লাইলাতুল কদর এক মহিমান্বিত রজনী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা সায়্যেদিনা নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আ’লা আলিহী ওয়া ওয়া আসহাবিহী ওয়া বারিকি ওয়া সাল্লিম।

লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর কি?

পবিত্র মাহে রমজান হল বছরের সেরা মাস। এ মাসকে যদি প্রশ্ন করা হয়, “হে মাহে রমজান, তুমি কেন এতো বরকতময় ও মহিমান্বিত?” এ রাত থেকে জবাব আসবে, “কারণ এ মাসেই আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। এ মাসেই রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ রজনী! শবে ক্বদর! যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম!” লাইলাতুল্ল ক্বদরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, “হে লাইলাতুল ক্বদর! তোমার কেন এতো মর্যাদা?” ক্বদর রজনী এক কোথায় উত্তর দেবে, “কারণ, এ রজনীতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে!” এবার কুরআনকে যদি প্রশ্ন করা হয়, “হে কুরআন! তোমার কেন এতো মর্যাদা?” কুরআন নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে, “কারণ, আমি কুরআনকে আল্লাহ পাক অন্য কোন জাতির উপর অবতীর্ণ না করে, তাঁর শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম সৃষ্টি নূরে মুজাসসাম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আল্লামের উপর অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ পাক নিজে হলেন, রাব্বুল ‘আলামীন আর তিনি হলেন রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন! তাঁর কারণে আমি কুরআন হেদায়েতের নূর এবং এতো মর্যাদাবান!” সোবহানআল্লাহ!

কুরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন,

“যদি আমি এই কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে আপনি দেখতেন যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।” (সূরা হাশর আয়াত-২১)

আর এই কুরআন অবতীর্ণ হবার রজনী লাইলাতুল ক্বদরের মহত্ত্ব বর্ণনা করেন আল্লাহ পাক নিজে অতি সুন্দর এবং মনোরম ভঙ্গীতে।

“আমি একে নাযিল করেছি শবে-ক্বদরে। শবে-ক্বদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-ক্বদর হল হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা শান্তি, যা ভোর উদয় হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” (সুরা ক্বদরঃ ১-৫)

মুহাদ্দিস ইবনে আবি হাতেম (রহঃ) তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন সাহাবায়ে কিরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) -দের বৈঠকে বনি ইসরাইলের এক মুজাদিদের কথা উল্লেখ করেন। যিনি এক হাজার মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন এবং আল্লাহর পথে জিহাদে কাটিয়েছেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরামের আফসোস হয় যে, এক হাজার মাস অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাস তো এ যুগের অনেকে জীবনও পায় না। তাই হযরত মূসা (আঃ)-এর উম্মত বনি ইসরাইলের মতো এতো অধিক সাওয়াব লাভের অবকাশও উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নেই। সাহাবায়ে কিরামের এ আফসোস-অনুশোচনাকালে হযরত জিবরাইল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআন মজিদের সূরা ক্বদর নিয়ে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আগমন করেন। আল্লাহ পাক ছোট্ট একটি সুরায় অতি সংক্ষেপে ক্বদর রজনীর মহত্ত বর্ণনা করেন এবং রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর খাতিরে উম্মতে মুহাম্মাদিকে মর্যাদাপূর্ণ এ রজনী উপহার দেন। উপরোক্ত ঘটনাটি তাফসীরে মাজহারিতেও অন্য সূত্রে স্থান পেয়েছে।

এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্বদরে নামায পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহীহ বুখারীঃ ১৯০১; মুসলিমঃ ৭৬০]

লাইলাতুল ক্বদর কোন রাত্রিতে?

কোন রাতটি লাইলাতুল ক্দর তা নিয়ে ‘আলেমদের মাঝে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। তবে রমজানের শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাত্রির ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্দর অনুসন্ধান কর।”[সহীহ বুখারীঃ ২০১৭; সহীহ মুসলিমঃ ১১৬৯]

এই রাতটি গোপন রাখার পেছনে রহস্য হল মুসলমানদেরকে রমজানের শেষ দশকের সবগুলো রাতে ‘ইবাদত-বন্দেগী, দোয়া ও যিকিরের উপর সক্রিয় রাখা।

অন্য এক রেওয়ায়েতে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ “(রমজানের শেষ) দশ রাত্রি শুরু হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারবর্গকে (ইবাদাতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।” [সহীহ বুখারীঃ ২০২৪; সহীহ মুসলিমঃ ১১৭৪]

উবাদা ইবনে সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘লাইলাতুল ক্দর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন। এ সময় দু’জন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ

“আমি তোমাদের ‘লাইলাতুল ক্দর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আশা করি উঠিয়ে নেয়াটা তোমাদের জন্য বেশি কল্যাণকর হয়েছে। তোমরা নবম (২১ তম), সপ্তম (২৩ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করো।”[উল্লেখ্য, উল্টো দিক থেকে গণনা করা হয়েছে। সহীহ বুখারীঃ ১৮৯৬; সহীহ মুসলিমঃ ২৬৪০]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোন রাতকে লাইলাতুল ক্দর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলীলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোন একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারীঃ হাদিস ১৮৮৯৪, ১৮৯৫; মুসলিমঃ ২৬৪৩, ২৬৪৪, ২৬৪৫)

সহীহ মুসলিমের কয়েকটি হাদিসে ২৭ রমজানে ক্বদর পাবার ব্যাপারে উবাই (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছয়ভাবে শপথ করেন। হাদিসটির শেষের অংশ নিম্নরূপঃ “তিনি (উবাই) ছয়ভাবে শপথ করে বললেন, ক্বদর নিশ্চয়ই সাতাশের রাতে। তখন আমি (যির, বর্ণনাকারী) বললাম, হে আবু মুনযির, আপনি একথা কোন সূত্রে বলছেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে যে আলামত বা নিদর্শন বলেছেন সেই সূত্রে। আর তা হলো – যে রাতে ক্বদর অনুষ্ঠিত হয় তারপর সকালে সূর্য উঠে তার কিরণ থাকেনা।” (সহীহ মুসলিমঃ ২৬৪৩, এমনকি ২৬৪৪ এবং ২৬৪৫ নং হাদিসগুলোও দেখুন)

কাজী খান মাআরিফুচ্ছানান কিতাবে শবে-কদরের ইবাদতের জন্য ২৭ তারিখের গুরুত্বারোপ করেছেন। তাফসীরে ইবনে কাসীরে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- ‘শবে-কদর নির্দিষ্ট দিনেই হয়ে থাকে’। ২৭তম রমজানে শবে-কদর পালনের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে হযরত আবু হানিফা (রহঃ)-এক মতে বলেছেন, কদরের ফজিলত বর্ণনা করে পবিত্র কুরআনে যে সূরায়ে কদর নাজিল হয়েছে, তাতে ‘লাইলাতুল কদর’ বাক্যটিতে ৯টি অক্ষর রয়েছে। আর তা মোট ৩ বার উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে ৩*৯=২৭ রমজানকেই আমরা শবে-কদর হিসেবে পালন করি।

লাইলাতুল ক্বদর চেনার কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে।

(১) ক্বদরের রাত পেরিয়ে যখন সকাল হবে, সেদিনকার সূর্যোদয় হবে সাদা হয়ে কিরণহীন অবস্থায়। হযরত উবায় ইবনে কাব (রাঃ) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘আর তার আলামত হলো সেদিনকার সকালের সূর্যোদয় ঘটবে সাদা আকারে, যার কোনো কিরণ থাকবে না।’ (বুখারীঃ ১৮৮৯)

অবশ্য এ আলামতটি কদরের রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সকাল বেলায় জানা যাবে। এর হেকমত (বা রহস্য) হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধানে বান্দাদেরকে অধিক পরিশ্রমী করে তোলা, এবং যারা এ রাতের ফযীলত পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছে তাদেরকে আনন্দিত করা।

(২) হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বুখারী ও মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কয়েকজন সাহাবী নিদ্রারত অবস্থায় দেখেন যে, লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ সাত দিনের মধ্যে অবস্থিত। রাসালুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি দেখছি যে তোমাদের স্বপ্ন লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ সাত দিনে হওয়ার ব্যাপারে এক হয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতে চায় সে যেন এই সাত দিনে তালাশ করে”। [সহীহ বুখারীঃ ৩য় খণ্ড, অধ্যায় ৩২ “তারাবী”, ১৮৮৮; সহীহ মুসলিমঃ ২৬২৭]।

এছাড়া বিভিন হাদিসে আরও কিছু (সহজে লক্ষণীয়) আলামত বর্ণিত হয়েছে—

(১) এই রাত অন্য রাতের তুলনায় অধিক উজ্জ্বল হবে।

(২) আকাশ পরিচ্ছন্ন এবং আলোকিত দেখা যাবে।

(৩) তারকারাজি খুব স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হবে।

(৪) এই রাতের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।

(৫) মৃদু-মন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।

(৬) এই রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।

(৭) এই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।

(৮) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।

(সূত্রঃ সহীহ ইবনু খুযাইমাহ, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)

হাক্কানী বুযুর্গানে কেরাম (রঃ) মনে করেন এই রাতে মানব এবং জ্বীন ছাড়া সমুদয় বস্তু সিজদায় নত হয়ে পড়ে। কাশফ্‌ এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এ বিষয়টি অবলোকন করেন।

আল্লাহ পাকের কাছে কায়মোনাবাক্যে আকুতি তিনি যেন আমাদেরকে যেন এ রাতে এবাদত করার তৌফিক দেন আমীন!

[সারারাত জেগে এ লেখাটি লিখেছি। মাঝে এশা আর তারাবীর জন্যে বিরতি নিয়েছি। এখন ফজরের সময়। পোস্টটি দিয়ে নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাবো। আল্লাহ যেন আমার এ পরিশ্রম কবুল করেন। লেখাটি পড়ে কেউ উপকৃত হলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। লিখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোস্ট করুণ। জাযাকাল্লাহ!]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment