প্রিয় নবীজী ﷺ সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্যে রহমত
==================
ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী
—
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে তাঁর প্রিয় হাবীব ﷺ কে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দেনঃ “হে হাবীব! আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।” নূরে মুজাসসাম হাবীবে পাক ﷺ হলেন “রাহমাতুল্লিল আলামীন”। অপরদিকে পবিত্র কুরআনের শুরুতে সুরা ফাতেহায় আল্লাহ নিজকে “রাব্বুল আলামীন” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি নিজে হলেন সমস্ত বিশ্বসমূহের রব বা প্রতিপালক আর তাঁর হাবীব ﷺ হলেন সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্য রহমত।
তিনি ﷺ কীভাবে সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্য রহমত?
——————
ওহাবী এবং আহলে হাদিসের মতবাদ অনুযায়ী রাসুল ﷺ “আমাদের মতই মানুষ!” তিনি আমাদের মতই মানুষ হলে এবং সুরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতে “নূর” দ্বারা রাসুল ﷺ এর হেদায়েতের নূরকে বোঝানো হলে তিনি তাঁর পরবর্তী মানবমণ্ডলীর জন্য, এবং আরও পরিষ্কার করে বললে যারা তাঁর হেদায়েতের আলোকে গ্রহণ করেছেন, কেবল তাদের জন্যই তিনি রহমত। রাসুল ﷺ আরবের মক্কায় জন্ম নিলেন ৫৭০ খৃষ্টাব্দে। তিনি তাঁর পূর্বের অতীত হওয়া মানবমণ্ডলীর জন্যে রহমত হলেন কীভাবে? এ প্রশ্ন আসাও স্বাভাবিক তিনি গাছপালা, তরুলতা, পশুপাখি, সমস্ত প্রাণীকুল, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকারাজিসহ সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত হলেন কিভাবে? এ রহস্যের জবাব পাওয়া যাবে কিছু হাদীসে। তার আগে জেনে নেয়া যাক সমস্ত বিশ্বসমুহ বলতে আমরা কতটুকু বুঝি!
বিশ্বভ্রম্মান্ডের পরিধি
——-
عالمين শব্দটি হল عالم এর বহুবচন। যার অর্থ হল বিশ্ব বা জগত। আর عالمين হল আল্লাহ পাকের সৃষ্টি জগতে যা কিছু রয়েছে সব কিছু। আল্লাহ পাকের সৃষ্টি জগত বলতে কতটুকু বোঝায়? আল্লাহ পাক অসীম এবং মহান তাই তাঁর সৃষ্টি জগত আমাদের ধারণার ও বাইরে। কুরআনের কিছু আয়াত এবং মি’রাজ সংক্রান্ত হাদিসগুলো থেকে ধারণা করা যায় যে, আল্লাহ পাক সাত আসমান আর সাত জমীন সৃষ্টি করেছেন। সাত আসমানের পর “সিদরাতুল মুন্তাহা” যা হযরত জিবরাঈল আঃ এর পক্ষে অতিক্রম করা অসম্ভব। এর পরে রয়েছে ৭০ হাজার নূরের পর্দা। এক পর্দা থেকে আরেক পর্দার দূরত্ব ৫০০ বছরের পথ। একেক পর্দা পার হতে আরও ৫০০ বছর। এভাবে ৭০ হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করার পর আরশে আজীম। সোবহান আল্লাহ! মি’রাজের রজনীতে এসমস্ত মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগতকে নিচে ফেলে আমাদের প্রিয় নবী ﷺ আল্লাহ পাকের দীদারে রওয়ানা হলেন কুরসীর দিকে। এরপর দুই ধনুক বা তার চেয়েও আরও নিকটে (সুরা নাজম)।
আমরা যে ধরাধামে বাস করছি তা হল আমাদের সৌরজগতের একটি গ্রহ মাত্র। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে আমাদের সৌরজগতে সর্বমোট ৮টি গ্রহ রয়েছে। প্লটোকে গ্রহের অবস্থান থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই সৌরজগৎ আবার একটি গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সে গ্যালাক্সির নাম হল মিল্কি ওয়ে। রাতের আধারে লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে নক্ষত্রসমূহ, ধুমকেত, ছায়াপথ আর মহাকাশের বিভিন্ন বস্তু সাদা ধবধবে উজ্জ্বল একটি রেখার মত ঝলঝলে রেখাপথ হয়ে আবর্তন করছে। ধবধবে উজ্জ্বল রেখাপথ হবার কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে মিল্কি ওয়ে। আমাদের সূর্য একটি নক্ষত্র, আর এমন একশ কোটি থেকে ৪ শ কোটি নক্ষত্র রয়েছে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পেয়েছেন যে, সমগ্র সৃষ্টি জগতে গ্যালাক্সির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১৭০ কোটি। একেকটি গ্যালাক্সিতে হাজার হাজার থেকে শুরু করে তিন লক্ষ কোটি পরিমাণ নক্ষত্র রয়েছে (তিন ট্রিলিয়ন)। সোবহান আল্লাহ! যা আমাদের ধারণারও অতীত! অতি সম্প্রতি, গত মে মাসে নাসার গবেষণায় জানা গেছে EGS-zs8-1 নামে সবচে’ দূরের গ্যালাক্সিটি আমাদের সৌরজগৎ থেকে ১৩শ কোটি আলোকবর্ষে দূরে অবস্থিত। তাহলে মহান রাব্বুল আলামীনের সমস্ত সৃষ্টি জগত কত বিশাল এবং বিস্তৃত হতে পারে তা কিছুটা অনুমেয়!
