মহান কুরবানির বিনিময়ে বেঁচে গেলেন ইসমাইল (আ.): কে সেই মহান কুরবানি?

– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

রহস্যে ঘেরা স্রষ্টার জগত। ছোট ছোট রহস্য। আবার কখনো বড় বড় রহস্য। কখনো দিবালোকের মতো স্পষ্ট রহস্য যা সহজেই সবার দৃষ্টি গোচর হয়, কখনো আবার রহস্যে ঘেরা রহস্য যা সহজে সাধারণের কাছে ধরা পড়ে না। লুকায়িত রহস্য। এ রহস্যের দ্বার সবার কাছে উন্মোচিত নয়। স্রষ্টা রহস্য নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানি দেয়ার প্রস্তুতি এবং এ থেকে মুক্তি, জটিল রহস্যগুলোর মধ্যে একটি যা লুকায়িত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ পাক নিজেই সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে ঘোষণা করেন, “মহান এক কুরবানির বিনিময়ে আমি তাঁকে মুক্ত করে নিয়েছি”। [সূরা সাফফাতঃ ৩৭:১০৭] “জবহে আজীম” একটি পশুর কুরবানি আবার আজীম হয় কি করে?

সৃষ্টির একেবারে প্রথম দিকেই তিনি কলম সৃষ্টি করেন। প্রথমে নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), এরপর আরশ, কুরসী, লওহ এবং কলম। কলম সৃষ্টি করেই তিনি আদি অন্ত সব কিছু লিখতে আদেশ দেন কলমকে। কলম লিখে চলে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব লিখে চলে কলম। যা যা ঘটবে তার সব। এ কারণেই ঈমানের ৭টি মৌলিক বিষয়ের একটি হলো তাক্বদীরে বিশ্বাস। ভালো মন্দ যা কিছুই ঘটুক, সবই স্রষ্টার পক্ষ থেকে এবং তা আগে থেকেই নির্ধারিত। ফলে মুসা আলাইহিস সালাম যখন বরযখের জগতে আদম আলাইহিস সালামকে বললেন, “আপনি গন্দম না খেলেই আমরা বেহেশতে থাকতে পারতাম”। উত্তরে আদম আ. বলেন, “এর জন্য আমাকে দোষারোপ করবে কিভাবে? আমাকে সৃষ্টির বহু পূর্বেই আল্লাহ পাক আমার তাক্বদীর লিখে রেখেছেন”। অর্থাৎ যা কিছুই ঘটে তাতে আমাদের কোনই হাত নেই এবং মহান রব কর্তৃক তা আগে থেকেই নির্ধারিত। নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ে গেছে অনেক আগেই, আমরা কেবল নাটকের দৃশ্যায়ন দেখি মাত্র।

সূরা আস-সাফফাতের ১০৭ নং ছোট্ট একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বললেন, “মহান এক কুরবানির বিনিময়ে আমি তাঁকে মুক্ত করে নিয়েছি”। কোনও কোনও মুফাসসির মনে করেন ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্থলে বেহেশত থেকে যে দুম্বা জবাই করা হয়েছিল, সেটিই “মহান কুরবানি”। কিন্তু কিছু কিছু মুফাসসির এর রহস্য ভেদ করে লিখেন, ইসমাইল আলাইহিস সালামের চেয়ে একটি দুম্বা আবার কিভাবে মহান কুরবানি হয়? আসলে আল্লাহ পাক এমন একটি মহান কুরবানির বিনিময়ে নবী ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মুক্ত করেন যে কুরবানি ইসমাইল আলাইহিস সালাম থেকেও মহান এবং উচ্চ মর্যাদার। যে কুরবানি আল্লাহ পাকের কাছে সমস্ত কুরবানির চেয়ে প্রিয়তর এবং যে কুরবানির ব্যাপারে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আগে থেকেই অবগত করে রেখেছিলেন। যাকে কুরবান হতে হবে তিনিও জানতেন এ ব্যাপারে। তাঁর কাছের এবং নিকটের সবাই জানতেন, কিন্তু কেউই এ কুরবানি প্রতিহত করতে চান নি। কেননা, আল্লাহ পাকের কাছে এ কুরবানি অন্য সমস্ত কুরবানির চেয়ে অধিকতর প্রিয় এবং এই কুরবানির পেছনেও রয়েছে লুকায়িত রহস্য।

নবী ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক নবী ইসমাইল আলাইহিস সালামের কুরবানি হয়ে গেলে নূরে মুহাম্মদী (দরূদ) ক্রমধারায় এ ধরায় আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতো। কেননা, ইসমাইল (আ.) এর মাধ্যমেই নূরে মুহাম্মদী ক্রমান্বয়ে কুরাইশ বংশে হযরত খাজা আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ঔরসে আত্মপ্রকাশ করেন। যেমনটি নবী করীম (দরূদ) বলেছেন, “আমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া এবং দুই জবেহের সন্তান”।

Related image
প্রতীকী ছবি, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, কারবালা। মহান কুরবানি

উল্লেখ্য, এক জবেহ হলেন নবী ইসমাইল আলাইহিস সালাম এবং অন্য জবেহ হলেন খাজা আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। মহান একটি কুরবানির বিনিময়ে আল্লাহ পাক ইসমাইল আলাইহিস সালামকে রক্ষা করার কথা বলেছেন। অপরদিকে ১০০টি উটের বিনিময়ে খাজা আব্দুল্লাহকে রক্ষা করা হয়। একই সাথে এ দুই জবেহের জন্য সঙ্গীসাথী সহ নিজের জীবনকে কুরবান করেন কুরআনে বর্ণিত সেই “মহান কুরবানি” ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু। হাদিস গ্রন্থগুলো – তারিখে তাবারী, তারিখে বাগদাদি, বেদায়া-নেহায়াসহ অন্যান্য ইতিহাসের গ্রন্থগুলো একমত যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কারবালা রওয়ানা দেবার মুহূর্তে মদিনা এবং মক্কার তৎকালীন জীবিত বিখ্যাত সব সাহাবাই তাঁকে কুফা যেতে বারণ করেছেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কুফা যাওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখতে। কিন্তু তিনি আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ অন্যান্য আত্মীয়দের অবগত করান যে পূর্বের রাতে তাঁকে তাঁর নানাজান (দরূদ) কুফায় যাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক হাদিস থেকে আরো জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন রা. এর জন্মের পরপরই উম্মে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছে রাসূল (দরূদ) জিবরাঈল আ. কর্তৃক কারবালার ঘটনার সংবাদ প্রদান করেন। মওলা আলী, খাতুনে জান্নাত এবং পরিবারের অনেকেই পূর্ব থেকেই কারবালার ঘটনার কথা জানতেন। কিন্তু এ ঘটনাকে রদ করার জন্য কেউই কোনও আবদার করেন নি। কেননা, আল্লাহ পাকের খুশিতে রাসূল (দরূদ) খুশি এবং রাসূলের খুশিতে আহলে বাইত খুশি।

মওলা আলী সিফফিনের যুদ্ধে যাবার পথে কারবালা নামক স্থানে এলে রাসূল (দরূদ) কর্তৃক বর্ণিত কারবালা দেখে চিনতে পারেন এবং অঝোরে কাঁদতে থাকেন। একই স্থানে হযরত মুয়াবিয়ার বাহিনী ফোরাতের পানি বন্ধ করে দিয়েছিল, যেখানে এজিদের বাহিনী ইমাম হুসাইনের জন্য পানি বন্ধ করেছিল। মওলা আলী যুদ্ধ করে এ স্থান উদ্ধার করে উভয় বাহিনীর জন্য ফোরাতের পানি উন্মুক্ত করে এক মহান বদান্যতার প্রমাণ দেন। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস আমরা জানি।

দুই জবেহের সন্তান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সেই দুই জবেহের বিনিময় হলেন “মহান কুরবানি” ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু।

[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে নিজ নিজ টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মতামত জানাবেন।]

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *