– ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
যে মুহূর্তে স্পেনের মুসলমানগণ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলো এবং উত্তর স্পেনের খৃষ্টানরা শক্তি সঞ্চয় করে দক্ষিণে মুসলমানদের কোণঠাসা করছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে উসমানীয় সাম্রাজ্যের আধিপত্য এশিয়া মাইনর থেকে ইউরোপের দিকে দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একদিকে স্পেনে মুসলমানদের পতন এবং অন্যদিকে উসমানী সাম্রাজ্যের মাধ্যমে মুসলমানদের উত্থান। উসমানী সাম্রাজ্যের জেনিসারি বাহিনী নামে চৌকশ সেনারা তখন ক্ষিপ্রগতিতে ইউরোপের একের পর এক শহর পদদলিত করছিল। গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, স্লাভ সভ্যতা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় খণ্ড রাজ্যগুলো একে একে মুসলমানদের করতলে আসছিল।
আফসোস, তখন স্পেনের মুসলমানরা নিজেদের অন্তর্দ্বন্ধ আর কলহে নিজেদেরই শক্তি ক্ষয় করছিল। স্পেনের বা আন্দালুসিয়ার মুসলিম শাসকদের উদার নীতির সুযোগ নিয়ে সেখানে ইহুদী এবং খৃষ্টানরা আরবি ভাষা শিক্ষা লাভ করে সাম্রাসজ্যের বড় বড় পদে সমাসীন হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশে মতো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিতে প্রশাসনের সর্বস্তরে অমুসলিমরা আধিপত্য বিস্তার করে। ঐতিহাসিকরা সবাই একমত যে, ইহুদীরা স্পেনের মুসলমানদের সময়ে ব্যবসা-বানিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকারসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে, তাদের পুরো ইতিহাসে তারা কখনোই এমন সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে পারেনি। প্রতিটি শক্তিই তাদেরকে কেবল তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আর তাদের উপর সীমাহীন নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু ইহুদীরা আজ সেসব ভুলে গিয়ে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে যাচ্ছে। খৃষ্টানদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৪৩২-১৪৮১) কন্সটান্টিনোপন জয় করেন ১৪৫৩ সা্লে। এভাবে একের পর এক রাজ্য তাদের পদানত হতে থাকে যেমন, গ্রীস ১৪৫৮ সালে, পুরো সার্বিয়া ১৪৫৯ সালে, বসনিয়া ১৪৬৩ সালে, হার্জেগোভিনা ১৪৮১ সালে, মন্টিনেগ্রো ১৪৯৯ সালে। উল্লেখ্য বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো, আলবানিয়ার মানুষজন তুর্কি মুসলমানদের স্বাগত জানায় এবং বলপ্রয়োগ ছাড়াই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়। অপরদিকে সার্বরা প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং সময় সময় উসমানীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। সার্বদের বিরুদ্ধে এ কারণে উসমানী এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো, মেসেডোনিয়ার সৈন্যদের সম্মিলিত শক্তিগুলোর অনেকগুলো ছোট-বড় যুদ্ধ হয় এবং বিভিন্ন সময়ে সার্বদের জনপ্রিয় নেতাদের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এ কারণেই সার্বদের সাথে আশেপাশের অঞ্চলের মুসলমানদের দ্বন্ধ অনেক পুরনো। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৯০ সালের দিকে বসনিয়ার মুসলমানদের উপর সার্ব বাহিনীর গণহত্যার মধ্য দিয়ে।
১৯১২-১৩ সালের দিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু পূর্বে আরেকটি বড় আকারের যুদ্ধ হয় যাকে ইতিহাসে বলকান যুদ্ধ নামে অভিহিত করে হয়ে থাকে। এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে উসমানীয় মুসলমানরা চিরতরে পুরো অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এর এক বছর পর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালে সারায়েবোতে অস্ট্রিয়ান যুবরাজ ফ্রাঙ্ক ফার্ডিন্যান্ড আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। চলে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। এ যুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তি যত না ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় উসমানীয় খেলাফত। আভ্যন্তরীণ নানান সমস্যায় জর্জরিত উসমানীয় খেলাফতের সমাপ্তি ঘটে ইহুদীদের দোসর মোস্তাফা কামাল পাশার মাধ্যমে। এর আগে যুদ্ধ শেষ হবার পর সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে এক চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান তুরস্ক ব্যতীত সাম্রাজ্যের অন্য সব অঞ্চল পশ্চিমা শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। সে আরেক দুঃখের ইতিহাস।
বলকান অঞ্চলের বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো, আলবানিয়া, মাকেডোনিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চল সার্ব রাজতন্ত্রের অধীনে চলে আসে। তা চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পযন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে যুগোস্লাভিয়ান নেতা দ্রাজা মাজলভিচের (Draza Mhajlovic) নির্দেশে মুসলিম নিধন চলে এবং এর ফলে সার্বিয়ার সান্দজাক, বসনিয়া এবং হারজেগভিনায় প্রায় ৩ লক্ষ মুসলমান নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ প্রাণ হারায়। ১৯৪৫ সালে মার্শাল টিটো (Josip Broz Tito) এ অঞ্চলের দায়িত্ব নেন এবং সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া (Socialist Federal Republic of Yugoslavia) গঠন করে এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮০ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। রাশিয়ায় স্তালিন এবং লেনিনের সমাজতান্ত্রিক লৌহশাসনের মতো যুগোস্লাভিয়াতেও একই ধাঁচে সমাজতান্ত্রিক স্টিম রুল বা স্বৈরশাসনের ফলে মুসলমানদের উপর নেমে আসে অমানিশা। তাদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, মসজিদগুলোতে তালা দেয়া হয়, শরিয়া আইন বাতিল করা হয়, এবং মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। মুসলিম সৈন্যদের জন্য হালাল খাবার বাতিল করা হয় এবং তাদেরকে শূকর এবং অপবিত্র খাবার খেতে বাধ্য করা হয়। মুসলিম এবং অমুসলিম সবার জন্য চাকরির শর্ত হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। ধর্মীয় কোন আচার বা চিহ্ন পেলেই চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয় মুসলমানদের। ফলে মুসলমানগণ চাকরি এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে দূরে সরে আসে এবং ক্রমে ক্রমে কেবল শূকর না খাওয়া মুসলমানে পরিণত হয়।
১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক শাসন ভেঙে পড়ে এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ১৯৯২ সালের এপ্রিলে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ সময় থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নারীদের ধর্ষণ করে গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত আটকে রাখা হতো। যুবক ও বৃদ্ধদের হত্যা করে অসংখ্য স্থানে গণকবর মাটি চাঁপা দেয়া হয়। বসনিয়ার মুসলমানদের রক্ষার্থে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়, কিন্তু ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে বসনিয়ার সার্বরা স্রেব্রেনিকার নিরাপত্তা বলয়ে থাকা নারী, শিশু, বৃদ্ধ-যুবক মিলিয়ে প্রায় ৮ হাজার লোককে হত্যা করে। এ সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ডাচ শান্তিরক্ষীরা তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৯ সালের মার্চে ন্যাটো বাহিনী যুগোস্লাভিয়ার বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান-হামলা করলে সার্বরা বসনিয়া, কসোভো, আলবানিয়ে থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
[ভালো লেগে থাকলে লেখাটি কপি করে আপনাদের টাইমলাইনে পোষ্ট করতে পারেন। আর দয়া করে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]
Leave a Reply