হাদীস অনুসারে তিনি ﷺ সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্য রহমত
———-
“হে জাবের, আল্লাহতালা সর্ব প্রথম সমস্ত বস্তুর পূর্বে তাঁর আপন নূর হতে তোমার নবীর নূর পয়দা করলেন। তারপর আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী সেই নূর পরিভ্রমণ করতে লাগল। ওই সময় না ছিল লউহে-মাহফুজ, না ছিল কলম, না ছিল বেহেস্ত, না ছিল দোজখ, না ছিল ফেরেশতা, না ছিল আকাশ, না ছিল পৃথিবী, না ছিল সূর্য, না ছিল চন্দ্র, না ছিল জিন জাতি, না ছিল মানবজাতি। অতঃপর যখন আল্লাহ্ তা‘লা অন্যান্য বস্তু সৃষ্টি করার মনস্ত করলেন, তখন ওই নূর কে চার ভাগ করে প্রথম ভাগ দিয়ে কলম, ২য় ভাগ দিয়ে লউহে-মাহফুজ, ৩য় ভাগ দিয়ে আরশ সৃষ্টি করলেন। অবশিষ্ট এক ভাগকে আবার চার ভাগে ভাগ করে ১ম ভাগ দিয়ে আরশ বহনকারী ফেরেশতা, ২য় ভাগ দিয়ে কুরশি, ৩য় ভাগ দিয়ে অন্যান্য ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন। ২য় চার ভাগের অবশিষ্ট এক ভাগ কে আবার পুনরায় চার ভাগ করে ১ম ভাগ দিয়ে আকাশ, ২য় ভাগ দিয়ে জমিন, ৩য় ভাগ দিয়ে বেহেস্ত-দুজখ সৃষ্টি করলেন। অবশিষ্ট এক ভাগ কে আবার চার ভাগে ভাগ করে ১ম ভাগ দিয়ে মোমেনদের নয়নের দৃষ্টি, ২য় ভাগ দিয়ে কালবের নূর তথা আল্লাহ্র মারেফত, ৩য় ভাগ দিয়ে তাদের মহবতের নূর তথা তাওহিদি কালেমা “লা ইলাহা ইল্লালাহু মহাম্মুদুর রাসুলাল্লাহ (সঃ)” সৃষ্টি করলেন এবং বাকি এক ভাগ দিয়ে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলেন।“
[মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, ভলি-০১, হাদীস নং-১৮; এই সহীহ হাদীসের কিতাবটি ইমাম বুখারী (রঃ) এর দাদা উস্তাদ মুহাদ্দীস আব্দুর রাজ্জাক (রঃ) কর্তৃক রচিত]
লক্ষ্যনীয়, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) থেকেও অনুরূপ আরেকটি বর্ণনা রয়েছে। সর্বপ্রথমে আল্লাহ পাক নূরে মুহাম্মাদী ﷺ সৃষ্টি করেন। এরপর সে নূরে মুহাম্মাদী ﷺ থেকে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেন। ফলে চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ধুমকেতু, ছায়াপথসহ বিশ্ব ভ্রম্মান্ডের প্রতিটি সৃষ্টি সেই নূরের বদৌলতে আলোকিত হয়েছে। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র সৃষ্টিকে বলা হয় পরমাণু। আর এই পরমাণুকে ঘিরে রয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও নিউক্লিয়াস। এগুলোর মধ্যে ইলেকট্রন হল আলো বা নূরে মুহাম্মাদীর আদি রুপ, যা না হলে আমাদের জগতের কিছুই চলতো না। সব কিছুই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো। প্রতিটি পরমাণুকে ঘিরে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন সৌরজগতের গ্রহের মত আপন আপন কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে।
আর এভাবেই আমাদের প্রাণপ্রিয় আঁকায়ে নামধার তাজেদারে মাদীনা নূরে মুজাসসাম হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ৫৭০ খৃষ্টাব্দে মানুষরূপে আরবে জন্ম নিয়েও তিনি হলেন সমস্ত বিশ্ব ভ্রম্মান্ডের জন্য রহমত। কারণ তাঁর নূর থেকেই সমগ্র জগত সৃষ্ট। সোবহান আল্লাহ!
ছন্দে বললে বলতে হয়,
আল্লাহ তুমি রাব্বুল আলামীন
(তোমার) হাবীব রাহমাতুল্লিল আলামীন!
(তোমার) হাবীব রাহমাতুল্লিল আলামীন!