বিদগ্ধ বাগদাদ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

১২৫৮ সালের ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ। আগুনঝরা ফেব্রুয়ারি না হলেও, বাগদাদ জ্বলছে। অসহায় খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহ বাধ্য হয়ে সৌন্দর্যময় বাগদাদের পতন অবলোকন করছেন। দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছরে ধরে যে বাগদাদ মুসলিম ঐতিহ্য আর অহংকার বুকে ধারণ করে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে অবলীলায় অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, সে বাগদাদ আজ পুড়ছে। নাপাক, অধার্মিক, মূর্খ, বর্বররা এর লালিত্য এবং রূপমাধুর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের তাণ্ডব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোন প্রাচীরও। মানুষ তো দূরে থাক। বাগদাদের সীমান্ত প্রাচীর এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সবার আগে। যাতে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বাগাদাদের চারপাশে খন্দক খনন করা হয়েছিল। আক্রমণ করা হয়েছিলো ফোরাত নদীর পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় দিক থেকে। এরপর একে একে এরা ধ্বংস করে চলেছে অট্টালিকা, রাজপ্রাসাদ, সরকারী ভবন, ব্যক্তিগত আবাস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এমনকি গ্রন্থাগার এবং যাদুঘরও।

ফোরাত নদী পার হবার জন্য মূর্খেরা বায়তুল হিকমাহ থেকে প্রায় এক লক্ষ কিতাব নদীতে ছুঁড়ে ফেলে পারাপারের ব্যবস্থা করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরব মুসলমানরা গ্রীক এবং প্রাচীন যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগণিত বই অনুবাদ করে এবং মৌলিক অসংখ্য কিতাবাদি রচনা করে সারি সারি সাজিয়ে ছিলেন গ্রান্থাগারগুলো, হিংসার আগুনে এক নিমিষেই তা পুড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে গেল। কিতাবের কালি আর বাগদাদবাসীর রক্তে রঞ্জিত হলো ফোরাত নদী। প্রায় আট লক্ষ মানুষের রক্তের স্রোত বহন করার যেন ক্ষমতা ছিল না ফোরাতের। তবু ফোরাত নদী তা বহন করে নিচ্ছিল। আর খলীফাকে বাধ্য করা হয়েছিলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ধ্বংসলীলা অবলোকন করতে। চোখের সামনে নিজের পুত্র, কন্যা, স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, আমীর-উমরাহ্‌ আর চেনা-অচেনা প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ বাগদাদবাসীকে ধরে ধরে জবাই করা হচ্ছিলো। খলীফা নিরুপায় হয়ে তা দেখছিলেন। যে আব্বাসীয় খলীফাদের হুংকারে পিপীলিকাও সাবধানে পদ চলতো, সে বাগদাদের সর্বশেষ খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহ আজ বন্দী, অসহায়, নিরুপায়, শোকে মুহ্যমান।

খলীফা আজ পরাজিত, লজ্জিত। ধ্বংসলীলার নায়ক আজ ভিনদেশী। নাম হালাকু খান। চেঙ্গিস খানের নাতি। বিশ্ব এদেরকে চিনে রক্তপিপাসু খান হিসেবে। যে দেশেই এরা পা রেখেছে, সে দেশেই চালিয়েছে ধ্বংসলীলা। হত্যা করেছে অসহায় নিরস্ত্র নাগরিকদের। কথিত আছে চেঙ্গিস খান একাই হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছিলেন। ফলে বিভিন্ন দেশে তার অবৈধ বংশধর অগণিত। সেই চেঙ্গিস খানেরই দৌহিত্র হালাকু খান। ধ্বংসলীলা আর অত্যাচারে পাষণ্ড দাদার চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না সে। সভ্যতার ধ্বংস আর অন্য জাতিকে পদাবনত করার নেশায় এরা সেই সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পারি দিয়ে একে একে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী দখল করে নিয়েছিল। কথিত আছে, বাগদাদের অবরোধের আগে পারস্য ধ্বংস করেছে হালাকু খান। খলীফাকে আহ্বান জানিয়েছিল তাকে সাহায্য করার। খলীফা এতে কর্ণপাত করেন নি। উপরন্তু তিনি সাদ্দাম হোসেনের মত হুংকার দিয়েছিলেন, হালাকু খানের রক্ত দিয়ে গোসল করবেন। আরবেরা স্থান-কাল-পাত্র ভেদ লক্ষ্য করে না। স্বভাবজাত একটা হুঙ্গার দেয়া চা-ই চাই। এটাই তাঁর জন্য কাল হয়েছিল। যেমন কাল হয়েছিলো সাদ্দামের জন্য। ঠিক যেভাবে যৌথবাহিনী একবিংশ শতাব্দীতে সাদ্দামের পতনের লক্ষ্যে ধ্বংস করেছিলো বাগদাদ, ঠিক তেমনি ত্রয়োদশ শতাব্দীদের হালাকু খান বিভিন্ন অমুসলিম জাতি ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী নিয়ে ধ্বংস করেছিলো বাগদাদ। সেখানেও ছিল ইউরোপের ক্রুসেডার, আর্মেনীয়, তুর্কি এবং অন্যারা। সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে জেরুজালেম ১১৮৭ সালে জেরুজালেম হারিয়ে খৃষ্টানরা হয়ে গিয়েছিল দিশেহারা। এর প্রতিশোধ নিয়েছিল হালাকু খানের বাহিনীতে যোগ দিয়ে। পার্থক্য ছিল আমেরিকার নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ২ লক্ষ ইরাকি সৈন্যকে, আর হালাকু খানের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় আট লক্ষ নিরস্ত্র অসহায় বাগদাদবাসীকে। তবে আমেরিকার অবরোধ এবং দখলের ফলে পরবর্তীতে আরো প্রায় ১৫ লক্ষ ইরাকী প্রাণ হারায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আফসোস!

বাগদাদ অবরুদ্ধ হবার আগে খলীফাকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিলো। খলীফা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১১ জানুয়ারি হালাকু খানের দেড় লক্ষ সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে খলীফার ঈমানী জজবা রহিত ২০ হাজার  হস্তীবাহিনী শোচনীয় পরাচয় বরণ করে। খলীফা নিরুপায় হয়ে এবার নিজে থেকেই সন্ধির প্রস্তাব দেন, কিন্তু রক্তপিপাসু মঙ্গোলেরা তা ফিরিয়ে দিয়ে বাগদাদ অবরোধ করে বসে। ২৯ জানুয়ারি থেকে চলে অবরোধ। শহরের ৩০০০ গণ্যমান্য ব্যক্তি এ সময় শেষ চেষ্টা হিসেবে হালাকু খানের সাথে আলোচনার জন্যে যান। তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্য করা হয়। ১০ তারিখ বাগদাদ আত্মসমর্পণ করে। হালাকু বাহিনী এক সপ্তাহ ধরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। কথিত আছে, নারী-পুরুষ, শিশু এমনকি বৃদ্ধকে লাইনে দাঁড় করিয়ে একেক করে জবাই করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে যারা গর্ত করে মাটির নিচে লুকাতে পেরেছিলেন, কেবল তারাই রক্ষা পেয়েছিলেন। পালাতে গিয়েও হত্যার শিকার হন অগণিত মানুষ। সভ্যতার ইতিহাসে পৃথিবী এর আগে এরকম হত্যাকাণ্ড খুব কমই অবলোকন করেছে।

সর্বশেষে, খলীফাকে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর রাজকোষের সন্ধান দেবার জন্য। খলীফা একে একে সব বের করে দেন। হালাকু খান এতেও সন্তুষ্ট হয় না। জিজ্ঞেস করে সেগুলো কোথায় যেগুলো গোপন স্থানে রাখা হয়েছে! খলীফা তাঁর প্রাসাদের মধ্যখানে সুড়ঙ্গে রাখা হিরা, মণি, মানিক্য, জহরত, মুক্তা, সোনা, রুপা বের করে দেন। এবার খলীফাকে একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। তিনি খাবার চাইলে দেয়া হয় এক থালা হিরা-জহরত। খলীফা জিজ্ঞেস করেন, ‘এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?’ হালাকু খান উত্তর দেয়, ‘এগুলো খাবে, তুমি তোমার মানুষদের না দিয়ে এসব জমিয়ে রেখেছ, এখন এগুলো খাও!’ খলীফা উত্তর দেন, এগুলো কি খাবার জিনিস?’ হালাকু খানের উত্তর, ‘এগুলো খাবার জিনিস না হলে জমিয়ে রেখেছ কেন? তুমি যদি এসব তোমার লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিতে, আজ তারা তোমার পক্ষে লড়াই করতো।’ খলীফা উত্তর দেন, ‘এসব আল্লাহ্‌ কুদরত।’ হালাকুর উত্তর, ‘আসো দেখাই আল্লাহর কুদরৎ কাকে বলে।’

হালাকু বিশ্বাস করতো, খলীফা ছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃবংশের। তাছাড়া রাজবংশীয় কারো রক্ত ঝরালে অমঙ্গল হবে মনে করতো। তাই খলীফাকে কার্পেটে মুড়িয়ে সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হয় উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দেবার। ঘোড়ার খুঁড়ের আঘাতের পর আঘাতে খলীফার নির্মম মৃত্যু হয়। জানা যায় কেবলমাত্র খলীফার এক শাহজাদাকে বন্দী হিসেবে মঙ্গোলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি বিয়ে করেন এবং সন্তানাদি জন্ম দেন। লুণ্ঠিত সব সম্পদ হালাকু খান তার সৈন্যদের মাঝে বিতরণ করে দেয়। মানুষের দেহের দুর্গন্ধে বাগদাদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। হালাকু খান তাই এ ধ্বংসস্তুপের শহর ছেড়ে চলে যায়। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে এ শহর বিরানভূমি হিসেবে পড়ে থাকে। এক সময় যে শহর ছিল সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সে শহর রূপান্তরিত হয় পচা দুর্গন্ধময় ভূতুড়ে ভূমিতে। আজকের মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলমানদের মতো তখনো বাগদাদের মুসলমানদের ভাগ্যে জানাজা, কাপন এবং কবর জুটেনি। ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং ঐক্য বিনষ্ট হবার ফল ভোগ করেছে পুরো বাগদাদবাসি, কেবল শাসকগোষ্ঠী নয়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। বর্তমান বিশ্বেও মুসলমানরা ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরার পরিবর্তে তারা ধরে আছে মিথ্যা, মরীচিকাময় বিধর্মীদের লাগাম। এ লাগাম তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

[সেই ধ্বংস নিয়ে আসছে পরবর্তী পর্ব, হযরত নেমাতুল্লাহ শাহ অলি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। ভবিষ্যৎবাণীটি তিনি লিখেছিলেন হিজরী ৫৪৮ মোতাবেক ১১৫২ খ্রিস্টাব্দে। সাথেই থাকুন।] 

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment