বিশ্ব-সংস্কৃতির মিলন-মেলা লন্ডন
===================
ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী (https://www.facebook.com/DrMiaji)
শেক্সপেয়ার, ডারউইন, স্টিফেন হকিংসের শহর লন্ডন এখন নানা রঙের আর নানা জাতের মানুষের মিলন-মেলা। বিভিন্ন দেশ থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পাড়ি দেয়া মানুষের ভিড় জমতে জমতে লন্ডন যেন এখন কেবল বিদেশি আর ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরই দেশ। দিনের আলোতে শ্বেতাঙ্গ ইংলিশ কালেভদ্রেই চোখে পড়ে। রাতের আঁধারে তো এ…দের দেখা মেলাই ভার। যে লন্ডনের জেনারেলরা দাপটের সাথে বিশ্বকে দাবিয়েছে, আজকে তাদের সেই লন্ডনে তাদের উপস্থিতিই নগন্য। শহরের কোলাহল, অতিরিক্ত মানুষের চাপ, ব্যবসা-বানিজ্যে বিদেশীদের দখল ক্রমে স্বেত ইংলিশদেরকে পশ্চিম লন্ডন কিংবা শহরের বাইরে নির্জন প্রান্তরে পাঠাচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে দোকানপাঠ দেখলে তো মনেই হয়না ভিন্ন কোন দেশে হাঁটছি। মনে হবে উপমহাদেশের কোন ব্যস্ত শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দোকানের ধরণ, মানুষের পোশাক, কথা বলা, চলার ভঙ্গী – সব অহংকারী ইংলিশদের চেয়ে ভিন্ন। জানিনা আজ থেকে কয়েকশ বছরের আগের ইংলিশ-ম্যানরা আজকের লন্ডন দেখলে কী বলতেন!
লর্ড ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে আম্রকাননে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে উপমহাদেশের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়ের মাধ্যমে। আজ তার নিজের শহর এক অর্থে সেই ভারতবাসীর দখলে। রাজনৈতিক দখল নয়। এ এক অন্যরকম দখল। লন্ডন থেকে এখন প্রচারিত নন-ইংলিশ টিভি চ্যানেলের সংখ্যা অগণিত। কেবলমাত্র বাংলা ভাষাতেই রয়েছে ৬টি। হিন্দি, গুজরাটি, তামিল, উর্দু, পাঞ্জাবি, মালায়ামসহ এমন কোন ভাষা বাকী নেই যেই ভাষায় টিভি কিংবা রেডিও চ্যানেল নেই। তবে এসব চ্যানেলে অনুষ্ঠানের মান সব সময় আকাংখিত পর্যায়ের হয়না।
মাওলানা সাঈদীর আমৃত্যু কারাবরণের রায়ের দিন লন্ডনের বাংলা রেডিও প্রায় এক ঘণ্টার একটি তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করেছিল। বলাবাহুল্য, প্রথমে মনে হয়েছিল ঢাকার রাস্তায় কোন ক্যানভাসার কিংবা মজমার বক্তা কিছুটা হাস্যরসাত্মক, কিছুটা কৌতুকপূর্ণ লেকচার দিচ্ছিল। পরে বুঝলাম অনুষ্ঠান উপস্থাপকের স্বাভাবিক কণ্ঠই এরকম।
ভিন দেশিদের লন্ডনে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব লন্ডনের মসজিদটি (Eas London Mosque)। তাও আবার এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত বাঙালি মুসলমানদের দ্বারা। ব্যস্ত লন্ডনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে পায়ে হেঁটে সামান্য পূর্বদিকে গেলেই দেখা মিলবে পূর্ব লন্ডন মসজিদের। মসজিদের সাথে রয়েছে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আর পাঠাগার। জোহর নামাজ পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম এর মুসুল্লিদের বেশিরভাগই আবার বাঙালি ব্রিটিশ। তবে মসজিদে ঢুকতেই হোঁচট খেলাম এর প্রধান ফাসাদে কেবল মহান আল্লাহ পাকের নাম দেখে। পরক্ষণেই মনে পড়ল এই মসজিদটি উপমহাদেশের জামাত-ই-ইসলামীর অনুসারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের আক্বীদা আর বিশ্বাসের ছাপ এর প্রধান ফাসাদেই দৃশ্যমান। তাদের আলেমদের মতে আল্লাহ এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একসাথে পাশাপাশি লিখা যাবেনা। এটা নাকি আল্লাহ পাকের শানের সাথে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শানকে এক করে ফেলা হয়। তাদের আক্বীদা মতে এতে শিরক হয়। মৌ-লোভী তারেক মনোয়ারের এরকম একটি বক্তব্যের ভিডিও কিছুদিন আগেও ইন্টারনেট আর ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল। তার মতে কালেমা তায়্যেবা (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ দঃ) পাশাপাশি লিখলেও নাকি শিরক হয়। নাউজুবিল্লাহ! অথচ মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, মসজিদে হারাম আর মসজিদে নববী (দঃ) এ অসংখ্য স্থানে আল্লাহ পাকের নামের পাশে নবীজি (দঃ) এর নাম মুবারক শোভা পাচ্ছে। মসজিদে নববীতে আবার প্রতিটি ঝুলন্ত বাতিতে কালেমা তায়্যেবা একসাথে লিখা। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ঈমান হরণ করার এ এক অপকৌশল মাত্র।
পূর্ব লন্ডন মসজিদ থেকে ব্রিক লেইন মসজিদ কিংবা আরও পূর্ব দিকে যতই যাওয়া যাক না কেন, মনে হবে এ শহর কখনো কোন ইংলিশের দখলে ছিল না। পুরনো দুতলা ব্রিটিশ-স্টাইল বাড়ীগুলো এখন বিদেশি, বিশেষ করে উপমহাদেশের মানুষের দখলে। এসব বাড়িতে কোন এক সময় সরব পদচারনা ছিল ইংলিশ পরিবারগুলোর। বাড়ীগুলোর গঠন দেখে অনুমান করা যায় ইংলিশরা আত্মগরিমায় ভরপুর। একই ফটক দিয়ে যাতে অন্য পরিবারের কাউকে যেতে না হয় সেজন্য উভয় তলা মিলিয়ে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন এপার্টমেন্ট। অর্থাৎ একতলায় যে বা যারা বাস করবে, দুতলাও তাদেরই থাকবে। নীচ তলায় রান্না ঘর আর বসার ঘর। উপরে সচরাচর শোবার ঘর। বাড়ির সামনে এক চিলতে জমির উপর আবার সব পরিবারের জন্য আলাদা সবজি বাগান।
চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস অলিভার টুইস্ট-এর (১৮৩৮) গল্পে মুসলমানদেরকে, বিশেষ করে আরবদেরকে দেখানো হয় ঘৃণ্য জাতি হিসেবে। “আরব” এ শব্দটির মাঝেই যেন শত ঘৃণা। কেউ কোন আরবের সাথে মিশছে, এটাই কোন ইংলিশ সমাজ এবং পরিবারের চোখে তাকে হেয় করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আঠারো শতকের সমাজ থেকে আজকের ব্রিটিশ সমাজের পার্থক্য অনেক। তখন সব কিছুই ছিল ইংলিশদের দখলে আর মুসলমান ছিল তাদের চাকর, দাস কিংবা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কোন কলোনির বাসিন্দা। বর্তমানেও মুসলমান ঘৃণ্য, তবে তারা এখন বেশ দাপটের সাথে ইংলিশদের সেই শহরে ঘুরে বেড়ায়। সেদিনের সেই একক শ্বেতাঙ্গ পাইক-পেয়াদার স্থলে এখন কোথাও কোথাও জায়গা হয়েছে বাঙালি মেয়র, এমপি আর কাউন্সিলরদের। একদিনের সেই একক শ্বেতাঙ্গ রাজনীতির দাপট এখন ছড়িয়ে পড়েছে নানা জাতির মানুষের মাঝে। ফলে স্টান্সটেড (Standsted) বিমানবন্দরের মত একটি সাধারণ বিমানবন্দরেও স্থান পেয়েছে নামাজের জন্যে আলাদা জায়গা। যা হয়তো কোনোদিন কেউ কল্পনাও করেনি।
লন্ডন শহরের যাদুঘরগুলোতে এখনো দেখা মিলে তাদের উপনিবেশবাদের ঘৃণিত ইতিহাস। বিশেষ করে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, National Maritime Museum, Imperial War Museum। কিছু কিছু জাদুঘরে আলাদা করে উপমহাদেশকে সাজান হয়েছে। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের লুট করে আনা সোনা-দানা, গয়না, মুকুট, মুর্তি, তৈজসপত্র দিয়ে সাজান হয়েছে একেকটি হল। উপনিবেশবাদ এখন নতুন রূপ নিয়েছে। Madame Tussaud-এ এখন আবার স্থান পেয়েছে ভারতের নামি-দামি তারকাদের মোমের মুর্তি। এদের মধ্যে রয়েছেন অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সাল্মান খান, ঋত্বিক রোশান, ঐশ্বরিয়া রায়, কারিনা কাপুর প্রমুখ। ব্রিটিশরা এক সময় আমাদের ভুমি শক্তি দিয়ে দখল করে আমাদের সম্পদ লুট করেছিলো। আর আজ আমরা আমাদের মেধা এবং বুদ্ধি দিয়ে তাদের শহর দখল করছি। একদিন যে শহরে মুসলমানদের বিচরণকে বাঁধা দেয়া হতো। আজ সেই শহরে ২ মাইল পরপর মসজিদ। কোন মসজিদ সালাফীদের, কোন মসজিদ জামাতিদের। কোন মসজিদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের। কোন মসজিদ আবার তাবলীগি জামাতের। বাংলাদেশের লোকজনের ৮০ শতাংশ আক্বীদায় সুন্নী হলেও, মসজিদ মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রায় সব জামাতিদের। এদিক দিয়ে পাকিস্তানী সুন্নীরা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, ওয়েলফেয়ার প্রতিষ্ঠান সমগ্র ব্রিটেনে নামকরা। স্পেন বিজয়ের মত মুসলমানদের এ বিজয় চলতেই থাকবে। ভৌগলিক বিজয় হয়তো এখন আর সম্ভব নয়। তবে সাংস্কৃতিক বিজয়ের দ্বার এখন অবারিত। একদিন মুসলমানদের ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম ঘোষণা দেয়ায় আলা হযরত রহঃকে একদল লোক ব্রিটিশদের দালাল বলে অপবাদ দেয়। হয়তো ভবিষ্যতে ইংলিশদের ভুমিকে দারুল হারব বললে মিথ্যা বলা হবে। মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় হয়তো একদিন এসব ভুমিই হবে দারুল ইসলাম। কেননা আজকের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো ইতোমধ্যেই দারুল গজবে পরিণত হয়ে গেছে সালাফী সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের কারণে।