য হয়না। কৃত্রিম নিয়নের আলো আর উত্তর মেরুর প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা চাঁদ দেখার আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে।সুইডেনের মালমো শহর থেকে ক্বাবা শরীফ ২৩ ডিগ্রীতে। অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে সামান্য দক্ষিণ-পূর্বকোণের কাছাকাছি। আর জ্যোৎস্না আসছিল দক্ষিণ দিক থেকে। রুমের লাইট বন্ধ করে হলরুমের আবছা আলোতে নামাজ পড়ছিলাম। ফলে দক্ষিণের বিশাল জানালা ভেদ করে রুমে এসে পড়ছিল সাদা নরোম জ্যোৎস্না। নামাজ শেষ করতেই দেখালাম আকাশে বিশাল এক চাঁদ। পূর্ণিমা আসতে এখনো দুদিন বাকী। কিন্তু চাঁদ খুব নীচ দিয়ে যাচ্ছে বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছিল পাশের বিল্ডিঙের ছাদের উপর ঝুলছে বিশাল চাঁদ। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।হলরুমের লাইটটিও নিভিয়ে দিলাম। এবার চাঁদের আলোতে রুমটি ভরে উঠলো। পরিষ্কার, মোলায়েম, তীক্ষ্ণ প্রতিবিম্বিত আলো। নিজের আলো নয়। অন্যের ধার করা আলো। কী আশ্চর্য! আর তাতেই আমাদের মন প্রাণ ভরে উঠে। সরাসরি নিজের আলো হলে হয়তো অনেক তীক্ষ্ণ আর ঝাঁঝালো হতো। জ্যোৎস্না দেখে আমাদের মন ও প্রাণ যেমন সিক্ত হয়ে আসে, হয়তো তখন তা হতো না। সোফায় ঘুম পাড়ানো হয়েছে তিন মাসের আয়েশাকে। অপরদিকে ঘুমিয়ে আছে আড়াই বছরের বুশরা। ওদের ছোট্ট গায়ের উপর জ্যোৎস্না না পড়লেও চাঁদের আলোতেই ওদের ছোট্ট কচি মুখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। আমার নয় বছরের বড় মেয়ে জাহরা জেগে থাকলে হয়তো আমার পাশে বসে জ্যোৎস্না দেখত। আর গল্প শুনতে চাইতো। তার আবার প্রকৃতি, আকাশ, চাঁদ খুব প্রিয়। কখনো জানালা দিয়ে চাঁদ দেখতে পেলে জেগে থেকে বাবার কাছে গল্প শোনার আবদার করে।
আল্লাহর কী এক অপরূপ সৃষ্টি এই চাঁদ। প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কি মি দূর থেকেও চাঁদ অন্যের ধার করা আলো দিয়ে আমাদেরকে বিমোহিত করছে। আমরা তার রূপ দেখে মুগ্ধ হই। মনে ভাবাবেগ নিয়ে চাঁদকে দেখি। পৃথিবীর ৪৯ ভাগের এক ভাগ চাঁদ। এত দূর থেকেও চাঁদ কেবল আমাদের মনেই প্রভাব ফেলে না। তার টানে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয়। পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যা হলে পৃথিবীর তরল পদার্থের পরিবর্তন হয়। নদ-নদী, খাল-বিল আর সমুদ্রের পানি বেড়ে যায়। এমনকি কিছু মানুষের শরীরে লুকিয়ে থাকা কিছু বিশেষ রোগ-ব্যাথারও বৃদ্ধি ঘটায়।
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, চাঁদকে তিনি সৃষ্টি করেছেন যাতে আমাদের দিন ও মাস গণনায় সুবিধা হয়। কুরআনের একটি সুরার নাম আল-কামার বা চাঁদ। সূর্য এবং চাঁদের আলাদা বৈশিষ্ট আর তাই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনেও আল্লাহ পাক তাদের আলো এবং বৈশিষ্টকে আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ পাক সূরা ইয়াসিনের ৩৮ থে ৪০ নং আয়াতসমূহে ঘোষণা করেনঃ
“সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে।”
সুবহানআল্লাহ! আলাহ পাক মহাবিজ্ঞানী আর তাই তিনি বলেছেন সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। আর চন্দ্রের ব্যাপারে এমন কিছু বলেন নি। কেননা চন্দ্র তার অবস্থানে স্থির থেকে আপন বলয়ে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসে ২৯ দিনের একটু বেশী সময়ে। আর এ কারণে আমরা চাঁদের একই পাশ সব সময় দেখে থাকি। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে চাঁদের আবর্তন এক সময় এসে তার বলয়ের আবর্তনের সাথে মিলে এক হয়ে যায় আর একে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন Locked in Orbit.আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে তিনি আমাদেরকে এমন সুন্দর মনোমুগ্ধকর বস্তুসমূহ দিয়ে আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর এ সব কিছুই আবার আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রহমতে ধন্য। আল্লাহ হলেন রাব্বুল আলামীন আর নবীজি (দঃ) হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন!