ইয়াজিদ কি ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী?

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।
– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

মনে হচ্ছে আমাদের মাঝে ইয়াজিদের যুগ আবার ফিরে এসেছে। ইদানিং কিছু ইয়াজিদ-পন্থী দল ফতুয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে যে ইয়াজিদ নাকি তার পিতার পর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিল। অপরদিকে ইমাম হুসেইন রাদ্বিয়াল্লহু তা’লা আনহু নাকি ছিলেন ন্যায়সঙ্গত বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী, নাউজুবিল্লাহ! এদের মধ্যে সৌদিপন্থী নজদি-ওয়াহাবী, আহলে হাদিস, লা-মাজহাবীরা রয়েছে। সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির একটি ভিডিও গত পোস্টে দিয়ে তাদের এরকম ঈমানহরণকারী দাবীর সত্যতা প্রমাণ করেছি। তাদের এই দাবীর পক্ষে তারা সূরা নিসার ৫৯ আয়াত (হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো আর আনুগত্য করো রাসুলের এবং তোমাদের অন্তর্গত ‘ঊলুল আমর’ তথা আদেশ দাতাগণের।) এবং নিম্নের হাদিসটির রেফারেন্স দিয়ে থাকে।

হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাঃ রাসুলুল্লাহ (সাআল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ননা করেন, “আমার পরে এমন কিছু শাসক আসবে যারা আমার হেদায়েত অনুসরণ করবেনা এবং আমার সুন্নাহও মানবেনা। তাদের মধ্যে কারো কারো শরীর হবে মানুষের, কিন্তু মন হবে শয়তানের।” হুযায়ফা প্রশ্ন করলেন, “সেই সময় আমি থাকলে আমার কি করা উচিত?” তিনি (দঃ) জবাব দিলেন, “তোমার উচিত হবে তার কথা শোনা এবং মান্য করা, যদিও সে তোমাকে কষ্ট দেয় এবং তোমার ধনসম্পদ কেড়ে নেয়।” [মুসলিমঃ ৪৬৩৪]

অন্য রেওয়ায়তে রয়েছে যে, “তোমরা শাসকের ততক্ষন পর্যন্ত আনুগত্য করো যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখ যে সে কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে যা সম্পর্কে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণ বর্তমান রয়েছে।” [মুসলিমঃ ৪৬২০]

শাসক কেবলমাত্র কুফরীতে নিমজ্জিত হলেই তার বিরুদ্ধাচারণ করা যায়। অন্যথা শাসক যেই হোক তার আনুগত্য করতে হবে। তবে আসুন তাহলে সহীহ হাদীস এবং ইতিহাসে কষ্টিপাথরে বিশ্লেষণ করে দেখি ইয়াজিদ কি সত্যিকার অর্থে ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিলেন নাকি অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল করায় ইমাম হুসেইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আহলে বায়েত বিদ্বেষী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদকে হটিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন।

সহীহ বুখারির নিম্নোক্ত হাদিসটি ইমাম আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর পর ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর খিলাফতকালের একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দেয়। শৌর্য, ঐশ্বর্য, ক্ষমতা থাকার পরও একমাত্র শান্তির লক্ষ্যে ইমাম হাসান (রাঃ) ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।

হাসান (বসরী) (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, হাসান ইবনু আলী (রাঃ) পর্বত সদৃস সেনাদল নিয়ে মু’আবিয়া (রাঃ)-এর মুখোমুখি হলেন। আমর ইবনুল আস (রাঃ) বললেন, আমি এমন সেনাদল দেখতে পাচ্ছি যারা প্রতিপক্ষকে হত্যা না করে ফির যাবে না। তখন মু’আবিয়া (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! ‘হে ‘আমর! এরা ওদের এবং ওরা এদের হত্যা করলে আমি কাকে দিয়ে লোকের সমস্যার সমাধান করব? তাদের নারীদের কে তত্ত্ববধান করবে? তাদের দূর্বল ও শিশুদের কে রক্ষণাবেক্ষণ করবে? তারপর তিনি কুরায়শের বানূ আবদে শামস শাখার দু’জনঃ আব্দুর রহমান ইবনু সামুরাহ ও আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-কে হাসান (রাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা উভয়ে এই লোকটির কাছে যাও এবং তার কাছে (সন্ধির) প্রস্তাব পেশ করো, তাঁর সঙ্গে আলোচনা করো ও তার বক্তব্য জানতে চেষ্টা কর।’ তারা তার কাছে গেলেন এবং তার সঙ্গে কখা বললেন, আলাপ-আলোচনা করলেন এবং তার বক্তব্য জানলেন। হাসান ইবনু আলী (রাঃ) তাদের বললেন, ‘আমরা আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান, এই সম্পদ (বায়তুল মাল) আমরা পেয়েছি। আর এরা রক্তপাতে লিপ্ত হয়েছে।’ তারা উভয়ে বললেন, (মু’আবিয়া) আপনার কাছে এরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন। আর আপনার বক্তব্যও জানতে চেয়েছেন ও সন্ধি কামনা করেছেন। তিনি বললেন, ‘এ দায়িত্ব কে নেবে?’ তারা বললেন, ‘আমরা আপনার জন্য এ দায়িত্ব গ্রহণ করছি।’ এরপর তিনি তাদের কাছে যে সব ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন, তারা (তার জওয়াবে) বললেন, ‘আমরা এ দায়িত্ব নিচ্ছি।’ তারপর তিনি তাঁর (মু’আবিয়ার) সাথে সন্ধি করলেন। হাসান (বসরী) (রহঃ) বলেন, আমি আবূ বাকরা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ রাসূলুল্লাহ (দঃ)-কে আমি মিম্বরের উপর দেখেছি, হাসান (রাঃ) তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার এ সন্তান নেতৃস্থানীয়। সম্ভবত তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংশা করাবেন।’ আবূ আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আলী ইবনু আবদুল্লাহ আমাকে বলেছেন যে, এ হাদীসের মাধ্যমেই আবূ বাকরা (রাঃ) থেকে হাসানের শ্রুতি আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে।
[সহীহ বুখারীঃ ২৫২৩]

হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সুবিশাল সৈন্যবাহিনী থাকার পরও তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথা চিন্তা করে মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি পরিহার করেছিলেন। আর এ কারণেই হযরত হাসান (রাঃ) কে গাউসুল আজম হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়। আমীর মু’আবিয়ার সাথে সন্ধি করে তিনি মুসলমানদের দু’টি বড় দলে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু কি ছিল ওই সন্ধিতে? ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে ওই সন্ধির প্রধান শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপঃ

১। তাঁর (আমীর মুয়াবিয়ার) কাছে এই শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে যে তিনি কুরআন, সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণে খেলাফত পরিচালনা করবেন।
২। আমীর মু’আবিয়া (রাঃ) এর পর ক্ষমতা ইমাম হাসান (রাঃ) এর নিকট হস্তান্তরিত হবে। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে ক্ষমতা ইমাম হুসেইন (রাঃ) এর নিকট হস্তান্তরিত হবে। অন্যকে মনোনয়ন দেবার কোন অধিকার আমীর মু’আবিয়ার নেই।
৩। আমীর মু’আবিয়াকে আমীরুল মু’মেনীন ইমাম আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি লানত বর্ষণ বন্ধ করতে হবে। যা তিনি জুমার খুতবায় প্রচলন করেছিলেন। ভাল উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ইমাম আলী (রাঃ) এর নাম নেয়া যাবে না।
৪। আমীর মু’আবিয়া কুফার কোন সম্পদ পাবেন না, যার পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ দিরহাম। ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে এই সম্পদের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বছরে ইমাম হুসেইন (রাঃ) কে দশ লক্ষ দিরহামের বৃত্তি দেবেন। বায়তুল মাল বণ্টনে তিনি বনি আল-শামসের চেয়ে বনি হাশিমকে গুরত্ব দেবেন। দশ লক্ষ দিরহাম সিফফিন এবং উষ্ট্রের যুদ্ধে নিহতদের পরিবারের মাঝে বিতরণ করে দিবেন।
৫। আল্লাহর জমিনে সাধারণ মানুষ যেখানেই থাকুক, তারা যেন নিরাপদে থাকে। আমীর মু’আবিয়া তাদের নিরাপত্তা দেবেন। তিনি কোনভাবেই, গোপনে বা প্রকাশ্যে, ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন কিংবা আহলে বায়েতের কারো বিরুদ্ধে কোন ধরণের কপটতার আশ্রয় নেবেন না।

তথ্য সুত্রঃ
১। The Succession to Muhammad: A Study of the Early Caliphate By Wilferd Madelung Page 232
২। al-Hadid, Ibn Abu. Sharh Nahj al-Balagha, vol. 4. p. 6.
৩। al-Asqalani, Ahmad Shahab al-Din. al-Isaba fi Tamiiz al-Sahaba, vol. 2. pp. 12, 13.
৪। al-Dinawari, Ibn Qutayba. al-Imama wa al-Siyasa. p. 150
৫। Wajdi, Farid. Dairat al-Marif al-Islamiya, vol. 3. p. 443.
৬। al-Dinawari, Ibn Qutayba. al-Imama wa al-Siyasa. p. 200

তাহলে বোঝা গেল, আমীর মু’আবিয়া (রাঃ) এর মৃত্যুর পর চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম খেলেফতের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিলেন ইমাম হুসেইন (রা) যেহেতু এরই মধ্যে ইমাম হাসান (রাঃ) কে বিষ পানে হত্যা করা হয়েছিল। আমীর মু’আবিয়া চুক্তির শর্ত ভংগ করে নিজ অযোগ্য পুত্রকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী নিয়োজিত করে গিয়েছিলেন যা ছিল অবৈধ। আর ইয়াজিদের শাসনামলে মদিনায় মসজিদে নববী (দঃ) কে আস্তাবলে রূপান্তরিত করা, অসংখ্য সাহাবা (রাঃ) কে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ নির্যাতন চালানো এবং পবিত্র মক্কায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ক্বাবা ঘরে পর্যন্ত আক্রমণ করা কোন মুমিনের কাজ হতে পারে না। এসব ঘটনা প্রমাণ করে সে কুফরে নিমজ্জিত ছিল। কারণ হারামাইন শারীফাইনে হত্যাযজ্ঞ চালালে তা সরসরি কুরআনের আইনকে অমান্য করা হয়।

আর আহলে বায়েতের অন্যতম সদস্য হিসেবে ইসলামকে সত্যের পথে রাখা ছিল ইমাম হুসেইন (রাঃ) এর দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনের চেষ্টার ফলেই মুসলমানরূপী কিছু নরপশুর দ্বারা তিনি এবং তাঁর ৭২ সঙ্গী শাহাদত বরণ করেন। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, কুফবাসীই এর জন্য দায়ী, কেননা তারা চিঠির পর চিঠি দিয়ে ইমামকে কুফা নিয়েছিল আবার তারাই তাঁকে পরিত্যাগ করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো। কিন্তু তারা ভুলে যান যে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর দোষের চেয়ে সেনা প্রধান আর যুদ্ধের আদেশ দাতার দায়িত্ব থাকে সবচে’ বেশী। কাজেই কোন মিথ্যাচার দিয়েই ইয়াজিদকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের দায়ভার থেকে রেহাই দেয়া যাবে না। ইয়াজিদী মুসলমানগণ আবার নতুন ফন্দি আঁটছে। তারা বলছে, ইয়াজিদ নাকি মৃত্যুর পূর্বে কারবালার ঘটনার জন্যে অনুশোচনা করে গেছেন। তাদেরকে ফেরাউনের ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই। ফেরাউনও মৃত্যুর ঠিক পূর্বে মুসা (আঃ) এর আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। কিন্তু আল্লাহ বলছেন তার এই ঈমানের কোনই মূল্য নেই। কেননা সময় থাকতে সে অহংকারী ছিল। সময় ফুরিয়ে গেলে কোন অনুশোচনাই আর কাজে আসেনা। ইয়াজিদের ক্ষেত্রে এ উদাহরণ ষোল আনাই প্রযোজ্য। 

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

1 thought on “ইয়াজিদ কি ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী?”

Leave a Comment