– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
একজন নিরীহ নারী এবং পাঁচজন নরপিশাচ। মানুষরুপী পশু। পুলিশের পোশাকে পিশাচ। রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ এবং সকালে আদালতে সমর্পণ। পুলিশের ওসি ওসমান গনি পাঠান তাকে ধর্ষণ করেন। এরপর আরও ৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বাঁচতে নিরীহ ওই নারীর হাতে ৫ বোতল ফেনসেডিল ধরিয়ে দেন দায়িত্বরত পুলিশ। স্বাধীন দেশের পুলিশ। এটি পাকিস্তান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা কিংবা ভারত অধ্যুষিত কাশ্মির নয়। এটি প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এদেশেরই সন্তান এরা। আপনার আমারই ভাই-আত্মীয়। কিন্তু এমন কাজ করে যাচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধেই। এদেশেরই নিরীহ মানুষের উপর। কে নিরীহ আর কে সবল তা কিভাবে তারা জানবে? কাজেই সবল অনেক মানুষেরও এদের হাতে নিগৃহীত হবার খবর আসে মাঝেমধ্যে। এই নিয়ে কিছুদিন মানুষ বলাবলি করে এবং এক সময় তা ভুলে যায়। নতুন ইস্যু সামনে আসে। পুরাতন ইস্যু হারিয়ে যায়। একসময় অপরাধীও মুক্ত হয়ে নতুন ভিকটিম খুঁজে বেড়ায়। কেউ জানতেও পারে না অপরাধীর কি সাজা হয়েছে। অপরাধ খুব বেশি গুরতর হলে, ধর্ষণের পর হত্যা বা এরকম কিছু হলে, কেবল তখনোই জনগণ এর বিচার হয়েছে বলে জানতে পারে। তাও সব সময় নয়। এরপর একসময় সবকিছু পর্দার আড়ালে চলে যায়। গোপনে কি হয় তার খবর অনেকের কাছেই অজানা থেকে যায়।
ভেবেছেন ঘটনা এখানেই শেষ? একজন নারী রাষ্ট্রের নিয়োগ দেয়া জনগণের রক্ষকের দ্বারা এভাবে সম্ভ্রম হারিয়েই নিঃশেষ হবেন না। এর ফলশ্রুতি কি হতে পারে? নারীটি তিন সন্তানের জননী। তার সন্তানেরা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে, এখন না হলেও ধীরে ধীরে। স্বামী তাকে পরিত্যাগ করতে পারে। আত্মীয়-স্বজন এখন সহানুভূতি দেখালেও ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান পাল্টাতে থাকবে। ভাববে এবং বলবে নিশ্চয়ই এতে ওই নারীরও দোষ ছিল, না হলে এতো মানুষ চলাচল করে, তাকে কেন পুলিশ ধরল? দুষ্টু মনের মানুষগুলো যুক্তি খুঁজবে। বলবে, এক হাতে তালি বাজে না। ৫ বোতল ফেনসিডিলের মামলা থেকে খালাস পেতে পেতে তার সব শেষ হয়ে যাবে। তাকে প্রমাণ করতে হবে সেগুলো সে বহন করেনি, পুলিশই তাকে এগুলো দিয়েছে, ফাঁসানোর জন্য। বলা সহজ, আইনের চোখে এগুলো প্রমাণ করা ততোই কঠিন। পুলিশের গায়ে ইউনিফর্ম আছে। তার কথাই আইনের অংশ। যদিও সে মিথ্যাচার করে। আইন দেখবে প্রমাণ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পড়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে না। আদালতের প্রয়োজন হবে নিখুঁত প্রমাণ ও সাক্ষী। তা হাযির করতে না পারলে সে নারী এই মিথ্যা মামলা থেকে বের হয়ে আসতে হয়তো যুগের পর যুগ পার করবে। এক সময় যাতনা সইতে না পেরে আত্ম হননের পথ বেছে নেবে। ঠিক নির্বাচনের পর নোয়াখালীর ধর্ষিতা নারীর মতো। লজ্জা, অপমান, গঞ্জনা, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের বাঁকা কথা কাঁটার মতো যখন বিঁধতে থাকবে তখন সামনে একটাই পথ খোলা থাকবে, আত্মহত্যা।
কে নেবে এর দায়িত্ব? কি বিচার হবে সে নরপিশাচগুলোর? কবে হবে? কি শাস্তি পাবে তারা? এর উত্তর আপনাদের মতো আমারো অজানা।
RAB-এর গুলিতে পা হারানো লিমনের কথা ভুলে গেছেন? ২০১১ সালের মে মাসের ঘটনা। বাড়ির সামনে গরু আনতে গিয়েছিলেন সে কিশোর। কিন্তু RAB তাকে সন্ত্রাসী সাব্যস্ত করেই ছেড়েছে। মিথ্যা মামলা দিতে বেপরোয়া হয়ে যা দরকার তার সবই করেছে। আইন আদালত, মানবাধিকার কমিশন, সাধারণ মানুষ সবাই লিমনকে নিরাপরাধ মনে করলেও RAB তা করে নি। কারো কথায় তারা ভুরুক্ষেপও করে নি। তারা তাদের কাজ চালিয়ে গেছে। নিরাপরাধ একজন নাগরিক বিনা দোষে একটি পা হারিয়েই নিঃশেষ হয়নি, সরকারের করা মামলায় তিলে তিলে শেষ হয়েছে। জীবনের সব স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা তিলে তিলে হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। মানুষের সহানুভূতি এবং সহযোগিতা পেয়ে জীবনের হাল কিছুটা পরিবর্তন করতে পারলেও তার জীবন এখনো হুমকির উপর রয়েছে। ভুতের উপদ্রব বেড়ে গেছে দেশে। সেই লিমনের পুরো পরিবারের উপর আগের মতো এখনো হত্যার হুমকি উড়ে আসে।
২০১১ সালের জুলাই মাসের আরেকটি ঘটনা। হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। আরেক নরপিশাচ ওসি হেলাল। খিলগাঁও থানার তৎকালীন ওসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ছাত্র আব্দুল কাদেরকে রাতে হলে ফেরার পথে সেগুনবাগিচা দুদুক অফিসের সামনে থেকে গ্রেফতার করে। থানায় নিয়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করেছিল। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত আব্দুল কাদের কেবল বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। ওসি হেলালের একটু দয়া হয়েছিল, কাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, একেবারে জানে মেরে ফেলেনি। তবে শারীরিক ভাবে মারাত্মক জখম করার পরও মিথ্যা কিছু মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিল কাদেরকে। পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে এই একটি অস্ত্রের প্রয়োগ হয় খুব সহজেই। অন্য কোনো ইস্যু না পেলে ফেনসিডিল, ইয়াবা, ড্রাগ, অস্ত্র কিংবা সরকারি কাজে বাধা দেয়ার মিথ্যা মামলা হয় অহরহ। সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে এই মামলা থেকে রেহাই পেতে পেতে কয়েক যুগ কেটে যায় কারো কারো। জাহালমের কথা মনে আছে? এই মাত্র কিছুদিনের ঘটনা। বিনা অপরাধে একযুগ জেল খেটেছে।
আমি রাজনৈতিক মামলার কথা বলছি না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানী করতে সব দলই মিথ্যা এবং গায়েবী মামলার ঝর্ণা বহায়। সেগুলো রাজনৈতিক ভাবেই মুকাবিলা করা হয়। আমি বলছি সাধারণ মানুষের উপর এই মিথ্যা ও আজুগুবি মামলার ব্যাপারে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক পথেঘাটে চলাফেরা করতে গিয়ে এমন মিথ্যা মামলার শিকার হন। কেউ জানে না, কার পালা কখন আসে।
সব মানুষ খারাপ না, কিছু কিছু ভালো মানুষও আছেন, যদি তাদের সংখ্যা দিন দিন কমছেই। আপনি ভাবছেন আপনার উপর এগুলো আসবে না? আপনি সরকার দলীয় লোক, কিংবা রাজনৈতিক নেতার পরিবারের কেউ, কিংবা প্রশাসনের মানুষ, কিংবা পুলিশের লোক? মনে মনে ভাবছেন, আমার সন্তেনারা নিরাপই? কার এমন সাহস আমার আদরের সন্তানদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়? তাহলে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী অনেক মানুষও এমন হয়রানীর শিকার হয়েছেন। সরকার দলীয় এমপি নিজে টেলিফোন করেও পুলিশের এসপিকে চাঁদার হুমকি থেকে বিরত রাখতে পারেন নি। যেসব ঘটনা সামান্য ভুলের কারণে ফ্ল্যাশ হয়ে বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়ে, সেগুলো ভাইরাল হয়। যেসব ঘটনা আড়ালে ঘটে এবং প্রকাশ হয় না, সেসব ভিক্টিম তো সারা জীবনই ভোগেন।
আপনি, এই আপনি যিনি আমার এই লেখা পড়ছেন। হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আপনি আইনের মানুষ, আদালতের বিচারক, উকিল, আপনি রাজনৈতিক নেতা বা অঙ্গসংগঠনের বড় হোমরাচোমরা, আপনি সরকারের কাছের মানুষ, আপনি পুলিশের বড় অফিসার, আপনার নিজস্ব চেষ্টায় অনেক নিরীহ মানুষ মিথ্যা মামলার হয়রানী থেকে রেহাই পেতে পারে। হয়ত আপনার জীবনে এমন ঘটবে না মনে করছেন, জীবনে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আপনার না হোক, আপনার কাছের কেউ না কেউ এমন মিথ্যা মামলা ও হয়রানীর শিকার হতে পারে। একবার হয়ে গেলে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে আসতে এক জীবন চলে যাবে। লেভ তলস্তয়ের সেই “পুনরুত্থান” উপন্যাসের নায়কের একটি মাত্র ভুলের মতো, যে ভুলের প্রতিকার করতে তিনি সারা জীবন ঘুরেছেন, কিন্তু যা তিনি একটি কুলমের খোঁচায় করতে পারতেন তা সারা রাশিয়া ঘুরেও করতে পারেন নি। একটি মাত্র ভুলের কারণে এক নারী সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হন।
কাজেই এখন যা ঘটছে কিংবা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন অনেক কিছুর জন্যই আপনি আমি দায়ী, যদি আজ আমরা চুপ থাকি। আসুন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সচেতন হই। প্রতিবাদ করুন আপনার নিজ নিজ অবস্থান থেকে, নিজ সাধ্য মতো। দেখবেন পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে নিজ নিজ টাইমলাইনে পোষ্ট করুন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মতামত জানাবেন।]
Leave a Reply